ঢাকা ০৯:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোদির বাংলাদেশ সফর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:০১:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১ ৩০২ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

তারেক শামসুর রেহমান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬ মার্চ বাংলাদেশে এসেছেন। ২৭ মার্চ চলে গেছেন। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। মোদির এই সফর একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রমাণ করল বাংলাদেশকে তারা কত গুরুত্ব দেয়। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মোদির যোগদান প্রমাণ করল ভারত বঙ্গবন্ধুকে কোন দৃষ্টিতে দেখে। মোদি এক টুইট বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব ভারতীয় নাগরিকের নায়ক। তিনি একজন বীর।’ তিনি বাংলায় এই টুইট বার্তাটি দিয়েছিলেন। এই বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এটা স্পষ্ট করেছিলেন, ভারতীয়দের মনে বঙ্গবন্ধুর স্থান কোথায়। তৃতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার গুরুত্বও অনেক। নরেন্দ্র মোদি আমাদের জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, জীবনের শুরুর দিকে আন্দোলনগুলোর, অন্যতম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে শামিল হওয়া। তিনি আমাদের আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২০-২২ বছর। তিনি ও তার সঙ্গীরা সত্যাগ্রহ করেছিলেন। জেলেও গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এখানে অর্থাৎ বাংলাদেশে যতটা ইচ্ছা ছিল, ততটাই ছিল ওপারে অর্থাৎ ভারতে- তিনি এমনটাই মন্তব্য করেছেন। মোদি আরও বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি পারস্পরিক বিশ্বাসে সমাধান হতে পারে। জমি হস্তান্তর চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। করোনাকালেও তালমিল রেখে কাজ করেছি। বাংলাদেশে কাজে লাগছে মেড ইন ইন্ডিয়া ভ্যাকসিন।’ এটাই বাস্তবতা। করোনাকালে ভারতীয় টিকা বাংলাদেশে এসেছে, যখন বিশ্বের অনেক দেশ এখনো টিকা পায়নি। মোদির সফরের আগে ভারত থেকে এসেছে একশর ওপরে অ্যাম্বুলেন্স। মোদি তার বক্তৃতায় অনেক বাংলাদেশির নামও উল্লেখ করেছেন।

প্যারেড গ্রাউন্ডে মোদির বক্তৃতা ২০১৫ সালের জুন মাসে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের সালমা, সাকিব, নিশাত আর ওয়াসফিয়াদের প্রশংসা করেছিলেন। তার ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি এটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা চান। মোদির বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘নেইবারহুড ফাস্ট’ পলিসি। অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে তিনি গুরুত্ব দেন। এটা আবারও তিনি প্রমাণ করলেন। করোনার কারণে দীর্ঘ ১৫ মাস তিনি বিদেশ সফরে যাননি। করোনার মধ্যেই তিনি ঢাকায় এলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তার সরকারের বেশকিছু সিদ্ধান্ত খোদ ভারতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী এই ইস্যুতে ‘সুবিধা’ নিতে চাইছে। মুসলমানরা ভারতে নিগৃহীত হচ্ছেন এ ধরনের অভিযোগ থাকলেও এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যেমন আমরা ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস’ (এনআরসি) এবং ‘সিটিজেনস এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ (সিএএ) প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে পারি। এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী একটি দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাই বাংলাদেশ ভারতের ব্যাপারে কথা বলতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি গতকাল গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির ওড়াকান্দির মাতুয়া সম্প্রদায়ের ঠাকুরবাড়ির মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এটা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হলেও পশ্চিমবঙ্গে এটা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

