remember : মনে পরেছে
- আপডেট সময় : ০৯:০৭:১২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২ ২৭৮ বার পড়া হয়েছে
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস
এই মুর্হূতে গাইতে ইচ্ছে করে কিংবন্তী শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সেই গানটি ‘আষাঢ় শ্রাবণ, মানে না তো মন’। গাইতে পারছি আর কই। গলাতে যে প্রবল গ্রীষ্মের কাঁটা আঁটকে গেছে! আষাঢ় পার হয়ে গেলো বৃষ্টিহীন হয়ে। শ্রাবনেও বৃষ্টি অধরাই। মেঘহীন নীল আকাশে একচক্ষু সূর্যের চোখ রাঙানো।
দার্শনিকেরা বলবেন, ডিটেইলস এ যাওয়ার আগে আত্মসমীক্ষা করুন। আধ্যাত্মবাদী বলবেন, সবই ঈশ্বরের লীলার রূপ। যুক্তিবাদী কি বলবেন? বলবেন, পৃথিবীর কার্য ও কারণ সম্পর্কের কথা। পথে এবার নামো সাথী, পথে হবে এপথ চলা..পথ ও পন্থা নিয়ে ভাবছি। ভাবছি, কবেকার প্রস্তর যুগে মানুষ আত্মনির্ভরশীলতা শেখাতে গাছের ডাল নিজের হাতে ভেঙে পশু শিকার করে খাদ্যের সুশৃঙ্খল বিন্যাস দেখিয়েছিলো বিশ্বকে। আমরা পড়ি। কিন্তু শিখি কতটুকু! নম্বরের যুগে, ক্যারিয়ারই সব, এমন গুরুমন্ত্র রপ্তের এই কালবেলায় লেখাপড়ার কতটুকুই আমরা মনে রাখতে পারছি!!
এই ১, নম্বর প্রশ্নের উত্তর তবে হউক আত্ম সমীক্ষা। আজন্ম লালিত যত্নশীল আমার প্রাণ! প্রাণ জানেনা, প্রাণের বিলাপ! তবে এ কেমন প্রাণহীন প্রাণ? ধরা যাক, আমি একটি ব্যাক্তি বিশেষ। তার জীবন শুরুই হয় ( বর্তমান পরিস্থিতি) অন্যকে অনুকরণ করে।
(এইবার রেজাউল করিমের আত্মগত বিশ্লেষণে ঢুকছি) নাসিরুদ্দিন শাহ আর ওম পুরির একটা সাক্ষাতকার শুনছিলাম। ওদের কলেজবেলার কথা, বেড়ে ওঠার দিনের গল্প শোনাতে শোনাতে নাসির হঠাৎ বললেন, অপরের জীবন নিয়ে বাঁচা নয়, নিজে নিজের মত বাঁচা দরকার। কোন একদিন আবিষ্কার করলেন, এই যে মনুষ্যজন্ম সে কি শুধু অপরের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য, অপরকে নকল করার জন্য নাকি নিজের মতো করে বাঁচার মধ্যে মনুষ্য জন্মের সার্থকতা। জীবনের উৎকর্ষ অন্যের নকল করে সম্ভব নয়। নিজের স্ফুরনের জন্য দরকার নিজেকে চেনা, বোঝা ও অপরের নকলনবিশী না করে নিজেকে মেলে ধরা- আত্মানং রথিনং বিদ্ধি, শরীরং রথমেব তু। বুদ্ধিংতু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগামেব চ…
জীবনের সার্থকতার এই সংক্ষিপ্তাকার আমাদের অচেনা নয়।
প্রশ্ন হলঃ আদর্শ পুরুষ, আদর্শ জীবনযাত্রা, অনাদিকালের সংস্কার জীবনে প্রতিফলিত করা আর নকলনবিশীর মধ্যে পার্থক্য কিভাবে নির্ণয় হবে, বিশেষতঃ আজকের দিনে যখন নিজের অন্তরের দিকে দৃষ্টিপাত করার সময় নেই? এখনকার সকাল, সন্ধ্যে তো অপরের কাছে নিজেকে শুধু নিখুঁত করে তুলে ধরার প্রতিযোগীতা! আমি রূপে লক্ষী, গুণে সরস্বতী, নাচে উর্বশী, সৌন্দর্যে মেনকা-রম্ভা (বা তার মেল কাউন্টার পার্ট) এই দেখনদারীর জীবনে আমিটুকু কোথায়?
