ড. বিরাজলক্ষী ঘোষ
“সুকৃতের শুভ জন্মদিনে ২৩-১১-২২
জন্মদিন আসে যায়
অনেক কথা লেখা হয়
জীবনের পাতায়
আলো আবছায়া”
প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা হবার পর তিনমাসের মধ্যে সমস্ত আশাভঙ্গ হয়। আমার ডাক্তার ছিলেন রত্নাবলী চ্যাটার্জী। যিনি কিনা কলকাতার আবর তাবড় ভিআইপি দের ডাক্তার। অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত থেকে আরো অনেকের সন্তানের জন্মের তিনি সাক্ষী। আমার লেডি গাইনো প্রেফারেন্স ছিল, তাই এক দিদির পরামর্শে ওনার কাছে যাই। কিন্তু ডাক্তার ভগবানও হয় আবার তার উল্টোটাও।

তারই প্রমাণ মেলে। উনি আমার অবস্থা এমন করে ছাড়েন যে সন্তানের জন্ম তো দূরের কথা, আমি যে কি করে বেঁচে গেলাম সে অন্তর্যামী জানেন। দ্বিতীয় বার শ্বশুর মশাই এর পরামর্শ মেনে সোজা তাঁর বন্ধু স্বর্গীয় ডাক্তার প্রশান্ত মুখার্জী এর কাছে। তখন আর আমার লেডি গাইনোর ফ্যাসিনেশন নেই। ডাক্তার বাবু সব টেস্ট করে বললেন একদম ওকে। তোর কোনো সমস্যায় নেই।
কেবল ‘আয়রন’ এর একটা ওষুধ দিয়ে বললেন ছয়মাস বিশ্রাম নিয়ে প্ল্যান এ যা। চিন্তায় পড়ে গেলাম কারণ, এমনিতেই লেট ম্যারেজ তারপর আরো লেট। যাইহোক একদম ওনার কথা মত চলে ছয় মাস পরেই একদম স্বাভাবিক ভাবেই কনসিভ এবং তার নয় মাসের মাথায় ছেলের জন্ম।
জন্মের সময় ছেলের ওজন ছিল প্রায় সাড়ে তিন কিলো। আমার বয়স প্রায় ৩৬। যাই হোক ঝড় কেটে গিয়েছে ভাবলেও অন্য ঝড় অপেক্ষা করছিল। আকাশ ঝকঝকে কোনো পূর্ব লক্ষণ নেই। সব কিছুই অনুকূলে, স্বস্তি।
ছেলের বয়স সবে সাড়ে তিন মাস। এরমধ্যে ধুম জ্বর আর কান্না। ওকে দেখেন ডাক্তার লোকেশ পান্ডে। অত্যন্ত ভালো মানুষ। দেখেই বললেন ইউরিন ইনফেকশন। জ্বর কমিয়ে ইউরিন কালচার করে টৎড়ষড়মরংঃ দেখাতে বললেন। সেই সঙ্গে বাচ্চার যাতে কিডনির ক্ষতি না হয়, তার জন্য প্রিভেনটিভ ডোজ এ একটা ওষুধ দিলেন একবছর পর্যন্ত।
আমরা কলকাতার টপমস্ট পেডিয়াটিক সার্জন শুভাশিস সাহার দ্বারস্থ হলাম। ওনার অধীনে সিএমআরআইতে প্রথমে ছেলের একটি পরীক্ষা হলো। যেটা অত্যন্ত যন্ত্রণা দায়ক। সেটা আমার দেবদূতের মত কচি শিশু সহ্য করলো। তারপর আরো একটি পরীক্ষার সময় সি এম আর আই তে পরীক্ষার যন্ত্রটি ভেঙে গেলো। তখন ছেলের সাড়ে পাঁচ মাস। ও একদিন না খেয়ে থাকলে হল। পরবর্তীতে পরীক্ষার জন্য আমাদের আনন্দলোকে পাঠানো হলো।
সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা হবার পর শুভাশিস সাহা বলেন ছেলের ৎবভষীঁ হচ্ছে। অর্থাৎ ওর ডানদিকের ব্লাডার ঢাকনা জন্মগত ভাবে নেই। তাই প্রতিবার টয়লেট হবার সময় কিছুটা নধপশ ভষড়ি হয়ে কিডনিতে যাচ্ছে। ফলে ঁৎরহব রহভবপঃরড়হ। এখনতো যেরম ওষুধ চলছে চলবে। তারপর ছেলে একটা ইনজেকশন দেওয়া হবে যেটা নাকি বিদেশ থেকে আনতে হবে। যেটা ছেলের ব্লাডারে আর্টিফিসিয়াল ঢাকা তৈরি করবে ডানদিকে।
সব বক্তব্য শুনে আমি বাড়িতে ফিরে বিষয়ফ জানতে পড়াশোনা শুরু করলাম। এক পর্যায়ে ‘সাউথ ইস্ট এশিয়া’র একজন সেরা ‘পেডিয়াট্রিক ইউরো মেডিসিন’ সার্জন’র সন্ধান পেলাম। তারা মাসে একদিন কলকাতায় বসেন। খোঁজ নিয়ে সমস্ত কাগজ পত্র নিয়ে গেলাম তাদের কাছে। তাদের খুব হালকা করে সমস্তই বোঝালাম। বললেন এটা শিশু ছেলে সন্তানদের (সধষব পযরষফ) খুব কমন। কিছু করতে হবেনা। ছেলের একবছর হলে একটা কিডনি টেস্ট করবেন বি এম বিড়লাতে।
আর তারপর ওই যে ওষুধটা ওকে প্রিভেনটিভ ডোজ দেওয়া আছে বন্ধ করে দেবেন। কোনো ভয় নেই । দু’বছরের মধ্যে আর ইউরিন ইনফেকশন না হলে কিছুই করতে হবেনা। ওটা ঠিক হবে আপনা থেকেই। যথারীতি একবছর অতিক্রান্ত হতেই টেস্ট করে রিপোর্ট ভালো এলো আর ওষুধ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হল। এরপর একবছর নিয়মিত টেস্ট করতাম। না আর কোনো ইউরিন ইনফেকশন ওর হয়নি। ঠিক ওই দুই ডাক্তার বাবুর কথা মত সব স্বাভাবিক চলছে।কোনো ইনজেকশন দিতে হয় নি।
আজ ২৩শে নভেম্বর। সুকৃতের আটবছর পূর্ণ হলো। যে কোনো বাবা-মার কাছে একমাত্র কাম্য তাঁর সন্তান সুস্থ ভাবে মানুষ হোক। আমার জন্য কোনো প্রাইজ মেডেল আনতে হবেনা। কারো সঙ্গে কম্পিটিশন করারও প্রয়োজন নেই। নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠো, এটাই কাম্য। আর হ্যাঁ ওই ক্রাইসিস পিরিয়ডে আমি একেবারে স্বাভাবিক থাকতাম। পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করতাম এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতাম। আজ একজন শ্লেষাত্মক ভঙ্গিমায় বললেন তুমি এত কুল থাকো কি করে। অবাক লাগে তবে এটা অর্জন করতে হয়। যত সহজে আজ লিখলাম কেউ মেলালে বুঝবেন আসলে কত কঠিন.. তাই শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ রইলো রবির কথায়-
হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন ।
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন ।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়