ঢাকা ০১:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা ও গ্রিনহাউস ইফেক্ট

রিশাদ আহমেদ
  • আপডেট সময় : ০৫:০২:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুন ২০২১ ২৮৫ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বায়ুদূষণ নতুন কিছু নয়, আমেরিকা-চীন-ব্রাজিল-ভারত তো পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু হঠাত্ করে ঢাকায় এত বাজে গরম কেন—এমন প্রশ্ন মাথায় আসা অস্বাভাবিক নয়। ঢাকা শহরের জলবায়ু ও আবহাওয়া নিয়ে করা বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য দ্রুত কমে আসছে। বিশেষ করে শীতকালে এই পার্থক্য বেশি অনুভূত হচ্ছে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে ঢাকার গড় তাপমাত্রা দেশের অন্য যেকোনো গ্রামীণ এলাকার চেয়ে পৌনে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। তবে রাজশাহী শহরের সঙ্গে গ্রামীণ এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য পৌনে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আশরাফ দেওয়ানের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক ‘ঢাকার স্থানীয় আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ার কৌশল এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা’ শীর্ষক ওই গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় গত বছরের জুনে যুক্তরাজ্যের রয়াল মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির বিজ্ঞান সাময়িকীতে। গবেষণাটির জন্য ১৯৬৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকার তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। শহরের ২৩টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের সঙ্গে ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোর তাপমাত্রার তুলনা টানা হয়।

একইভাবে রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়েছে। ‘গ্লোবাল লিভ-এবিলিটি ইনডেক্স’ অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণই এর মূল কারণ। আর এমন নগরায়ণের কারণে বছর বছর বেড়েছে ঢাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর গবেষণা অনুযায়ী, গত ১৮ বছরে ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা চার থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভাটারা এলাকায়।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। আর মাটির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লেই জনজীবনে ব্যাপক অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। সেখানে চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়া খুবই আশঙ্কাজনক। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই পড়বে।’

ঢাকা শহরের মাটির তাপমাত্রা এত বাড়ার কারণ সম্পর্কে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরে শুধু ঘরবাড়িই থাকবে না, প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষিজমি, সবুজ অঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান ও জলাধার রাখতে হবে। কিন্তু ঢাকা শহরে কৃষিজমি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। জলাধার যা ছিল, তারও বড় একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে। এতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে।

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মাহবুবা মেহরুনের করা গবেষণার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং ল্যাবে উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে করা এই গবেষণায় ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে জলাশয় কমে যাওয়ার একটি সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।

হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ‘বিল্ট আপ এরিয়া’ (ভবনসহ নানা অবকাঠামো তৈরি) বৃদ্ধি, জলাভূমি কমা, ঘনবসতিসহ নানা বিষয় জড়িত। তবে সবচেয়ে বেশি দায়ী জলাভূমি কমে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘মানবদেহের কিডনির মতো জলাভূমি একটি শহরের কিডনি হিসেবে কাজ করে। শহরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমাতেও এটি ভূমিকা রাখে। ঢাকা শহরের জলাভূমির বেশির ভাগই এখন ভরাট করা হয়েছে।’ মাহবুবা মেহরুনের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে ঢাকা শহরের মোট ভূমির ১১.২৮ শতাংশ ছিল জলাভূমি, আর বিল্ট আপ এরিয়া ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে জলাভূমি কমে হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ, আর বিল্ট আপ এরিয়া বেড়ে হয়েছে ৩৮.২৬ শতাংশ।
গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা শহরে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ৯.৯৬ ও সর্বোচ্চ ২৪.১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই সময়ে ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। আর ২০০০ সালের জানুয়ারিতে মাটির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ১৪.৭১ ও সর্বোচ্চ ২৩.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাপমাত্রা হয় সর্বনিম্ন ১৮.৮০ ও সর্বোচ্চ ২৮.৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপমাত্রা ২১ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। এর কারণ সম্পর্কে গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ঢাকা শহরের নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে হয়নি। বেশির ভাগ এলাকাই গড়ে উঠেছে জলাভূমি ভরাট করে। ভরাটের জন্য বালু ব্যবহার করা হয়েছে। বালু অতিমাত্রায় তাপ শোষণ করে, এ জন্য ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এলাকার ভূমির তাপমাত্রা বেশি। বালু দিয়ে ভরাট করার পর তার ওপর ঘাস লাগালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কিছুটা হলেও কমত।

গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, মাটির তাপমাত্রা বাড়ার কারণে শহরের আবহাওয়াও উষ্ণ হয়। এতে মানুষের স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দেয়, চলাচলে অস্বস্তি বাড়ে। এ ছাড়া গরম থেকে প্রশান্তির জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ে। এতে অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ে। কিন্তু সব ছাড়িয়ে গেছে এবারের গরম—তাপমাত্রা ৩৩, কিন্তু অনুভূত হচ্ছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হিসেবে। অর্থাৎ গ্রীষ্মের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ৮ ডিগ্রি বেশি গরম আপনাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে এই মুহূর্তে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে আমরা নিজেকে একটা চুল্লির ভেতর আবিষ্কার করি। ঘরের ভেতর গনগনে তাপ, ফ্যানের বাতাস যেন লু হাওয়া। অদ্ভুত হচ্ছে এই সিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা দিন-রাত সব সময়ই চলছে। ঠোঁট ফেটে যাওয়া, কিন্তু ঘাম নেই তেমন। স্রেফ মনে হচ্ছে ভেতরে সব জ্বলছে। এই যে অতিরিক্ত গরমে রীতিমতো সিদ্ধ হচ্ছি আমরা, এর পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলো কী?

না, বন ধ্বংস বা গাছপালা লাগানোর অনীহা কিংবা জলাশয় বা নিচু জমি ভরাট করে কংক্রিটের জঞ্জাল তৈরি ইত্যাদি কারণের ব্যাপারে বলছি না আপাতত। এগুলো তো আছেই, চলতেই থাকবে আমরা নিজেদের পুরোপুরি ধ্বংস না করে ফেলা পর্যন্ত। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে আরেকটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলছে আমাদের একেবারে সামনেই, সেটার ব্যাপারে বরাবরের মতোই নিদারুণ উদাসীন আমরা।

বিশ্বখ্যাত ব্লুমবার্গ নিউজে গত ৮ এপ্রিল একটা খবর প্রকাশিত হয় GHGSat Inc-এর বরাত দিয়ে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখা গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর একটা, মিথেন গ্যাসের একটা বিশাল নিঃসরণ চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাত্ ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উত্পন্ন হচ্ছে, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে মিথেন গ্যাসের অন্যতম প্রধান কন্ট্রিবিউটর বানিয়ে দিয়েছে। এখন মিথেন যেহেতু সূর্যের তাপটা পৃথিবীতে ধরে রাখে, ফলে যে স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাসের উৎপত্তি ঘটবে, সেখানে গ্রীষ্মের গরমের সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হবে। সম্ভবত ঠিক সেটাই ঘটছে এখন।

গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী গ্যাস মিথেন। এটি গত দুই দশকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের (যাকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়) চেয়েও ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে বায়ুমণ্ডলের। ঘ্রাণহীন বর্ণহীন এই গ্যাস পৃথিবীতে আসা সূর্যের তাপ ধরে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরো দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মিথেন যেহেতু সূর্যের তাপটা পৃথিবীতে ধরে রাখে, ফলে যে স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাসের উৎপত্তি ঘটবে, সেখানে গ্রীষ্মের গরমের সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হবে। সম্ভবত ঠিক সেটাই ঘটছে এখন।

মন্ট্রিলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান GHGSat Inc-এর প্রেসিডেন্ট স্টিফেন জার্মেইন জানিয়েছেন, গত ১৭ এপ্রিল তাঁদের হুগো স্যাটেলাইট দেখিয়েছে যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশন থেকে প্রতি ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস উত্পন্ন হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে, যা এক লাখ ৯০ হাজার গাড়ির বায়ুদূষণের সমান দূষণ। পৃথিবীর ১২টি মিথেন এমিসন হটস্পটের একটি বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই ছিল, কিন্তু স্রেফ একটা স্থান থেকে এই বিপুল পরিমাণ মিথেন নিঃসরণের উদাহরণ এই মুহূর্তে খুবই বিরল। জিএইচজিস্যাট অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের মিথেন হটস্পট নিয়ে কাজ করছিল, এই প্রথমবারের মতো তারা পিনপয়েন্ট করতে পেরেছে নির্দিষ্ট কোন জায়গা থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে। এখন গ্যাসের নির্গমন এতই শক্তিশালী যে সেটা স্যাটেলাইটে ধরা পড়ার মতো যথেষ্ট এবং মোটামুটি অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চেয়েও এই ক্লাস্টার অনেক বড়।

