মূর্তি নদী
‘মানুষের জীবনের ছবি আঁকা ড. বিরাজলক্ষী ঘোষের হবি নয়, মনের তাগিদ। বলা যায় একেবারে হৃদমন্দির থেকেই কাজটি করে থাকেন। মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি খাদহীন ভালোবাসা এই শিক্ষাবিদের। তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডারে বহু মানুষের জীবনযুদ্ধের বর্ণনা সংরিক্ষিত। সুস্থ পরিবেশ রক্ষায় ‘পরিবেশ আন্দোলনে’ উল্লেখযোগ ভূমিকা রাখছেন এই সমাজচিন্তক ও রবীন্দ্র গবেষক’
টানা প্রায় পাঁচমাস সাংঘাতিক চাপের মধ্যে কাটিয়ে জোর করেই একটু অবকাশ বার করে গিয়েছিলাম ডুয়ার্স। মূর্তি নদীর কথা অনেকের মুখে শুনেছিলাম। এবার চাক্ষুষ দেখতে পৌঁছে গেলাম। শিলিগুড়ি থেকে মূর্তি ঢুকতে বেলা গড়াল। লাঞ্চ সেরে মনে মনে ক্লান্ত অনুভব করলেও খুব ঝরঝরে বোধ করছি। বাকিদের সিদ্ধান্ত তারা রেস্ট নেবে।
পারিচারিকা মাসীকে রাজি করিয়ে দুজনে চললাম হাঁটা পথে মূর্তি। আকাশের মুখ ভার। ডানদিকে পাহাড়ের রেখা। একটু আগেই ঝিরঝিরে জল হয়েছে। দারুণ মনোরম পরিবেশ। একদম গল্পের মত। মূর্তির কাছে গিয়ে ব্রিজের বাম দিকের রাস্তা ধরে নামতে যাব-ঠিক তখনই একটি বাচ্চা হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। ‘তুই জানিসনা তুই ডুবে যাবি চল তোকে দেখিয়ে দেই।’
মূর্তি নদীর তীরের শৈশব
ছেলেটা আমার ছেলের বয়সি। ভীষণ চঞ্চল। পরনের কাপড় দেখেই আর্থিক অবস্থা আন্দাজ করা যায়। এই বয়সের ধর্মই চঞ্চলতা। কিছু বলার আগেই এক লাফে মূর্তিতে নেমে গেলো। ‘আয় তুই এখানে আয়, আমি সব জানি, আমার অনেক শক্তি, তোরা ডুবে যাবি’ আমি বললাম আরে জানি আমরা এখানেই থাকবো, পাড়ের কাছে। তোর চিন্তা নেই। আমরা জলের ভেতর পাথরে বসলাম। আর ছেলেটা জলে দাপাদাপি করতে লাগলো। কিছুক্ষন এভাবে কাটলো। নদীর থেকে সংগ্রহ করলাম নানা রঙ বেরঙের নুড়ি। তারপর উঠে চা খাবো ভাবছি। এমন সময় ছেলেটা কাছে এলো ।
‘পাঁচটা টাকা দিবি খাজা খাবো’। আমি মাসীকে বললাম যাক বাচ্চা ছেলে চাইছে দেই। এই বলে টাকা দিতেই ও তিন লাফে উপরে উঠে গেল। আমরা মূর্তি ব্রিজের উপর দাড়িয়ে ইলশে গুঁড়ি উপভোগ করতে লাগলাম। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সামনেই চায়ের দোকানে দাঁড়ালাম। চা দিতে বলে অপেক্ষা করছি, এমন সময় দেখি ছেলেটা আসছে হাঁটতে হাঁটতে। আর জিভ চাটছে একটা গুটখার প্যাকেট। এক দাবড়ানি দিলাম। একিরে তুই যে বললি খাজা খাবি? এসব কি খাচ্ছিস? কারণ আমার ধারণা ছিল খাজা কোনো মিষ্টি।
প্রকৃতি সুন্দরী মূর্তি নদীর পাথর কোয়ারী