কোনো সিনেমা ললনা তাঁর সুন্দর মুখ ও তনুদেহটির জন্য বিখ্যাত তার জীবনের প্রতিটি ধাপ মুখস্ত করে যখন তার চৌদ্দপুরুষের শ্রাদ্ধ করে তখন ভুলে যায় যে, বস্তুতঃ পক্ষে সব অভিনেতা আর অভিনেত্রী সর্বাগ্রে বুঝে যায় যে অপরের চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে ক্ষয় করার মতো অসার আর কিছু হতে পারে না! তিনঘন্টা ধরে অপরের জীবনের সাথে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে শেষবেলা নিজের কাছে ফিরে যেতে হয়।
তাই বোধহয় ওরা অনায়াসে শ্রেয় কাজের লোকদেখানো আত্মপ্রবঞ্চনার ফাঁদে জড়াতে চায় না। আমাদের মধ্যবিত্তসূলভ ভণিতা তাদের দরকার হয়না! নিজেকে চিনে ফেলা ওদের সহজাত হয়ে ওঠে, নিজের জীবন যাপনের তীব্র আকুতি ফুটে ওঠে ওদের চলাফেরার ছন্দে, জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখার মধ্যে, সংশয়ে ওদের সংকল্প টুটে না, নীরবে নিজেকে ঢেকে রাখে না, বিধাতার দেয়া প্রাণ ম্রিয়মান রেখে জীবনের সার্থকতা খোঁজার অসারতার বাইরে তারা বেরিয়ে আসতে চান।
হতে পারে এই চিন্তার মধ্যে নান্দনিকতা নেই, হতে পারে জীবনের উচ্ছ্বলতার বহিঃপ্রকাশে বা তার উন্মাদনায় একটু অহঙ্কারও জড়িয়ে আছে বা এমনও হতে পারে যে মনের রশি যে বুদ্ধি সেকথা তাৎক্ষণিক ভুলে থাকে তবু মনে হয় মধ্যবিত্ত চেতনার যে ক্লিশে ভাবনা তার থেকে বেরিয়ে আসা মনোবিপ্লবও বটে। সেই বিপ্লবের জন্য মহৎ হৃদয় দরকার, বড় পরিবর্তনের জন্য বড় বল দরকার সে বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই।
যারা নিজেরাই কোন না কোন আদর্শ-পনা বা ইজমের নাম করে নিজেকে অন্যের কাছে বিকিয়ে দিয়েছেন, তারা বিবেকের যন্ত্রণায় যতই কাতর হয়ে পড়ুন না কেন, কেউ নিজের মতো বাঁচতে চাইলে বাঁধা হয়ে তিনি দাঁড়ান কি করে?
ঋতুপর্ণ আর মিরের একটা আলোচনাতেও এই বিষয়টা উঠে এসেছিল। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ বলা মুশকিল- কখনো কখনো শ্রেয় ও প্রেয় এই দুয়ের তূল্যমূল্য সুক্ষ্মবিচার করতে হবে। যখন নিজের কৃতকর্মের ফলে অন্যের প্রতি অন্যায় হয় তখন প্রেয়র চেয়ে শ্রেয় উত্তম। নিজেকে নিজের মত বাঁচতে দেবার জন্য বোধহয় প্রেয় উত্তম। এ আলোচনার শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে! হয়তো আঘাত হয়ে দেখা দিলে আগুন হয়ে জ্বলবে!