যদিও স্টিফেন জানিয়েছেন, মাতুয়াইল থেকে নিঃসরণ অনেক বড় একটা মিথেন সোর্স, কিন্তু এর পরও এটা পুরো শহরের ওপরের বায়ুমণ্ডলে এমন দীর্ঘস্থায়ী ও বিশাল মিথেন নিঃসরণ এক্সপ্লেইন করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁরা এই বিশাল মিথেন উত্পত্তির সব উৎস খুঁজে বের করার জন্য মনিটরিং চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৮১ একরের মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশন বা মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে অফিশিয়ালিই প্রতিদিন দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য এনে ফেলা হয়। দুই সিটি করপোরেশনে বাসাবাড়ির ময়লা থেকে শুরু করে সব ধরনের বর্জ্যের আনুমানিক পরিমাণ ছিল ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টন। এটা ২০১৮-১৯ সালের হিসাব।

২০১৯ সালে তত্কালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভুঁইয়া ব্লুমবার্গকে জানান, ১৮১ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার টন বর্জ্য ফেলা হয়। তরল বর্জ্য ও গ্রিনহাউস গ্যাস ব্যবস্থাপনায় এটি জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থ সাহায্য পেয়েছে। তবে সেখানে ঠিক কী পরিমাণ মিথেন গ্যাস তৈরি হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। প্রতিদিন সাত হাজার টনের ওপরে, এত পরিমাণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত লোকবল বা ব্যবস্থা এবং জায়গা না থাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই বিপুল বর্জ্য কাজে লাগাতে এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যে ৭২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণসহ ভূমি উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর জন্য ৮১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার কার্যক্রমও চূড়ান্ত অবস্থায় ছিল।

জানা গেছে, ডিএসসিসি এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার ২০০ টন বর্জ্য উত্পন্ন হচ্ছে। নতুন করে ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় এর পরিমাণ আরো বেড়েছে। এদিকে বর্জ্য ফেলার স্থান মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলেও পর্যাপ্ত সংকুলান নেই। এ অবস্থায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডিএসসিসি মাতুয়াইলে বড় ধরনের একটি দগ্ধকরণ প্লেস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে পৃথক দুটি ভাগ থাকবে। একটিতে সাধারণ বর্জ্য এবং অন্যটিতে ইলেকট্রনিক বর্জ্য দগ্ধ করা হবে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য পোড়ানোর পর যে নির্যাস থাকবে, তা দিয়ে কয়লাজাতীয় দ্রব্য উত্পাদন করা হবে জ্বালানির কাজে। পাশাপাশি বর্জ্য দগ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় যে তাপ বা শক্তি উত্পন্ন হবে, তা থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে।

তত্কালীন মেয়র সংসদে বাজেট বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণে ভূমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে এবং এই প্রকল্পের আওতায় ল্যান্ডফিলের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এত দিনে সেটা বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ার কথা। আর তাহলে বর্জ্য পোড়ানোর কার্যক্রমও শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন উত্পন্ন হচ্ছে কি না বা এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, এগুলো বিস্তারিত তদন্ত ও নিরীক্ষা খুব জরুরি। কারণ মাতুয়াইল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে জাইকার সহায়তায় অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা থাকলেও কী পরিমাণ মিথেন গ্যাস উত্পন্ন হচ্ছে, সেটার ডাটা রাখা হয় না।

আমাদের পরিবেশমন্ত্রী ব্লুমবার্গকে জানিয়েছেন, মাতুয়াইল থেকে বিপুল পরিমাণে মিথেন নিঃসরণের ব্যাপারে তিনি জেনেছেন এবং এরই মধ্যে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছেন বিস্তারিত জানার জন্য এবং কিভাবে এই মিথেন নিঃসরণ কমানো যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। কমিটির এক মাসের মধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা।

আমাদের দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে যে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ৫০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে গবেষণায় বারবার, যে দেশ দুনিয়ার ১২টি মিথেন গ্যাস নিঃসরণের হটস্পট, যে দেশ শিল্পক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ ইনডেক্সে ১১১টি দেশের মধ্যে ৯৫তম, যেখানে কমপক্ষে টানা তিন সপ্তাহ ধরে স্যাটেলাইট ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন নিঃসরণের বিপর্যয়ের খবর জানাচ্ছে, যে মিথেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও ভয়াবহ, যে খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসছে, টানা তিন সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহেই একবার ফলোআপ করা হচ্ছে, এমনকি সেই পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান নিরলস মনিটরিং চালিয়ে যাবে। কালের কন্ঠের সৌজন্যে

