ছবি স্কাস-এর সৌজন্যে
‘কর্মের মধ্যমে একটা দৃষ্টান্ত রাখতে চান প্রেমা। মানবিকগুণের আবেদনটিকে মানবসেবার মধ্যামে নিবেদিত করেছেন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর কল্যাণে, কাজ করছেন নিভৃতে। তাই বহুমাত্রিক অভিধাটি তার জন্যই মানায়। এ কারণেই আজকের আলোকিত নারী তিনি। নিজেকে শুধু আপন বলয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার দেয়ালে বন্দী না রেখে সমর্পিত হয়েছেন বহুজনের মাঝে শুভ, সুন্দর, কল্যাণের মঙ্গলালোকে। তিনি আমাদের সমাজের শুভবোধের সারথী’
এ. এইচ. ঋদ্ধিমান
নিজের প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের কার্যালয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বসে আছেন তিনি। মুখে স্মিত হাসি। জানিয়েছিলেন সকালের উড়ানে গিয়ে বিকাল নাগাদ কল দেবেন। তার হেরফের ঘটেনি। কথা অনুযায়ী যথারীতি কল পাওয়া গেলো। কয়েকদিন ধরে ঝড়োবৃষ্টি। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কল করার অনুরোধকে স্বাগত জানালেন।
জেসমিন প্রেমা
সাগরের নীল জলে মনের দুঃখ-কষ্টকে ধুয়ে নিতে চান। শক্তিযোগায় সঙ্গী উদার আকাশ আর অবহেলিত মানুষের সেবা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে একটু হাল্কা অনুভব করেন। ফের ডুব দেন কাজের ভুবনে। সময় বয়ে যায় সময়ের পিঠ বেয়ে। ইতিহাস হারায় ইতিহাসের পাতায়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হয় নিত্যকার কাজ। নানা সিডিউলে হারিয়ে যায় নিজের ভাবনা।
উত্তাল সমুদ্রের বুকে ভাসানচর। মনোরম পরিবেশ। মায়ানমারের বাস্তুচ্যূত মানুষের আশ্রয় শিবির। যারা অবর্ণনীয় স্মৃতিকে সঙ্গী করে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজরের টেকনাফে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার অসহায় মানুষের জীবনের কথা বিবেচনায় নিয়ে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বজোড়া সুনাম কুড়িয়েছে।
স্কাস পরিচালিত শিক্ষালয়ে শিশুদের পাঠদান
জানোতো ভাসানচর শিবির হচ্ছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার একটি আশ্রয় শিবির। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সেখানে যাবার বেলায়ও তার অবদান রয়েছে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাগরের বুক চিড়ে স্বপ্নকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন। নীল জলে নিজের চেহারার প্রতিভিম্ব দেখতে পান। উত্তাল ঢেউয়ে জলযান ওঠানামা করে সামনের দিকে এগোয়।
আজ বাবা থাকলে বড়ই খুশি হতেন। তার সহযোগিতা নিয়ে ঔরসজাত সন্তান সমাজের অবহেতি মানুষের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একটা বড় সময় এসব মানুষের কথা, তাদের খাবারের কথা, লেখাপড়ার কথা ইত্যাদি বিষয়ে বাবা প্রত্যক্ষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতেন। নিজের অজান্তেই চোখের নোলাজল সাগরের উত্তাল জলরাশিতে মিশে একাকার হয়ে যায়। হঠাৎ একটা ধাক্কা অনুভব করেন। মেডাম চলে এসেছি, সহযোগিদের ডাকে নিজেকে সামলে নেন।
শহিদ মিনারে শিশুদের সঙ্গে প্রেমা
হাজারো কষ্টকে নিজের মনে সযত্নে স্থান দিয়ে এক সফল সমাজ সেবী তিনি। একাধারে সংগঠক, সমাজসেবক এবং মানুষকে সামনের দিকে টেনে নেবার দুরন্ত সাহসের মন্ত্রে দীক্ষিত জেসমিন প্রেমা। এবারে স্মৃতির গলি পথে হারান তিনি। বলেন জানো তখন আমি কলেজ পড়ুয়া। দেখতাম মা যখন রান্না করতেন, তখন পরিবারের সদস্যদের বাইরে একাধিক ব্যক্তি খেতে পারেন, এমন রান্না করে রাখতেন। অনেক পরে জানতে পারলাম মা বাড়ির কাজের মানুষ বা কোন অসহায় মানুষ এসে খাবার চাইলে তাদের খাওয়াতেন বলেই বাড়তি রান্না।
মূলত পরিবার থেকেই সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে। যার গোটাই মা-বাবার অনুপ্রেরণা। মানুষের প্রতি প্রেমার দরদ দেখে সহযোগী বন্ধুবান্ধরাও অনেক ক্ষেত্রে কিছু করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে কাজ করার জন্য প্রয়োজন সংগঠন। এক্ষেত্রে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ার পক্ষেই মন সায় দেয় তার। সেই ভাবনা থেকেই সংগঠন গড়ে তোলা।
বেড়িবাঁধ নির্মাণে ব্যস্ত নারী শ্রমিক