পাশেই দাঁড়িয়ে একজন ময়লা তুলছিলো বয়স কুড়ি একুশ লোকটি। বললো ম্যাডাম এ একটা ‘নষ্টচন্দ্র ‘। এ সব খায়। চরস মদ গুটখা। আমার তো মাথা ঘুরছে শুনে। চা খাওয়া ঘুচে গেল। বললাম কোথায় বাড়ি তোর? ওই সাফাই করার ছেলেই বলতে শুরু করলো..”ওর ঘর নেই । ওর বাবা দিন রাত গাজা মদ এর ঠেকে পড়ে থাকে। ওর মা পালিয়েছে একটা ছেলের সঙ্গে। ওর কেউ নেই। রোজ নদীর ধারে আসে সকাল থেকে বিকাল অবধি থাকে যে টাকা দেয় এসব কিনে খায়। আর তারপর এর ওর ঘরের সামনে শুয়ে পরে। এ বহুত পাজি আছে। বলে ছেলেটি ময়লার গাড়ি নিয়ে নদীর পাশে নামলো। বাচ্চা টিও গেলো গাড়ি ঠেলতে।
ততক্ষনে চা দিয়ে গেল দোকানী। যে আমি চা পাগল ততক্ষনে চা খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। যা হোক কোনো মতে চা শেষ করতে করতে ওরা ময়লা ফেলে চলে এলো। আমি বাচ্চা টাকে ডাকলাম তোর নাম কিরে ? এদিকে আয়। ও হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো, বলল রোহান। আমি ওকে ধরে যতটা সম্ভব ওর মতো করে বোঝাতে লাগলাম। যে মদ গুটখা বা নেশার জিনিস খেলে কি কি হতে পারে। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলো। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো । বললাম যদি কেউ তোকে টাকা দেয় তুই এবার থেকে কেক বিস্কুট আইস ক্রিম এগুলো খাবি কেমন। এসব জিনিস খাবিনা। ও মাথা নাড়ল। বললো আমাকে বিস্কুটের প্যাকেট দিবি আমি খাবো? আমি সঙ্গে সঙ্গে কিনে দিলাম। ও মহানন্দে খেতে লাগলো। সাফাই করার ছেলেটিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে ওর কোনো ভাই বোন নেই? বললো না। বাপটা মহা হারামী আছে ম্যাডাম। আর মাও চলে গেল। ওর আর কেউ নেই।
আমি রোহানকে বললাম যাবি আমার সঙ্গে ? ওখানে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দেব। বললো না আমার মা আসবে তো। ঠিক আসবে। আমি কোথাও যাবনা। আমি বললাম আচ্ছা তোর একটা ছবি তুলবো আমি? ও অবাক হয়ে বললো তোল। ছবিটা তোলার পর বললো দেখা কই আমার ছবি? ওকে দেখাতে খুব খুশি হলো। তুই রাখবি? আমি বললাম হ্যাঁ রে রাখবো। ওর চোখটা খুশিতে ভরে গেল। মনে মনে ভাবলাম এমন কত জিনিস আমার কাছে খুঁজলে পাওয়া যাবে, যা অন্যের কাছে অপ্রয়োজনীয় ,মূল্যহীন। যেমন মাঠের ধারে কুড়িয়ে পাওয়া জারুলের বীজ, মূর্তি নদীর নুড়ি বা গরুমারার বুনো ফল..
রোহান এগিয়ে এলো হাসতে হাসতে আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলে গেল বাই বাই। নিজের মনে না না রকম অঙ্গভঙ্গী করতে করতে অদৃশ্য হয়ে গেল বনানীর অন্ধকারে। সন্ধ্যা নামছে ফিরতে হবে। হাঁটতে লাগলাম রিসর্টের পথে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে পড়লো শুনেছিলাম কোথায় যেন ভাদ্র মাসের শুক্ল বা কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্থ চাঁদকে নষ্ট চন্দ্র বলে। এই চাঁদ দেখতে নেই। দেখলে নাকি কলঙ্ক হয়। আচ্ছা কে বলে একথা ? কলঙ্ক কি? কলঙ্ক কোথায় থাকে শরীরে নাকি মনে? চাঁদ কি কখনো বলবে সত্যিটা কি? নাকি আমরাই চাঁদকে নষ্ট করি? ২৯ জুন-২০২২
লেখক : ড. বিরাজলক্ষী ঘোষ শিক্ষাবিদ, রবীন্দ্র গবেষক, পরিবেশ সংগঠক ও সম্পাদক দ্য ওমেনভয়েস