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা ও গ্রিনহাউস ইফেক্ট

আপডেট সময় : ০৫:০২:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুন ২০২১

বায়ুদূষণ নতুন কিছু নয়, আমেরিকা-চীন-ব্রাজিল-ভারত তো পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু হঠাত্ করে ঢাকায় এত বাজে গরম কেন—এমন প্রশ্ন মাথায় আসা অস্বাভাবিক নয়। ঢাকা শহরের জলবায়ু ও আবহাওয়া নিয়ে করা বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য দ্রুত কমে আসছে। বিশেষ করে শীতকালে এই পার্থক্য বেশি অনুভূত হচ্ছে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে ঢাকার গড় তাপমাত্রা দেশের অন্য যেকোনো গ্রামীণ এলাকার চেয়ে পৌনে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। তবে রাজশাহী শহরের সঙ্গে গ্রামীণ এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য পৌনে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আশরাফ দেওয়ানের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক ‘ঢাকার স্থানীয় আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ার কৌশল এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা’ শীর্ষক ওই গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় গত বছরের জুনে যুক্তরাজ্যের রয়াল মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির বিজ্ঞান সাময়িকীতে। গবেষণাটির জন্য ১৯৬৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকার তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। শহরের ২৩টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের সঙ্গে ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোর তাপমাত্রার তুলনা টানা হয়।

একইভাবে রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়েছে। ‘গ্লোবাল লিভ-এবিলিটি ইনডেক্স’ অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণই এর মূল কারণ। আর এমন নগরায়ণের কারণে বছর বছর বেড়েছে ঢাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর গবেষণা অনুযায়ী, গত ১৮ বছরে ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা চার থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভাটারা এলাকায়।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। আর মাটির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লেই জনজীবনে ব্যাপক অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। সেখানে চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়া খুবই আশঙ্কাজনক। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই পড়বে।’

ঢাকা শহরের মাটির তাপমাত্রা এত বাড়ার কারণ সম্পর্কে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরে শুধু ঘরবাড়িই থাকবে না, প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষিজমি, সবুজ অঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান ও জলাধার রাখতে হবে। কিন্তু ঢাকা শহরে কৃষিজমি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। জলাধার যা ছিল, তারও বড় একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে। এতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে।

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মাহবুবা মেহরুনের করা গবেষণার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং ল্যাবে উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে করা এই গবেষণায় ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে জলাশয় কমে যাওয়ার একটি সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।

হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ‘বিল্ট আপ এরিয়া’ (ভবনসহ নানা অবকাঠামো তৈরি) বৃদ্ধি, জলাভূমি কমা, ঘনবসতিসহ নানা বিষয় জড়িত। তবে সবচেয়ে বেশি দায়ী জলাভূমি কমে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘মানবদেহের কিডনির মতো জলাভূমি একটি শহরের কিডনি হিসেবে কাজ করে। শহরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমাতেও এটি ভূমিকা রাখে। ঢাকা শহরের জলাভূমির বেশির ভাগই এখন ভরাট করা হয়েছে।’ মাহবুবা মেহরুনের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে ঢাকা শহরের মোট ভূমির ১১.২৮ শতাংশ ছিল জলাভূমি, আর বিল্ট আপ এরিয়া ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে জলাভূমি কমে হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ, আর বিল্ট আপ এরিয়া বেড়ে হয়েছে ৩৮.২৬ শতাংশ।
গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা শহরে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ৯.৯৬ ও সর্বোচ্চ ২৪.১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই সময়ে ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। আর ২০০০ সালের জানুয়ারিতে মাটির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ১৪.৭১ ও সর্বোচ্চ ২৩.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাপমাত্রা হয় সর্বনিম্ন ১৮.৮০ ও সর্বোচ্চ ২৮.৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপমাত্রা ২১ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। এর কারণ সম্পর্কে গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ঢাকা শহরের নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে হয়নি। বেশির ভাগ এলাকাই গড়ে উঠেছে জলাভূমি ভরাট করে। ভরাটের জন্য বালু ব্যবহার করা হয়েছে। বালু অতিমাত্রায় তাপ শোষণ করে, এ জন্য ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এলাকার ভূমির তাপমাত্রা বেশি। বালু দিয়ে ভরাট করার পর তার ওপর ঘাস লাগালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কিছুটা হলেও কমত।

গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, মাটির তাপমাত্রা বাড়ার কারণে শহরের আবহাওয়াও উষ্ণ হয়। এতে মানুষের স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দেয়, চলাচলে অস্বস্তি বাড়ে। এ ছাড়া গরম থেকে প্রশান্তির জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ে। এতে অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ে। কিন্তু সব ছাড়িয়ে গেছে এবারের গরম—তাপমাত্রা ৩৩, কিন্তু অনুভূত হচ্ছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হিসেবে। অর্থাৎ গ্রীষ্মের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ৮ ডিগ্রি বেশি গরম আপনাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে এই মুহূর্তে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে আমরা নিজেকে একটা চুল্লির ভেতর আবিষ্কার করি। ঘরের ভেতর গনগনে তাপ, ফ্যানের বাতাস যেন লু হাওয়া। অদ্ভুত হচ্ছে এই সিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা দিন-রাত সব সময়ই চলছে। ঠোঁট ফেটে যাওয়া, কিন্তু ঘাম নেই তেমন। স্রেফ মনে হচ্ছে ভেতরে সব জ্বলছে। এই যে অতিরিক্ত গরমে রীতিমতো সিদ্ধ হচ্ছি আমরা, এর পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলো কী?

না, বন ধ্বংস বা গাছপালা লাগানোর অনীহা কিংবা জলাশয় বা নিচু জমি ভরাট করে কংক্রিটের জঞ্জাল তৈরি ইত্যাদি কারণের ব্যাপারে বলছি না আপাতত। এগুলো তো আছেই, চলতেই থাকবে আমরা নিজেদের পুরোপুরি ধ্বংস না করে ফেলা পর্যন্ত। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে আরেকটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলছে আমাদের একেবারে সামনেই, সেটার ব্যাপারে বরাবরের মতোই নিদারুণ উদাসীন আমরা।

বিশ্বখ্যাত ব্লুমবার্গ নিউজে গত ৮ এপ্রিল একটা খবর প্রকাশিত হয় GHGSat Inc-এর বরাত দিয়ে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখা গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর একটা, মিথেন গ্যাসের একটা বিশাল নিঃসরণ চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাত্ ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উত্পন্ন হচ্ছে, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে মিথেন গ্যাসের অন্যতম প্রধান কন্ট্রিবিউটর বানিয়ে দিয়েছে। এখন মিথেন যেহেতু সূর্যের তাপটা পৃথিবীতে ধরে রাখে, ফলে যে স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাসের উৎপত্তি ঘটবে, সেখানে গ্রীষ্মের গরমের সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হবে। সম্ভবত ঠিক সেটাই ঘটছে এখন।

গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী গ্যাস মিথেন। এটি গত দুই দশকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের (যাকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়) চেয়েও ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে বায়ুমণ্ডলের। ঘ্রাণহীন বর্ণহীন এই গ্যাস পৃথিবীতে আসা সূর্যের তাপ ধরে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরো দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মিথেন যেহেতু সূর্যের তাপটা পৃথিবীতে ধরে রাখে, ফলে যে স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাসের উৎপত্তি ঘটবে, সেখানে গ্রীষ্মের গরমের সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হবে। সম্ভবত ঠিক সেটাই ঘটছে এখন।

মন্ট্রিলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান GHGSat Inc-এর প্রেসিডেন্ট স্টিফেন জার্মেইন জানিয়েছেন, গত ১৭ এপ্রিল তাঁদের হুগো স্যাটেলাইট দেখিয়েছে যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশন থেকে প্রতি ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস উত্পন্ন হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে, যা এক লাখ ৯০ হাজার গাড়ির বায়ুদূষণের সমান দূষণ। পৃথিবীর ১২টি মিথেন এমিসন হটস্পটের একটি বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই ছিল, কিন্তু স্রেফ একটা স্থান থেকে এই বিপুল পরিমাণ মিথেন নিঃসরণের উদাহরণ এই মুহূর্তে খুবই বিরল। জিএইচজিস্যাট অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের মিথেন হটস্পট নিয়ে কাজ করছিল, এই প্রথমবারের মতো তারা পিনপয়েন্ট করতে পেরেছে নির্দিষ্ট কোন জায়গা থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে। এখন গ্যাসের নির্গমন এতই শক্তিশালী যে সেটা স্যাটেলাইটে ধরা পড়ার মতো যথেষ্ট এবং মোটামুটি অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চেয়েও এই ক্লাস্টার অনেক বড়।