সময়টা ১৯৯৫ সাল। নারী-শিশুদের নিয়ে কাজ করা আজকের সফল স্কাস তথা সমাজ কল্যাণ উন্নয়ন সংস্থার গোড়া পত্তন। প্রেমার হাত ধরে আজকের মাথা উচু করে দাঁড়ানো স্কাসের অবস্থান ঈর্শনীয়। বিভিন্ন সময়ে নারীদের ক্ষমতায়ন, অধিকার ও নানা ক্ষেত্রে চড়াই-উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। সেই ইতিহাস ধারণ করেই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ইতিহাস থেকেই নারীদের নানা বিষয় তুলে এনে তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন।
মানবসেবার ক্ষেত্রে মাদার তেরেসা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া তার জীবনে অনুকরনীয়। একজন জীবন সংগ্রামী নারীর নাম জেসমিন প্রেমা। জীবনভর কঠোর সংগ্রামী এবং প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করা হার না মানা এক নারী। তিনি কখনও নিজেকে অবলা ভাবেন না। সেবা মূলক কাজ করছেন এবং এ ক্ষেত্রে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। একাধারে সংগঠক, সমাজসেবী এবং সাংস্কৃতি পরিমন্ডলের বাসিন্দা প্রেমা সফলতার সিঁড়ি বেয়ে দীপ্ত পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার ইতিহান রচনা করেছেন।
মানব ইতিহাস বলছে, বিংশ শতাব্দীতে সমাজে বিধিনিষেধ শিথিল হতে থাকে এবং নারীরা প্রথাগত গৃহকর্মের বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠায় উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান। যদিও নারীর প্রতি সহিংসতার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। আর এই কাজটি প্রাথমিকভাবে পুরুষরাই করে থাকে। তা সে পরিবারেই হোক বা সম্প্রদায়ের মধ্যেই হোক। আমাদের এই হিমন্যতা দেওয়াল ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে হবে। নারী তার নিজস্ব যোগ্যতার যুদ্ধের ময়দান থেকে সাগরের তলা অব্দি অবদান রেখে চলেছে, বলেন প্রেমা।
সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের লেখাপড়ার বিষয়টি নিশ্চিতে স্কাসের এডুকেশন প্রকল্প রয়েছে। সঙ্গে জুড়ে আছে নারী-শিশুদের অন্যান্য সেবাও। প্রেমা বলেন, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস ছাড়াও যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারী-শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যূতির ঘটনা বাড়ছে। তার মতে একটা দুর্যোগ যখন আঘাত হানে, তখন তার সঙ্গে নানা রকমের সমস্যা নিয়েই আসে। যা কি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাতা উচু করে দাঁড়ায়। তখনই নানা সমস্যাও দেখা দেয়। আঞ্চলিকভাবে আশ্রয়হীন মানুষের খাবার, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার যোগানে স্কাস দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
একটু ভেবে নিয়ে প্রেমা বলেন, জানোতো মনুষ সৃষ্ট দুর্যোগেও বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যূত হচ্ছে। এই যেমন ধরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। অপ্রত্যাশিত ভাবে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রদানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। আজ তারা মাথা ঘোজার ঠাঁই পেয়েছে। স্কাস রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। লেখাপড়া পাশাপাশি খাদ্য দেওয়া হচ্ছে।
সমাজ সেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভুষিত হয়েছেন জেসমিন প্রেমা। বলেন, কাজ করে যাচ্ছি। পুরষ্কার মিলবে কিনা তেমন আশা কখনও করিনি। বাবা বলতেন মুক্ত মনে কাজ করে যাবে। মূল্যায়ন হবেই। সেই পথ ধরেই এগুচ্ছি। যারা দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
কর্মের মধ্যমে একটা দৃষ্টান্ত রাখতে চান প্রেমা। মানবিকগুণের আবেদনটিকে মানবসেবার মধ্যামে নিবেদিত করেছেন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর কল্যাণে, কাজ করছেন নিভৃতে। তাই বহুমাত্রিক অভিধাটি তার জন্যই মানায়। এ কারণেই আজকের আলোকিত নারী তিনি। নিজেকে শুধু আপন বলয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার দেয়ালে বন্দী না রেখে সমর্পিত হয়েছেন বহুজনের মাঝে শুভ, সুন্দর, কল্যাণের মঙ্গলালোকে। তিনি আমাদের সমাজের শুভবোধের সারথী।