ঢাকা ০৭:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংবাদ বিশ্লেষণ : বাংলাদেশকে চীনের স্বীকৃতি ও দুদেশের নয়া সম্পর্ক

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ৬৩২ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শ্যামল দত্ত
১৯৫২ সালের ২-১১ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে গণচীন সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে দুনিয়ার যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে এদের তুলনা করা যাবে। নয়াচীনের উন্নতি দেখে সত্যিই আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। দুনিয়ার যে কোনো শক্তির সঙ্গে তারা মোকাবিলা করতে পারবে সকল দিক থেকে’। (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা-১১৮)
চীন সফরের ২৩ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর চীনের মন্তব্য ছিল, ‘এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় এক অভূতপূর্ব সাফল্য সাধিত হয়েছে’। বঙ্গবন্ধু যে দেশের অগ্রগতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন চীনের নতুন যাত্রার- বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেই দেশটির মন্তব্য ছিল এরকম। তার হত্যাকাণ্ড না হওয়া পর্যন্ত চীন বাংলাদেশের অস্তিত্বই স্বীকার করেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ১৬ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট খুনি মোশতাক সরকারের পাকিস্তানি ভাবধারার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় চীন। চীন শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত নয়, বাংলাদেশ যাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হতে না পারে, তার জন্য উপর্যুপরি ভেটো ক্ষমতাও প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত- এই ৩ বছর ৮ মাস ১৫ দিন-পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে ৩ বার। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে একটি সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাও সেতুং আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা একটি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় আনলেও আরেকটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে মেনে নেয়নি সমাজতান্ত্রিক চীন। বরং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ‘একটি ছোট জনগোষ্ঠীর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড’ বলে মন্তব্য করেছিল। পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে চীন। পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে অস্ত্র সরবরাহে বিরত থাকার আহ্বান জানালেও এই দুই পাকিস্তানি মিত্র বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের হত্যাকারী সামরিক জান্তাকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের বুকের পাঁজর ঝাঁঝরা হয়েছে চাইনিজ রাইফেলের গুলিতে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ১৬ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট খুনি মোশতাক সরকারের পাকিস্তানি ভাবধারার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় চীন। চীন শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত নয়, বাংলাদেশ যাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হতে না পারে, তার জন্য উপর্যুপরি ভেটো ক্ষমতাও প্রয়োগ করেছে।
সেই চীন আজ বাংলাদেশের অগ্রগতির সহযাত্রী, উন্নয়নের অংশীদার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেনের ভাষায় ‘অর্থনৈতিক সম্পর্কের পার্টনার’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলতে কিছু নেই। কিন্তু এটাও অমোঘ সত্য যে, ইতিহাসের বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে রাজনীতির সত্যিকারের ইতিহাস রচিত হয় না। পরীক্ষিত বন্ধু বা চিহ্নিত শত্রু, কার কখন কী ভূমিকা- তা নির্ধারিত হয় সংকটের মুহূর্তে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি দুঃসময়- যখন বাঙালি জানতে পেরেছে- কে তার শত্রু- কে তার মিত্র। যিনি সংকটে আপনার পক্ষে দাঁড়াননি, তিনি সুসময়ে আপনার বন্ধু সাজলেও বিপদে তিনি আবার স্বরূপে আবির্ভূত হবেন- এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতিহাসে এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধ এমন এক সুসময়- যখন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি স্লোগান, একটি স্বপ্ন ও একজন স্বপ্নদ্রষ্টার নামের পেছনে। সেই স্বপ্নের নাম বাংলাদেশ, সেই স্লোগানের নাম জয়বাংলা এবং সেই স্বপ্নদ্রষ্টার নামটি হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষ হাসতে হাসতে জীবন দিতে দ্বিধা করেনি এই নামটির জন্য। তাই অনেকেই বলেন, বাঙালির জীবনের এমন দুঃসময় যেমন আসেনি, তেমনি এমন সুসময়ও বোধ হয় আর কখনো আসবে না।

