face of humanity : ‘মানবতার মুখ’ চলন্ত পথে জীবনের গল্প
- আপডেট সময় : ০৯:৪৬:৫০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর ২০২২ ৫৪৬ বার পড়া হয়েছে
‘তার পাশের আসনটি খালি। কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই ‘বহু দিনের পরিচিত’ বন্ধুর মতই বললেন, বসুন কথা বলি। এরপর কথায় কথায় জীবন ইতিহাস তুলে ধরেন। জীবনের চড়াই-উৎড়াইয়ের গল্প বলতে গিয়ে কখন মুখে ম্লান হাসি, আবার কখনও দু’চোখ ছল ছল। কিডনি পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে তাকে অনেকটা ক্লান্ত মনে হল। অল্প বয়সে এমন গুরুতর অসুস্থতার সময়গুলোতে স্ত্রীই তাকে আগলে রেখেছেন’
আমিনুল হক, ঢাকা
শরতের স্নিগ্ধ সকাল। রেলস্টেশনের গাছের সবুজ পাতায় শিশিরবিন্দু। মোলায়েম সূর্যের আলোয় মুক্তোর মত চিকচিক করছে। বছরের দশম মাসের প্রথমার্ধে যাত্রা। শরৎকাল হলেও আকাশে মেঘের ভেলা উধাও। সকালের বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোদের প্রখরতা বাড়তে থাকে। ঠিক আটটা পনের মিনিটে হুইসেল বাজলো মৈত্রীর। গন্তব্য ঢাকা-কলকাতা। একটি গাড়িতে সাড়ে চারশ’ যাত্রী। একসঙ্গে এতোগুলো মানুষের নিরাপদ যাত্রায় যে মানুষটির অবদান তাকে কুর্নিশ জানাই। ভাবনা শরতের আকাশে পাখনা মেলে।
সময়টা ১৭৮১ সাল। চরম দারিদ্রকে সঙ্গী করে পৃথিবীর আলো দেখা সেই মানুষটিই ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। তার নাম জর্জ স্টিভেনসন। ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ডে তার জন্ম। বাবা ছিলেন কয়লা খনির শ্রমিক। যে বয়সে স্কুল ব্যাগ কাধে নিয়ে শিশুরা স্কুলে যায়, সেই বয়সে জর্জ বাবার সঙ্গে কয়লা খনিতে! এতোটাই দরিদ্র যে টাকার অভাবে লেখাপড়া পর্যন্ত শিখতে পারেননি।
বাবা যে কয়লা খনির সামান্য শ্রমিক। বাবার সঙ্গী হয়ে খনিতে যেতে যেতে সে বয়সেই খনির কাজ বেশ খানিকটা রপ্ত করে ফেলেন। একসময় জর্জের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বাবার কাজটি জর্জ পান। কত বয়স তার, এই দশ কি এগারো। খনি থেকে কয়লা ভর্তি বালতি টেনে তোলতে একটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হতো। কাজের ফাকে ফাকে ইঞ্জিনটির দিকে তাকিয়ে থাকেন জর্জ।
কিশোর মনে ইঞ্জিনটির ছবি তার সে কি আগ্রহ। এমন কিছু তৈরি করতে হলে তাকে লেখাপড়া জানতে হবে। প্রচণ্ড আগ্রহ থেকেই জর্জ নৈশ্য স্কুলে ভর্তি হন। দিনে খনির কাটুনি আর রাতের স্কুল। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড দখল সইতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু আবিষ্কারের নেশায় কঠিন শ্রমও তার কাছে নস্যি। তিনি তো হাল ছাড়ার পাত্র নন। এভাবে কয়েক বছর কেটে যাবার পর সাধারণ লেখাপড়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানের অনেক কিছুই জর্জ স্টিভেনসন শিখে ফেললেন। শিখেন জেমস ওয়াটের বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের খুঁটিনাটিও।
ডা. পার্থ কর্মকারের ডান পাশে আবদুল্লাহ রায়হান এবং বাম পাশে লেখক।
৩৩ বছর বয়সে ১৮১৪ সালে জর্জ স্টিভেনসন তৈরি করলেন একটা ছোটমতো ইঞ্জিনগাড়ি, যা একটা ওয়াগনকে টেনে ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে। এটি কয়লাখনিতে দেখানো সময় অবাক হয়ে লোকে কেবল দেখলই না, এরকম ইঞ্জিন গাড়ি আরও তৈরির জন্য চারদিক থেকে অনুরোধ আসতে লাগল।
স্যার ‘টিফিন’ বলতেই সোজা হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই যমুনা নদী পার হবে ট্রেন। যমুনায় সেতু তৈরি সময় রেলপথ যুক্ত করা হয়নি। এটি অদূরদর্শি ভাবনারই ফসল। পরবর্তীতে সেতুতে রেলপথ সংযোজন করা হয়। ফলে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার ঘন্টা গতিতে ট্রেন চলানো নির্দেশনা রয়েছে। তবে এই সেতুটির অদূরে ‘যমুনা রেলসেতু’ নির্মাণ কাজ দ্রুত এগুচ্ছে। পশ্চিম তীরে পৌছেই ট্রেন গতি পায়।