যদিও স্টিফেন জানিয়েছেন, মাতুয়াইল থেকে নিঃসরণ অনেক বড় একটা মিথেন সোর্স, কিন্তু এর পরও এটা পুরো শহরের ওপরের বায়ুমণ্ডলে এমন দীর্ঘস্থায়ী ও বিশাল মিথেন নিঃসরণ এক্সপ্লেইন করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁরা এই বিশাল মিথেন উত্পত্তির সব উৎস খুঁজে বের করার জন্য মনিটরিং চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৮১ একরের মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশন বা মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে অফিশিয়ালিই প্রতিদিন দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য এনে ফেলা হয়। দুই সিটি করপোরেশনে বাসাবাড়ির ময়লা থেকে শুরু করে সব ধরনের বর্জ্যের আনুমানিক পরিমাণ ছিল ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টন। এটা ২০১৮-১৯ সালের হিসাব।

২০১৯ সালে তত্কালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভুঁইয়া ব্লুমবার্গকে জানান, ১৮১ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার টন বর্জ্য ফেলা হয়। তরল বর্জ্য ও গ্রিনহাউস গ্যাস ব্যবস্থাপনায় এটি জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থ সাহায্য পেয়েছে। তবে সেখানে ঠিক কী পরিমাণ মিথেন গ্যাস তৈরি হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। প্রতিদিন সাত হাজার টনের ওপরে, এত পরিমাণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত লোকবল বা ব্যবস্থা এবং জায়গা না থাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই বিপুল বর্জ্য কাজে লাগাতে এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যে ৭২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণসহ ভূমি উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর জন্য ৮১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার কার্যক্রমও চূড়ান্ত অবস্থায় ছিল।

জানা গেছে, ডিএসসিসি এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার ২০০ টন বর্জ্য উত্পন্ন হচ্ছে। নতুন করে ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় এর পরিমাণ আরো বেড়েছে। এদিকে বর্জ্য ফেলার স্থান মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলেও পর্যাপ্ত সংকুলান নেই। এ অবস্থায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডিএসসিসি মাতুয়াইলে বড় ধরনের একটি দগ্ধকরণ প্লেস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে পৃথক দুটি ভাগ থাকবে। একটিতে সাধারণ বর্জ্য এবং অন্যটিতে ইলেকট্রনিক বর্জ্য দগ্ধ করা হবে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য পোড়ানোর পর যে নির্যাস থাকবে, তা দিয়ে কয়লাজাতীয় দ্রব্য উত্পাদন করা হবে জ্বালানির কাজে। পাশাপাশি বর্জ্য দগ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় যে তাপ বা শক্তি উত্পন্ন হবে, তা থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে।

তত্কালীন মেয়র সংসদে বাজেট বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণে ভূমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে এবং এই প্রকল্পের আওতায় ল্যান্ডফিলের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এত দিনে সেটা বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ার কথা। আর তাহলে বর্জ্য পোড়ানোর কার্যক্রমও শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন উত্পন্ন হচ্ছে কি না বা এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, এগুলো বিস্তারিত তদন্ত ও নিরীক্ষা খুব জরুরি। কারণ মাতুয়াইল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে জাইকার সহায়তায় অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা থাকলেও কী পরিমাণ মিথেন গ্যাস উত্পন্ন হচ্ছে, সেটার ডাটা রাখা হয় না।

আমাদের পরিবেশমন্ত্রী ব্লুমবার্গকে জানিয়েছেন, মাতুয়াইল থেকে বিপুল পরিমাণে মিথেন নিঃসরণের ব্যাপারে তিনি জেনেছেন এবং এরই মধ্যে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছেন বিস্তারিত জানার জন্য এবং কিভাবে এই মিথেন নিঃসরণ কমানো যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। কমিটির এক মাসের মধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা।

আমাদের দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে যে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ৫০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে গবেষণায় বারবার, যে দেশ দুনিয়ার ১২টি মিথেন গ্যাস নিঃসরণের হটস্পট, যে দেশ শিল্পক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ ইনডেক্সে ১১১টি দেশের মধ্যে ৯৫তম, যেখানে কমপক্ষে টানা তিন সপ্তাহ ধরে স্যাটেলাইট ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন নিঃসরণের বিপর্যয়ের খবর জানাচ্ছে, যে মিথেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও ভয়াবহ, যে খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসছে, টানা তিন সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহেই একবার ফলোআপ করা হচ্ছে, এমনকি সেই পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান নিরলস মনিটরিং চালিয়ে যাবে। কালের কন্ঠের সৌজন্যে