কিন্তু রাজনীতির এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে চীনপন্থি বলে পরিচিত একটি পক্ষের ১৯৭১ পূর্ববর্তী সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত- বিভিন্ন বিশ্লেষণে তাদের হটকারী রাজনীতির নানা চেহারাই ফুটে উঠেছে। এই বিভ্রান্ত রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনকে ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াই হিসেবে অবহিত করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চীনপন্থিরা হানাদার বাহিনী পাকিস্তানিদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, এমনকি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করে চীনপন্থি কিছু দল ‘পূর্ব পাকিস্তানকে’ শেখ মুজিবের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে অস্ত্র ও অর্থ চেয়ে চিঠিও পাঠিয়েছিল। স্ট্যানলি ওলপাটের লেখা ভুট্টোর আত্মজীবনীমূলক বই ‘জুলফি ভুট্টোতে’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সর্বহারা পার্টির পক্ষে আবদুল হকের লেখা সেই চিঠিও সংযুক্ত করা আছে। দেখা গেছে, এই চীনপন্থি রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন অংশ নিজেদের সাচ্চা কমিউনিস্ট রাজনীতির অনুসারী বললেও ব্যক্তিগত স্বার্থে পরবর্তী রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় কখনো সামরিক স্বৈরাচার, কখনো গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি, এমনকি ধর্মভিত্তিক নানা রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে দ্বিধা করেনি। অথচ এই রাজনৈতিক আবেগে হারিয়ে গেছে বহু তারুণ্য, বহু পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। তাত্ত্বিকরা এসবকে বলেন, ‘কোলেটারেল ভিকটিম’। ভারতে চারু মজুমদারের রাজনীতি কিংবা বাংলাদেশে সর্বহারা পার্টির নামে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে দীক্ষিত সাধারণ কর্মীরা জীবন দিলেও নেতারা সামরিক স্বৈরাচার জিয়া-এরশাদ-খালেদার মন্ত্রী হয়ে ক্ষমতার লোভ-লালসায় লিপ্ত থাকার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল না।

অন্যদিকে এসব চীনপন্থি দলের মাস্টার মাইন্ড কমিউনিস্ট চীন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ব্যর্থ হওয়ার পরও একের পর এক ভেটো দিয়ে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্বপরিমণ্ডলে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ বাংলাদেশের জন্য ছিল অত্যন্ত জরুরি।

জাতিসংঘের সদস্য পদ পাওয়ার জন্য জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট। ২৫ আগস্ট বাংলাদেশের সদস্য পদ পাওয়ার আবেদন নিরাপত্তা পরিষদের সভায় উত্থাপিত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১টি সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়। ৩টি রাষ্ট্র এই সভায় কৌশলগত অনুপস্থিত থাকে। একমাত্র রাষ্ট্র চীন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগটিকে ভেস্তে দেয়। জাতিসংঘে তৎকালীন চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান এবং পাকিস্তানের প্রতি গভীর বন্ধুত্ব অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেন।

শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভে সমর্থ হয়। নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। পরের সপ্তাহে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেন।

ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১২ এপ্রিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চৌ এন লাই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে লেখা এক বার্তায় পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষায় চীনের সমর্থন অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেন। রেডিও পাকিস্তানে ১৩ এপ্রিল ফলাও করে প্রচার করা হয় চীনের এই সমর্থনের খবর। চীনের সমর্থনের খবরে উৎফুল্ল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আরো নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে বাংলার মাটিতে। পরবর্তীকালে আমরা দেখি, আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক চীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বরতাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। চীনের মূল্যায়ন, এই মুক্তিযুদ্ধ সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের সম্প্রসারণবাদের একটি নজির। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারত যদি সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে চীনও বসে থাকবে না- এমন হুমকি দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চীন সীমান্তে ৪০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে চীনকে ঠেকিয়ে দেয় রাশিয়া। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি তার ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে লিখেছেন- ১২ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তাকে জানানো হয়, ‘ইয়েলো ফ্রম দ্য নর্থ এন্ড হোয়াইটস ফ্রম দ্য সাউথ’ আসছে। নিয়াজির ভাষায় এর অর্থ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের উত্তর দিক থেকে চীন এবং দক্ষিণ দিক থেকে আমেরিকান সাহায্য আসছে। নিয়াজি যেন যে কোনোভাবে ৩৬ ঘণ্টা ঢাকার পতন ঠেকিয়ে রাখেন (পৃষ্ঠা : ২২৬)। পাকিস্তানিদের সহায়তায় মার্কিন সপ্তম নৌবহর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পৌঁছেছিল। কিন্তু পাল্টা সোভিয়েত জাহাজ উপস্থিত হওয়ায় তা আর অগ্রসর হতে সাহস পায়নি।

অন্যদিকে ডিসেম্বরের শীতে হিমালয়ের পাহাড় ডিঙিয়ে রাশিয়ার হুমকি উপেক্ষা করে উত্তর থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার সাহস চীন দেখায়নি। মার্কিন-চীন দুই পরাশক্তির সরাসরি বিরোধিতা সত্ত্বেও এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পতন হয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার। বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতাকারী সেই চীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে না পারায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অপেক্ষা করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে পটপরিবর্তন পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি পুনরায় ক্ষমতায় আসার ১৬ দিন পর ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় চীন। তার আগ পর্যন্ত নয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এগোতে থাকে দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের নীতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে দ্রুত। ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। খন্দকার মোশতাকের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে চীন সফরে যান। চীন বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের জন্য জিয়াউর রহমানের ভূমিকার প্রশংসা করে। জেনারেল জিয়া প্রকাশ্যে এ চীন নীতি সমর্থন করেন, অন্যদিকে চীন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা একটি অন্যতম সাফল্য হিসেবে অবহিত করে। জিয়ার ফিরতি সফর হিসেবে ১৯৭৮ সালের মার্চে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লি হেসিয়েন বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তাইওয়ান প্রশ্নে চীনকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ-চীন একটি সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী শাসনামলের কয়েক দশক সেই নীতির আলোকেই চলছে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক।