করিম ভাইকে ছেড়ে এইবারে ‘আমি’ একক যাত্রা শুরু করি। এই যাত্রায় ‘আমি’ এক পথ যাত্রী। চলেছি চলেছি’র যুগে দুপাশে জনপদ, মাঠঘাট, খাল-বিলের দেশ থেকে বিদেশ এবং ভূগোল ক্লাসের গ্লোব। সেই গ্লোবে নিরক্ষরেখা, কর্কটক্রান্তিরেখা, দ্রাঘিমা আর অক্ষরেখার বিভাজনীয় উষ্ণ, অবউষ্ণ, নাতিশীতোষ্ণ, শীতঅঞ্চল, মরুঅঞ্চলের প্রকারভেদ ও তার ব্যাখ্যায় ঋতুকাল জুড়েই অনুভূত তাপমাত্রার রকমফের সহ চাক্ষুষ করেছি, রবীন্দ্রনাথের ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে, পাগলা হাতির মাথা নড়ে’- নামক দুর্দান্ত ছড়া। এই সব পাঠান্তে উপলব্ধি করি, আমি একা নই। পারস্পরিক সহযোগে নির্মিত এক বিশাল আয়োজনে পৃথিবীও আনন্দের হাট নির্মাণ করে দিয়েছে আমাদেরই জন্য।
এই যে একে অপরকে ( অ-পরার্থে,ভূমন্ডলীয় সকল প্রাণ) নিয়ে ও প্রত্যেকে আমরা পরের তরে – এই পথ, চলেছে চলেছে আদিঅন্তহীন কাল থেকে। তবে, আবার কি হোলো যে, কাল নিয়ে অন্ধকারের কথা আমি বলতে চলেছি?
হ্যাঁ। এক অন্ধকার যুগ। (ভয়েজ একাত্তরের পরিবেশিত সংবাদ) রোবট তিমি মাছের শরীরে সমুদ্রের প্লাস্টিক জড়িয়ে যাবে। চিনের আবিস্কৃত সেই প্লাস্টিক, তিমির শরীর থেকে অপসারণ করে আবারও তো এজেন্সির কর্মকর্তারা সেগুলো ডাম্পিং করবে মাটিরই ওপরে! কিন্তু জন্ম মৃত্যুর পৃথিবীতে একমাত্র হন্তক প্লাস্টিকের যে মৃত্যু নেই! সে যে সমুদ্র গর্ভ থেকে ভূখন্ডের সর্বত্র তার আপন মহিমায় এমনভাবেই বিরাজিত যে, সুবিধাভোগী মানুষ, ইউজ এন্ড থ্রো এর মানুষ আপন সুবিধার্থে তাকেই চিরমিত্র বানিয়ে ফেলেছে।
তাই, আজ নর্দমা থেকে সমুদ্র, বন থেকে পাহাড়, সর্বত্রই প্লাস্টিকের ঢক্কানিনাদে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল কলুষিত হয়ে মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আছে। এর সঙ্গে জুড়েছে বৃক্ষ নিধন করে হাই রইজ বানানোর প্রতিযোগিতায় কোটি এবং কোটিপতি হওয়ার দৌড়। জন্ম ও মৃত্যুর বাস্তবতার মাঝে থাকেনা কিছুই। শুধু থাকে কর্মের স্বাক্ষর হিসেবে ভাবি প্রজন্মের জন্য এক অক্ষত পৃথিবী, যেখানে কয়েক প্রজন্ম পরেও মানুষ মেঘ দেখলে কালিদাসের ‘কশ্চিৎকান্তা বিরহগরুণা’, গাইবে। গাইবে- ‘আষাঢ় শ্রাবণ, মানে না তো মন। ঝর ঝর ঝর ঝরিছে। তোমাকে আমার মনে পরেছে…..’
লেখক : শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, সংগঠক, প্রবন্ধকার, কবি এবং সমাজচিন্তক