ড. বিরাজলক্ষী ঘোষ
তাই স্বামীজী শিক্ষাক্রমে শারীরিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, “তোমাদের প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। হে আমার বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও—ইহাই তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের অধিকতর নিকটবর্তী হইবে। শরীর শক্ত হইলে তোমরা গীতা অপেক্ষাকৃত ভাল বুঝিবে।”
কথায় বলে সুস্থ দেহেই সুস্থ মনের বাস। আর সুস্থ-সুন্দর মনই পারে একটা উন্নত জাতির জন্ম দিতে। আবার দেহ-মনে সুস্থ ও উন্নত জাতিই পারে দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির চূড়ায় আরােহণ করাতে। বলা যায় সুস্থ দেহ → সুস্থ মন → উন্নত জাতি → উন্নত দেশ। যে কোন সফলতার জন্য চাই শারীরিক সুস্থতা। এর জন্যেই প্রয়োজন নিয়মিত শরীরচর্চা। কেননা শরীরচর্চাই দৈহিক শক্তি লাভের তথা সবল স্বাস্থ্য লাভের পথ প্রশস্ত করে। কোন বিষয়বস্তু যথাযথ অনুধাবনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সবলতা আবশ্যক। শারীরিক শিক্ষার জ্ঞান ব্যতীত শারীরিক ও মানসিক সবলতা লাভ করা যায় না।
তাই স্বামীজী শিক্ষাক্রমে শারীরিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, “তোমাদের প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। হে আমার বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও—ইহাই তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের অধিকতর নিকটবর্তী হইবে। শরীর শক্ত হইলে তোমরা গীতা অপেক্ষাকৃত ভাল বুঝিবে।”
শরীরচর্চা যেকোনো শারীরিক সক্রিয়তা যা শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের তথা সার্বিক স্বাস্থ্যের উপযুক্ততা বাড়িয়ে তোলে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর কার্যকর অবদান রয়েছে। যেমন পেশির শক্তি বাড়ানো, শারীরিক বলিষ্ঠতা ও সহনশীলতাকে তীক্ষè করা, শরীরের সঠিক ওজন রক্ষা করা তথা শারীরিক ভারসাম্য রক্ষা করা এবং আনন্দ দান করা ইত্যাদি। শরীরচর্চা শরীরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে গতিশীল করে। ফলে সকল প্রকার জড়তা থেকে শরীর সুস্থ ও সবল হয়।
বিজ্ঞানের যুগে নব নব অত্যাধুনিক আবিস্কার মানুষের দৈহিক শ্রমের সুযোগ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে শরীরচর্চার প্রয়োজন অনেক বেশি। কেননা শারীরিক সক্রিয়তা তথা দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ ও গতিশীল রাখতে না পারলে পেশিশক্তি একসময় বিপর্যস্ত হয়ে যায়। ফলে জীবনে নেমে আসে দুঃখ-কষ্টের ঘোর অমানিশা । নিয়মিত শরীরচর্চা শারীরিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করে এবং রোগের সমৃদ্ধি থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে।
শরীরচর্চা দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন হার্ট, লিভার, কিডনি, অগ্ন্যাশয় ও অন্যান্য এন্ডোক্রাইন গ্রন্থিগুলো দেহের হরমো প্রবাহ গতিশীল ও সুষম রেখে রোগ-প্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে হৃদরোগ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস এবং শারীরিক স্থুলতা প্রভৃতি রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখে। এর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি সাধন হয় এবং বিমর্ষতা ও দুশ্চিন্তা থেকেও মানুষকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করে।
বর্তমান বিশ্বে শিশুদের শারীরিক স্থূলতাও একটি বর্ধমান উদ্বেগ। উন্নত দেশে শরীরচর্চার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা চলছে। জীবনে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকতে হলে, জীবনকে সাফল্য মণ্ডিত করতে মানুষকে দৈহিক-মানসিক অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এ পরিশ্রম কেবল সুস্থ দেহ-মনের অধিকারী মানুষের পক্ষেই সম্ভব। সফল জীবনের অধিকারী হতে হলে রবীন্দ্রনাথ যে প্রয়োজনের কথা বলেছেন, তা হলো চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু, সাহস-বিস্তৃত বক্ষপট। ফলে শরীরচর্চার কোনো বিকল্প নেই। নিজেকে সুস্থ, সবল করার মধ্য দিয়ে সমাজ ও দেশের উন্নতিকল্পে শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
শরীরচর্চার উপায় অবলম্বনে মানবমনের সচেতন প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি। কেননা এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কেবল বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন নয় বরং অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিশীলতাও একান্ত প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্যে শরীরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সক্রিয়তা সমান জরুরি। খেলাধুলা, সাঁতার কাটা, দৌড়, সাইকেল চালানো ইত্যাদি নানা উপায়ে শরীরচর্চা করা হয়। উপযুক্ত খেলাধুলা শরীরচর্চার প্রাথমিক সোপান, কেননা খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরের মাংসপেশিগুলো হয়ে ওঠে অধিক সুদৃঢ় ও মজবুত।