খন্দকার মোশতাকের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে চীন সফরে যান। চীন বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের জন্য জিয়াউর রহমানের ভূমিকার প্রশংসা করে।

সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের নতুন ভূমিকা এখন নতুন করে আলোচনার বিষয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক সম্প্রতি তার এক লেখায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘চীন এক ঘুমন্ত দৈত্য, একে ঘুমাতে দাও। এ জাগ্রত হলে সারাবিশ^কে তছনছ করে দেবে’। নেপোলিয়ান নস্ট্রাডামাসের মতে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা না হলেও তার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। চীনের এ আগ্রাসী ভূমিকা এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাপিয়ে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপসহ অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ১৯৫০ সালে তিব্বত দখলের মধ্য দিয়ে এই তছনছ প্রক্রিয়া শুরু। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে চীন লাদাখের কিছু এলাকাসহ আকসাই চীন দখলে নেয়। এখন গালোয়ান নিয়ে চীন-ভারত বিরোধ তুঙ্গে। ভুটানের একটি বড় অংশের ভূমির অংশীদারত্ব দাবি করছে চীন। অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চীন জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, পাকিস্তানে গাদওয়ার বন্দরের ঘটনা এখন সবার জানা। আফ্রিকার জিবুতিতে অর্থনৈতিক প্রকল্প রক্ষায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বহুল আলোচিত বিষয়। বিশ্বজুড়ে এখন চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেখা যায় মাত্র ৩টি। এই তিন দেশ হচ্ছে- উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান ও মিয়ানমার। চীন উইঘুর মুসলিম নির্যাতন করলেও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে মুসলিম বিশ্ব এ বিষয়ে নিশ্চুপ। ইকোনমিক সুপারপাওয়ার হিসেবে তার প্রভাব বিশ্বে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে। নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ স্ট্যাডিজের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি লিখেছেন, হিমালয় থেকে হংকং, তিব্বত থেকে পূর্ব চীন সাগর- সবখানেই দেশটি এত আগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে মনে হচ্ছে, মাও সেতুং যেখানে এ আগ্রাসনের সমাপ্তি টেনেছিলেন- সেখান থেকে শি জিনপিং শুরু করেছেন। ব্রহ্ম চেলানি আরো লিখেছেন, মাও জিনজিয়াং ও তিব্বতসহ আরো কিছু এলাকা দখল করে দেশের ভূখণ্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ বানিয়েছিলেন। চীন এখন বিশ্বের চতুর্থ বড় দেশ। তিব্বত দখলের পর ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে চীনের সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। মাও তিব্বতকে চীনের ডান হাতের তালু মনে করতেন। আর সেই ডান হাতটির পাঁচটি আঙুল হিসেবে ভাবতেন নেপাল, ভুটান, ভারতের লাদাখ, সিকিম ও অরুণাচলকে। চীন এখন সেই পাঁচ আঙুল গুটিয়ে নেয়ার কাজে হাত দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এর মধ্যে দোকলাম দখলের পর ভুটানের ১১ শতাংশ জমিও চীন নিজেদের বলে দাবি করে। ইতোমধ্যে রাজনৈতিকভাবে নেপাল দখল করে চীন। ভারতের সঙ্গেও প্রায় যুদ্ধাবস্থা।

অন্যদিকে চীনকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া অস্বস্তি নতুন মাত্রা পেয়েছে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করার বিষয়ে। কোভিড নিয়ে বিশ্বকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে এমন অভিযোগ সর্বত্র। এ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় চীনবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধের পাশাপাশি ব্রিটেনে হুয়াউয়েসহ বিভিন্ন চীনা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে চীনের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বিরোধী লেবার দলের এমপি শাওকেত মোসেলমেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও ব্রায়েনের মতে শি জিনপিং নিজেকে জোসেফ স্টালিনের উত্তরাধিকারী মনে করেন। অনেকে শি জিনপিংকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে- ‘শিটলার’ নামে ডাকেন। ব্রহ্ম চেলানির মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে চীনের ভূমিকা এতটা আগ্রাসী যে, কোনো দেশই আর চীনকে নিরাপদ মনে করছে না।