এবারে চা খেয়ে জানালায় চোখ রাখলাম। দূরন্ত গতিতে ছুটে চলছে জর্জের ট্রেন। লম্বা জার্ণিতে মানুষে মানুষে সখ্যতা বাড়ে, মজবুত হয় সামাজিক বন্ধন। একে অপরের সহযোগিতায় হাত বাড়ায়। এমন যাত্রা মানুষকে আপন করে দেয়। রাস্তার দু’পাশের দিগন্ত জোড়া সবুজ ফসলের মাঠ। তাতে কাজে মগ্ন কৃষক। মনে হচ্ছে মাটির সঙ্গে কথা বলছে। এই মাটি যে মানুষের বড় আপন। ফসল দেয়, মৃত্যুর পর তার বুকেই টেনে নেয়। সবুজ ধানের ডগাগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সবুজ ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে হাল্কা গড়নের একটি মানুষ হাতে লাঠি নিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে আসছে। মেঠো পথে উদাস কণ্ঠে নেচে নেচে গাইছেন সুভাষ দত্ত।
‘ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম
অশান্ত মনে আমি ছুটে গেলাম
আমার গায়ের মত কভু দেখিনি
সে যে আমার জন্মভূমি, এ যে আমার মাতৃভূমি’
আসল মানুষ বদলে গেলেও ছবিটা থেকে যাবে। তাই হয়েছে। কত মানুষই না এই লোকালয়ে হারিয়ে গিয়েছে। আবার কতজনই আপন হয়েছে। মানুষে মানুষে বন্ধন আদিকাল থেকেই। ঐক্যবদ্ধ ছাড়া মানুষ অচল।
ঈশ্বরদীতে পৌছে অনেকটা সময় থামলো মৈত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ইঞ্জিন পরিবর্তন হচ্ছে। ঈশ্বরদী ছাড়তেই ওয়াসরুম থেকে এসে এক পেয়ালা চা খাব বলে ওঠে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখা গেল কয়েকজন দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ কানে আসলো কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট! শব্দটি প্রচণ্ডভাবে কানে বাজলো। মাঝারি গড়নের ভদ্রলোক। কথা বলছেন অনর্গল। কার কিডনি পরিবর্ত হয়েছে ভাই? মুখ ফিরিয়ে তাকালেন এবং শান্ত গলায় বললেন, আমারই ভাই। প্রথম দেখাতেই মনে হল এক ‘মানবতার মুখ’ এর সঙ্গে পরিচয় হলাম।
ফিরে আসলাম আসনে। তার পাশের আসনটি খালি। কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই ‘বহু দিনের পরিচিত’ বন্ধুর মতই বললেন, বসুন কথা বলি। এরপর কথায় কথায় জীবন ইতিহাস তুলে ধরেন। জীবনের চড়াই-উৎড়াইয়ের গল্প বলতে গিয়ে কখন মুখে ম্লান হাসি, আবার কখনও দু’চোখ ছল ছল। কিডনি পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে তাকে অনেকটা ক্লান্ত মনে হল। অল্প বয়সে এমন গুরুতর অসুস্থতার সময়গুলোতে স্ত্রীই তাকে আগলে রেখেছেন।
আলাপকালে নিজের সমস্যার কথা জানালাম তাকে। তিনি অবলিলায় বললেন, ফোরর্টিস হাসপাতা’লে চলুন। সেখানে যে চিকিৎসকের অধিনে আমার চিকিৎসা হয়েছে, ওনাকেই দেখানোর ব্যবস্থা করবো। আর থাকার অসুবিধা হলে আমার ওখানে চলে আসবেন। মুখের তার স্মিত হাসি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কতটা সহজভাবেই না সহায়তার হাত বাড়লেন। প্রচণ্ড শক্তি পেলাম। কলকতা স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি নিলাম। আবদুল্লাহ রায়হান ভাই তার নির্ধারিত স্থানে নেমে যাবার সময় ফের বললেন, দুপুরে চলে আসবেন। ডাক্তার দেখাব। মনে মনে তাকে সেলুট জানালাম।
পরদিন দুপুরেই বিশিষ্ট কিডনি বিষেশজ্ঞ ডাক্তার পার্থ কর্মকার বাবুকে দেখালাম। রায়হানের ভাইয়ের সহযোগিতার আনুষাঙ্গিতা শেষে ডা. পার্থ বাবুর কক্ষের সামনে গিয়ে অপেক্ষার পালা। বড় আকারের হাসপাতাল ফরর্টিস। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের জন্য খ্যাতি রয়েছে এই চিকিৎসালয়টির। কক্ষের সামনে লম্বা লাইন। প্রচণ্ড ব্যস্ত ডা. পার্থ বাবু। কোন রোগীকে কমপক্ষে চল্লিশ মিনিট বা তারও অধিক সময় নিয়ে দেখছেন, একাধিকবার সমস্যার কথা শুনে তারপর পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। তিনি নিজে সন্তুষ্ট না হওয়া অব্দি রোগীকে ছাড়ছেন না। পার্থ বাবুর রোগী দেখার পদ্ধতিকে মনে হলো শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। এক নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হলাম। ‘মানবতার চিকিৎসক’কে নিয়ে পরবর্তী কিস্তিতে সবিস্তারে লেখার ইচ্ছে রয়েছে। চলবে