শৈশবকাল থেকেই সকলকে মুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত খেলাধুলা ও নানান ধরনের ব্যায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহী করতে হবে এবং স্বাস্থ্য-সচেতন করে তুলতে হবে। শরীরচর্চার অন্যতম আরেকটা উপায় হলো যোগব্যায়াম ও অঙ্গ সঞ্চালনমূলক ব্যয়াম। দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা গতিশীল করে শরীরকে সুস্থ রেখে কর্মোপযোগী করে তােলার লক্ষ্যে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে দ্রাবিড় সাধকরা যোগ-ব্যায়াম উদ্ভাবন করেন।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে যোগব্যায়ামের সাফল্য অনস্বীকার্য। এ যোগব্যায়ামসহ নানা ধরনের খেলাধুলা শরীরচর্চার পক্ষে বিশেষ হিতকর। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে অনিয়মিত ব্যায়াম শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। ফলে নিয়মিত ব্যায়াম এবং পরিমিত ও পর্যাপ্ত খাদ্যগ্রহণের দ্বারাই শরীরকে সুস্থ করে তুলতে হবে। শরীরচর্চাকে প্রকৃত ফলপ্রসূ করতে হলে শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়ােজন। পাশ্চাত্যে শরীরচর্চার বিষয়টি শারীরিক শিক্ষার সাথে একীভূত হয়ে গিয়েছে।
উন্নত সমাজ, উন্নত জীবনের জন্যেই তারা শারীরিক শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সর্বোপরি জাতীয় স্বার্থে তারা শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। চীন, মিশর, গ্রিস, রোমের প্রাচীন সমাজে শারীরিক শিক্ষা মিলিটারি প্রশিক্ষণের একটা অংশ ছিল। অর্থাৎ সামাজিক ও জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনেই তারা শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল, পরবর্তীতে উনিশ শতকে শরীর ও স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
পাশ্চাত্যে শারীরিক শিক্ষা বিস্তারের যে লিখিত বিবৃতি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, ১৫০০ থেকে ১৮০০ খিষ্টাব্দে শারীরিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। এ সচেতনতা নিয়ে যে শারীরিক সুস্থতা তা মনের সুস্থতা দান করে। এ লক্ষ্যে ইউরোপে প্রথম জিমনেসিয়াম স্থাপিত হয় কোপেনহেগেন-এ ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে Per Ling স্টকহোমে শারীরিক শিক্ষার বিষয়টিকে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নীত করেন এবং Otto Spiess এক্ষেত্রে অন্য একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি প্রণীত করেন জার্মানিতে।
এরপর জার্মানি, ডেনমার্ক এবং আমেরিকার পাবলিক স্কুলগুলোতে শারীরিক শিক্ষার বিষয়টি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯০১ সালে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে এটা একটা প্রধান বিষয় হিসেবে চালু হয়। সতেরো শতক থেকে জাপানে শরীরচর্চার বিষয়টি প্রচলিত থাকলেও ১৮৭২ সাল থেকে শারীরিক শিক্ষাকে, আবশ্যিক বিষয়ে পরিণত করা হয়। ১৯১৭ সালের পরে সোভিয়েত রাশিয়ায় এ বিষয়টি স্কুল ও বিশেষ শারীরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। বর্তমানে আমাদের দেশেও এ বিষয়টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাতে বিভিন্ন খেলাধুলার নিয়মাবলির পাশাপাশি স্বাস্থ্য-সচেতনতা সম্পর্কেও শিক্ষা দেয়া হয়। তাছাড়া বিভিন্ন জিমনেসিয়াম ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক আরও কিছু সংগঠনে এবং খেলাধুলাসংক্রান্ত নানা সংগঠনেও এ বিষয়ক শিক্ষা বিস্তৃতি লাভ করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষণ কর্মসূচিতেও সেই কারণে শারীর শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার অন্যতম কারণ হলো হবু শিক্ষকদের মধ্যে একটি সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দান যাতে তারা প্রাথমিক শিক্ষক হবার পর বিদ্যালয়ে উপযুক্ত শরীর শিক্ষার ব্যবস্থা নিতে পারেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেহ মনকে সচেতন রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হুগলী জেলার পূর্শুরা অঞ্চলে ঘোলদিগ্রুই শিক্ষণ মন্দিরে প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শরীর শিক্ষার প্রশিক্ষণ দানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রত্যহ অনুষ্ঠিত হয়। এ জন্য শিক্ষণ মন্দিরের মাঠ টি ব্যবহৃত হয়। এখানে ডি এল এড ও বি এড বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়মিত শারীর শিক্ষা প্রদান করে থাকেন ইন্সট্রাক্টর শ্রী অরুণ দলুই। অতিমারীর সময় কিভাবে শিক্ষার্থী শিক্ষকগণ নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের শারীরিক সক্ষমতা ও সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন সে বিষয়েও তিনি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন ।
লেখক : ড. বিরাজলক্ষী ঘোষ, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক, পরিবেশ সংগঠক এবং সম্পাদক দ্য ওমেন ভয়েস
birajlakshmigsm@gmail.com