শি জিনপিং বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে হাজার বছরের পুরনো সিল্ক রুট পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির এই দেশটি এখন টাকার ঝুলি নিয়ে বিভিন্ন দেশে নানা প্রকল্প নিয়ে প্রবেশ করছে। অর্থনীতির সহযোগিতার কথা বলে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কব্জায় নেয়ার চেষ্টা করছে। এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ চীনের এই ফাঁদে পা দিয়ে এখন হাপিত্যেশ করছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিজেদের গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প ও তেল-গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের জন্য ১২ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে জাতিগত সংঘাতে ইন্ধন দিয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের বিভিন্ন উদ্যোগে পুরনো সেই ভেটো অস্ত্র প্রয়োগ করে চীন নিজেদের পুরনো অবস্থানকে তুলে ধরেছে। এসব কাজে তার নতুন মিত্র হচ্ছে মিয়ানমারে অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করছে চীনের ইন্ধনে পরিচালিত মিয়ানমারের সেনা অভিযানে। এই সংকটের সমাধানে চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতার অঙ্গীকার করলেও কার্যত কোনো ভূমিকাই রাখছে না। অন্যদিকে, ১২ লাখ শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া এই সংকট গভীর থেকে আরো গভীরতর হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গেও বিগত এক দশকে চীনের সম্পর্কে নতুন এক মাত্রা তৈরি হয়েছে। এক সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল চীন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেয় চীন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম অভিনন্দন জানায় চীন। ২০১৬ সালের ১৪ থেকে ১৬ অক্টোবরে শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরের সময় বিভিন্ন প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এ সময় চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু এই কৌশলগত অংশীদারত্ব বলতে কি বোঝাতে চেয়েছে তা স্পষ্ট করেনি চীন।

শ্যামল দত্ত, সম্পাদক, দৈনিক ভোরের কাগজ।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন আছে। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক সহায়তাকে পৃথিবীতে অনেক অর্থনীতিবিদ ঋণের ফাঁদ হিসেবে বর্ণনা করেন। বিশ্বজুড়ে এর অনেক উদাহরণও আছে। তাই ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করাটাই অনেকের পরামর্শ। তাদের মতে, অর্থনীতির বিষয়টি রাজনীতির বাইরের কোনো বিষয় নয়। আর এর সঙ্গে দুর্নীতি যদি যুক্ত হয় সেটা একটা নতুন মাত্রা পায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চারলেন প্রকল্প নিয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগ সচিব নজরুল ইসলামকে ঘুষ দিয়ে ধরা পড়েছে চীনা এক কোম্পানি চায়না হারবার এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। একই কোম্পানি বেগম জিয়ার প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ২০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিল। আরাফাত রহমান কোকোর সিঙ্গাপুরের জাস্ক করপোরেশনের অ্যাকাউন্টে এই টাকা জমা হয়েছিল। এই মামলাটি এখনো দুদকে বিচারাধীন আছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ ধরনের দুর্নীতিবাজ চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে এখনো কাজ করছে। বিভিন্ন দেশের অভিযোগ, চীনারা ঘুষ দিয়ে কাজ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে। অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চীনা প্রকল্পের মান নিয়েও নানা নেতিবাচক বিশ্লেষণ রয়েছে।

এদিকে নতুন এক বিতর্ক উঠেছে, গত ১৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে চীনা দূতাবাসের উপহার পাঠানো নিয়ে। চীন যে কারো জন্মদিনে উপহার পাঠাতে পারে, কিন্তু ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জাতি যখন শোকে মুহ্যমান, তখন একটি বিতর্কিত জন্মদিন উদযাপনের জন্য উপহার পাঠানোর মধ্য দিয়ে চীন কী বার্তা তুলে ধরল। কোনো মানুষ যদি তখন স্মরণে আনে, এই আগস্ট মাসে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত চীন তো বাংলাদেশের স্বীকৃতিই দেয়নি। সেই ভাবনা তো আর অসত্য নয়। অথচ বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক মিত্র চীন ১৫ আগস্ট শোকের সময়ে জন্মদিন উদযাপনে উপহার পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ তো করল না।

২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরের সময় রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে একটি চীনা প্রবাদ বলেছিলেন। প্রবাদটি হচ্চে, ‘সম্পর্কে যদি আন্তরিকতা না থাকে সেই সম্পর্ক টিকে থাকে না’। চীনের ক্ষেত্রে এই প্রবাদটি প্রযোজ্য কিনা- তা পাঠকরাই ভালো বলতে পারবেন।
সৌজন্যে ভোরের কাগজ : আগস্ট ৩০, ২০২০

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

সংবাদ বিশ্লেষণ : বাংলাদেশকে চীনের স্বীকৃতি ও দুদেশের নয়া সম্পর্ক

আপডেট সময় : ০২:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

শ্যামল দত্ত
১৯৫২ সালের ২-১১ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে গণচীন সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে দুনিয়ার যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে এদের তুলনা করা যাবে। নয়াচীনের উন্নতি দেখে সত্যিই আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। দুনিয়ার যে কোনো শক্তির সঙ্গে তারা মোকাবিলা করতে পারবে সকল দিক থেকে’। (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা-১১৮)
চীন সফরের ২৩ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর চীনের মন্তব্য ছিল, ‘এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় এক অভূতপূর্ব সাফল্য সাধিত হয়েছে’। বঙ্গবন্ধু যে দেশের অগ্রগতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন চীনের নতুন যাত্রার- বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেই দেশটির মন্তব্য ছিল এরকম। তার হত্যাকাণ্ড না হওয়া পর্যন্ত চীন বাংলাদেশের অস্তিত্বই স্বীকার করেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ১৬ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট খুনি মোশতাক সরকারের পাকিস্তানি ভাবধারার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় চীন। চীন শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত নয়, বাংলাদেশ যাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হতে না পারে, তার জন্য উপর্যুপরি ভেটো ক্ষমতাও প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত- এই ৩ বছর ৮ মাস ১৫ দিন-পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে ৩ বার। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে একটি সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাও সেতুং আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা একটি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় আনলেও আরেকটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে মেনে নেয়নি সমাজতান্ত্রিক চীন। বরং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ‘একটি ছোট জনগোষ্ঠীর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড’ বলে মন্তব্য করেছিল। পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে চীন। পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে অস্ত্র সরবরাহে বিরত থাকার আহ্বান জানালেও এই দুই পাকিস্তানি মিত্র বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের হত্যাকারী সামরিক জান্তাকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের বুকের পাঁজর ঝাঁঝরা হয়েছে চাইনিজ রাইফেলের গুলিতে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ১৬ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট খুনি মোশতাক সরকারের পাকিস্তানি ভাবধারার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় চীন। চীন শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত নয়, বাংলাদেশ যাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হতে না পারে, তার জন্য উপর্যুপরি ভেটো ক্ষমতাও প্রয়োগ করেছে।
সেই চীন আজ বাংলাদেশের অগ্রগতির সহযাত্রী, উন্নয়নের অংশীদার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেনের ভাষায় ‘অর্থনৈতিক সম্পর্কের পার্টনার’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলতে কিছু নেই। কিন্তু এটাও অমোঘ সত্য যে, ইতিহাসের বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে রাজনীতির সত্যিকারের ইতিহাস রচিত হয় না। পরীক্ষিত বন্ধু বা চিহ্নিত শত্রু, কার কখন কী ভূমিকা- তা নির্ধারিত হয় সংকটের মুহূর্তে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি দুঃসময়- যখন বাঙালি জানতে পেরেছে- কে তার শত্রু- কে তার মিত্র। যিনি সংকটে আপনার পক্ষে দাঁড়াননি, তিনি সুসময়ে আপনার বন্ধু সাজলেও বিপদে তিনি আবার স্বরূপে আবির্ভূত হবেন- এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতিহাসে এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধ এমন এক সুসময়- যখন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি স্লোগান, একটি স্বপ্ন ও একজন স্বপ্নদ্রষ্টার নামের পেছনে। সেই স্বপ্নের নাম বাংলাদেশ, সেই স্লোগানের নাম জয়বাংলা এবং সেই স্বপ্নদ্রষ্টার নামটি হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষ হাসতে হাসতে জীবন দিতে দ্বিধা করেনি এই নামটির জন্য। তাই অনেকেই বলেন, বাঙালির জীবনের এমন দুঃসময় যেমন আসেনি, তেমনি এমন সুসময়ও বোধ হয় আর কখনো আসবে না।

কিন্তু রাজনীতির এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে চীনপন্থি বলে পরিচিত একটি পক্ষের ১৯৭১ পূর্ববর্তী সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত- বিভিন্ন বিশ্লেষণে তাদের হটকারী রাজনীতির নানা চেহারাই ফুটে উঠেছে। এই বিভ্রান্ত রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনকে ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াই হিসেবে অবহিত করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চীনপন্থিরা হানাদার বাহিনী পাকিস্তানিদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, এমনকি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করে চীনপন্থি কিছু দল ‘পূর্ব পাকিস্তানকে’ শেখ মুজিবের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে অস্ত্র ও অর্থ চেয়ে চিঠিও পাঠিয়েছিল। স্ট্যানলি ওলপাটের লেখা ভুট্টোর আত্মজীবনীমূলক বই ‘জুলফি ভুট্টোতে’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সর্বহারা পার্টির পক্ষে আবদুল হকের লেখা সেই চিঠিও সংযুক্ত করা আছে। দেখা গেছে, এই চীনপন্থি রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন অংশ নিজেদের সাচ্চা কমিউনিস্ট রাজনীতির অনুসারী বললেও ব্যক্তিগত স্বার্থে পরবর্তী রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় কখনো সামরিক স্বৈরাচার, কখনো গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি, এমনকি ধর্মভিত্তিক নানা রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে দ্বিধা করেনি। অথচ এই রাজনৈতিক আবেগে হারিয়ে গেছে বহু তারুণ্য, বহু পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। তাত্ত্বিকরা এসবকে বলেন, ‘কোলেটারেল ভিকটিম’। ভারতে চারু মজুমদারের রাজনীতি কিংবা বাংলাদেশে সর্বহারা পার্টির নামে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে দীক্ষিত সাধারণ কর্মীরা জীবন দিলেও নেতারা সামরিক স্বৈরাচার জিয়া-এরশাদ-খালেদার মন্ত্রী হয়ে ক্ষমতার লোভ-লালসায় লিপ্ত থাকার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল না।

অন্যদিকে এসব চীনপন্থি দলের মাস্টার মাইন্ড কমিউনিস্ট চীন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ব্যর্থ হওয়ার পরও একের পর এক ভেটো দিয়ে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্বপরিমণ্ডলে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ বাংলাদেশের জন্য ছিল অত্যন্ত জরুরি।

জাতিসংঘের সদস্য পদ পাওয়ার জন্য জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট। ২৫ আগস্ট বাংলাদেশের সদস্য পদ পাওয়ার আবেদন নিরাপত্তা পরিষদের সভায় উত্থাপিত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১টি সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়। ৩টি রাষ্ট্র এই সভায় কৌশলগত অনুপস্থিত থাকে। একমাত্র রাষ্ট্র চীন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগটিকে ভেস্তে দেয়। জাতিসংঘে তৎকালীন চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান এবং পাকিস্তানের প্রতি গভীর বন্ধুত্ব অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেন।

শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভে সমর্থ হয়। নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। পরের সপ্তাহে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেন।

ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১২ এপ্রিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চৌ এন লাই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে লেখা এক বার্তায় পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষায় চীনের সমর্থন অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেন। রেডিও পাকিস্তানে ১৩ এপ্রিল ফলাও করে প্রচার করা হয় চীনের এই সমর্থনের খবর। চীনের সমর্থনের খবরে উৎফুল্ল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আরো নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে বাংলার মাটিতে। পরবর্তীকালে আমরা দেখি, আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক চীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বরতাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। চীনের মূল্যায়ন, এই মুক্তিযুদ্ধ সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের সম্প্রসারণবাদের একটি নজির। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারত যদি সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে চীনও বসে থাকবে না- এমন হুমকি দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চীন সীমান্তে ৪০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে চীনকে ঠেকিয়ে দেয় রাশিয়া। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি তার ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে লিখেছেন- ১২ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তাকে জানানো হয়, ‘ইয়েলো ফ্রম দ্য নর্থ এন্ড হোয়াইটস ফ্রম দ্য সাউথ’ আসছে। নিয়াজির ভাষায় এর অর্থ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের উত্তর দিক থেকে চীন এবং দক্ষিণ দিক থেকে আমেরিকান সাহায্য আসছে। নিয়াজি যেন যে কোনোভাবে ৩৬ ঘণ্টা ঢাকার পতন ঠেকিয়ে রাখেন (পৃষ্ঠা : ২২৬)। পাকিস্তানিদের সহায়তায় মার্কিন সপ্তম নৌবহর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পৌঁছেছিল। কিন্তু পাল্টা সোভিয়েত জাহাজ উপস্থিত হওয়ায় তা আর অগ্রসর হতে সাহস পায়নি।

অন্যদিকে ডিসেম্বরের শীতে হিমালয়ের পাহাড় ডিঙিয়ে রাশিয়ার হুমকি উপেক্ষা করে উত্তর থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার সাহস চীন দেখায়নি। মার্কিন-চীন দুই পরাশক্তির সরাসরি বিরোধিতা সত্ত্বেও এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পতন হয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার। বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতাকারী সেই চীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে না পারায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অপেক্ষা করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে পটপরিবর্তন পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি পুনরায় ক্ষমতায় আসার ১৬ দিন পর ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় চীন। তার আগ পর্যন্ত নয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এগোতে থাকে দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের নীতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে দ্রুত। ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। খন্দকার মোশতাকের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে চীন সফরে যান। চীন বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের জন্য জিয়াউর রহমানের ভূমিকার প্রশংসা করে। জেনারেল জিয়া প্রকাশ্যে এ চীন নীতি সমর্থন করেন, অন্যদিকে চীন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা একটি অন্যতম সাফল্য হিসেবে অবহিত করে। জিয়ার ফিরতি সফর হিসেবে ১৯৭৮ সালের মার্চে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লি হেসিয়েন বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তাইওয়ান প্রশ্নে চীনকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ-চীন একটি সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী শাসনামলের কয়েক দশক সেই নীতির আলোকেই চলছে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক।

খন্দকার মোশতাকের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে চীন সফরে যান। চীন বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের জন্য জিয়াউর রহমানের ভূমিকার প্রশংসা করে।

সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের নতুন ভূমিকা এখন নতুন করে আলোচনার বিষয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক সম্প্রতি তার এক লেখায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘চীন এক ঘুমন্ত দৈত্য, একে ঘুমাতে দাও। এ জাগ্রত হলে সারাবিশ^কে তছনছ করে দেবে’। নেপোলিয়ান নস্ট্রাডামাসের মতে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা না হলেও তার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। চীনের এ আগ্রাসী ভূমিকা এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাপিয়ে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপসহ অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ১৯৫০ সালে তিব্বত দখলের মধ্য দিয়ে এই তছনছ প্রক্রিয়া শুরু। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে চীন লাদাখের কিছু এলাকাসহ আকসাই চীন দখলে নেয়। এখন গালোয়ান নিয়ে চীন-ভারত বিরোধ তুঙ্গে। ভুটানের একটি বড় অংশের ভূমির অংশীদারত্ব দাবি করছে চীন। অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চীন জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, পাকিস্তানে গাদওয়ার বন্দরের ঘটনা এখন সবার জানা। আফ্রিকার জিবুতিতে অর্থনৈতিক প্রকল্প রক্ষায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বহুল আলোচিত বিষয়। বিশ্বজুড়ে এখন চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেখা যায় মাত্র ৩টি। এই তিন দেশ হচ্ছে- উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান ও মিয়ানমার। চীন উইঘুর মুসলিম নির্যাতন করলেও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে মুসলিম বিশ্ব এ বিষয়ে নিশ্চুপ। ইকোনমিক সুপারপাওয়ার হিসেবে তার প্রভাব বিশ্বে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে। নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ স্ট্যাডিজের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি লিখেছেন, হিমালয় থেকে হংকং, তিব্বত থেকে পূর্ব চীন সাগর- সবখানেই দেশটি এত আগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে মনে হচ্ছে, মাও সেতুং যেখানে এ আগ্রাসনের সমাপ্তি টেনেছিলেন- সেখান থেকে শি জিনপিং শুরু করেছেন। ব্রহ্ম চেলানি আরো লিখেছেন, মাও জিনজিয়াং ও তিব্বতসহ আরো কিছু এলাকা দখল করে দেশের ভূখণ্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ বানিয়েছিলেন। চীন এখন বিশ্বের চতুর্থ বড় দেশ। তিব্বত দখলের পর ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে চীনের সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। মাও তিব্বতকে চীনের ডান হাতের তালু মনে করতেন। আর সেই ডান হাতটির পাঁচটি আঙুল হিসেবে ভাবতেন নেপাল, ভুটান, ভারতের লাদাখ, সিকিম ও অরুণাচলকে। চীন এখন সেই পাঁচ আঙুল গুটিয়ে নেয়ার কাজে হাত দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এর মধ্যে দোকলাম দখলের পর ভুটানের ১১ শতাংশ জমিও চীন নিজেদের বলে দাবি করে। ইতোমধ্যে রাজনৈতিকভাবে নেপাল দখল করে চীন। ভারতের সঙ্গেও প্রায় যুদ্ধাবস্থা।

অন্যদিকে চীনকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া অস্বস্তি নতুন মাত্রা পেয়েছে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করার বিষয়ে। কোভিড নিয়ে বিশ্বকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে এমন অভিযোগ সর্বত্র। এ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় চীনবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধের পাশাপাশি ব্রিটেনে হুয়াউয়েসহ বিভিন্ন চীনা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে চীনের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বিরোধী লেবার দলের এমপি শাওকেত মোসেলমেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও ব্রায়েনের মতে শি জিনপিং নিজেকে জোসেফ স্টালিনের উত্তরাধিকারী মনে করেন। অনেকে শি জিনপিংকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে- ‘শিটলার’ নামে ডাকেন। ব্রহ্ম চেলানির মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে চীনের ভূমিকা এতটা আগ্রাসী যে, কোনো দেশই আর চীনকে নিরাপদ মনে করছে না।

শি জিনপিং বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে হাজার বছরের পুরনো সিল্ক রুট পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির এই দেশটি এখন টাকার ঝুলি নিয়ে বিভিন্ন দেশে নানা প্রকল্প নিয়ে প্রবেশ করছে। অর্থনীতির সহযোগিতার কথা বলে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কব্জায় নেয়ার চেষ্টা করছে। এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ চীনের এই ফাঁদে পা দিয়ে এখন হাপিত্যেশ করছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিজেদের গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প ও তেল-গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের জন্য ১২ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে জাতিগত সংঘাতে ইন্ধন দিয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের বিভিন্ন উদ্যোগে পুরনো সেই ভেটো অস্ত্র প্রয়োগ করে চীন নিজেদের পুরনো অবস্থানকে তুলে ধরেছে। এসব কাজে তার নতুন মিত্র হচ্ছে মিয়ানমারে অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করছে চীনের ইন্ধনে পরিচালিত মিয়ানমারের সেনা অভিযানে। এই সংকটের সমাধানে চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতার অঙ্গীকার করলেও কার্যত কোনো ভূমিকাই রাখছে না। অন্যদিকে, ১২ লাখ শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া এই সংকট গভীর থেকে আরো গভীরতর হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গেও বিগত এক দশকে চীনের সম্পর্কে নতুন এক মাত্রা তৈরি হয়েছে। এক সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল চীন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেয় চীন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম অভিনন্দন জানায় চীন। ২০১৬ সালের ১৪ থেকে ১৬ অক্টোবরে শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরের সময় বিভিন্ন প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এ সময় চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু এই কৌশলগত অংশীদারত্ব বলতে কি বোঝাতে চেয়েছে তা স্পষ্ট করেনি চীন।

শ্যামল দত্ত, সম্পাদক, দৈনিক ভোরের কাগজ।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন আছে। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক সহায়তাকে পৃথিবীতে অনেক অর্থনীতিবিদ ঋণের ফাঁদ হিসেবে বর্ণনা করেন। বিশ্বজুড়ে এর অনেক উদাহরণও আছে। তাই ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করাটাই অনেকের পরামর্শ। তাদের মতে, অর্থনীতির বিষয়টি রাজনীতির বাইরের কোনো বিষয় নয়। আর এর সঙ্গে দুর্নীতি যদি যুক্ত হয় সেটা একটা নতুন মাত্রা পায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চারলেন প্রকল্প নিয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগ সচিব নজরুল ইসলামকে ঘুষ দিয়ে ধরা পড়েছে চীনা এক কোম্পানি চায়না হারবার এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। একই কোম্পানি বেগম জিয়ার প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ২০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিল। আরাফাত রহমান কোকোর সিঙ্গাপুরের জাস্ক করপোরেশনের অ্যাকাউন্টে এই টাকা জমা হয়েছিল। এই মামলাটি এখনো দুদকে বিচারাধীন আছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ ধরনের দুর্নীতিবাজ চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে এখনো কাজ করছে। বিভিন্ন দেশের অভিযোগ, চীনারা ঘুষ দিয়ে কাজ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে। অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চীনা প্রকল্পের মান নিয়েও নানা নেতিবাচক বিশ্লেষণ রয়েছে।

এদিকে নতুন এক বিতর্ক উঠেছে, গত ১৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে চীনা দূতাবাসের উপহার পাঠানো নিয়ে। চীন যে কারো জন্মদিনে উপহার পাঠাতে পারে, কিন্তু ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জাতি যখন শোকে মুহ্যমান, তখন একটি বিতর্কিত জন্মদিন উদযাপনের জন্য উপহার পাঠানোর মধ্য দিয়ে চীন কী বার্তা তুলে ধরল। কোনো মানুষ যদি তখন স্মরণে আনে, এই আগস্ট মাসে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত চীন তো বাংলাদেশের স্বীকৃতিই দেয়নি। সেই ভাবনা তো আর অসত্য নয়। অথচ বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক মিত্র চীন ১৫ আগস্ট শোকের সময়ে জন্মদিন উদযাপনে উপহার পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ তো করল না।

২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরের সময় রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে একটি চীনা প্রবাদ বলেছিলেন। প্রবাদটি হচ্চে, ‘সম্পর্কে যদি আন্তরিকতা না থাকে সেই সম্পর্ক টিকে থাকে না’। চীনের ক্ষেত্রে এই প্রবাদটি প্রযোজ্য কিনা- তা পাঠকরাই ভালো বলতে পারবেন।
সৌজন্যে ভোরের কাগজ : আগস্ট ৩০, ২০২০