কংগ্রেস সমর্থক জনৈক সাকেত গোখলে ভারতের নির্বাচন কমিশনে এক আর্জিতে মাতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে মোদির ভাষণ সম্প্রসারণ ও প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছেন। তার যুক্তি মোদির ভাষণ পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। ২৭ মার্চ সেখানে প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন শুরু হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মোদির এই ভাষণ ২৯ আসনে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব আসনে মাতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। সাতক্ষীরার একটি মন্দিরেও তিনি যান। মোদি বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব জানেন ও বোঝেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তা ভারত সমাধান করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে একবার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১৭) কিংবা নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর (২০১৫) এবং পরে ভার্চুয়াল বৈঠকেও (২০২০) আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তিস্তার পানিবণ্টনের। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তিস্তাচুক্তি হয়নি। সমস্যাটা ভারতের। এর সমাধান ভারতকেই করতে হবে। এভাবে বারবার যদি আশ্বাস দেওয়া হয় এবং সমস্যার যদি কোনো সমাধান না হয় তা হলে দুদেশের বন্ধুত্বের জন্য তা কোনো ভালো খবর নয়। বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। অথচ ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এ ধরনের হত্যাকা- হয় না।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি এখন সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। এই ঘাটতির পরিমাণ এখন হাজার হাজার কোটি টাকা। ভারতীয় শুল্কনীতির কারণেই বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। সাফটা চুক্তিতে বেশ কয়েকটি পণ্যের ব্যাপারে শুল্ক হ্রাসের কথা বলা হলেও ভারত তা কার্যকর করেনি। ইতোপূর্বে ভারতের পক্ষ থেকে যে ৫১৩টি পণ্যের ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ৩৫০টি পণ্য বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই রপ্তানি করা সম্ভব নয়। ভারত বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কহার না কমালেও বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কহার ধার্য ছিল শতকরা ৩০০ ভাগ। ১৯৯৪-৯৫ সালে তা কমিয়ে আনা হয় ৬০ ভাগে।

এখন শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৫ ভাগে। দুদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধায় জাহাজযোগে ভারতীয় পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। অথচ নেপালে ত্রিদেশীয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভারত এটা করছে দ্বিপাক্ষিকভাবে (ভারত-নেপাল)। শুষ্ক মৌসুমের জন্য বাংলাদেশ (রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত) একটা জলাধার নির্মাণ করতে চায় (গঙ্গা ব্যারাজ), সে ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। গত ১৬ মার্চ (২০২১) নয়াদিল্লিতে সচিব পর্যায়ে একটি সভা হয়েছে।

সেখানে ৬টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে বলে একটি সংবাদপত্র আমাদের জানিয়েছে (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার)। শুধু বলা হয়েছে, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘গুরুত্ব’ দেওয়া কিংবা অন্য ৬টি নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি আলোচনার চেয়ে আমাদের প্রয়োজন তিস্তার পানিবণ্টন। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য বসে থাকতে পারি না। ফলে চীনা অর্থায়নে তিস্তার পানির ব্যবস্থাপনার যে কথা বলা হয়েছে, তা দ্রুত একনেকে পাস করানো জরুরি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে যে গঙ্গার পানিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ এখন থেকে ৬ বছরের মধ্যে। অথচ এই সময়সীমায় মানুষ বেড়েছে, পানির চাহিদা বেড়েছে। তাই গঙ্গার পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে পুনরায় আলোচনা করা প্রয়োজন। হিমালয় অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য চীনকে সংযুক্ত করতে হবে।

একটি বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীন সিন্ধু, সুতলেন, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, সালভিন, হুয়াং হো এবং ইয়াংটমের মতো এশিয়ার বড় নদীগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। চীন তিব্বত মালভূমির বাইরে প্রবাহিত সব বড় নদীর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। তিব্বতের নদীগুলোয় জলবিদ্যুৎ সমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে চীন। এ অঞ্চলে প্রায় ২৮টি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চীন। ব্রহ্মপুত্রের পানিও সরিয়ে নিতে চাচ্ছে চীন। ফলে চীন যদি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তা হলে শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশেও পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এশিয়াটিক সোসাইটির এক গবেষণায় মন্তব্য করা হয়েছে যে, পানি নিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলো এক ধরনের ‘পানিযুদ্ধ’ শুরু করে দিতে পারে আগামী দিনগুলোতে। তাই আঞ্চলিকভাবে একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

গেল বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাসিনা-মোদি যে ভার্চুয়াল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে মোদি স্বীকার করেছিলেন তার নেইবারহুড ফাস্ট পলিসির অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই করোনাকালেও বাংলাদেশ সফর তার সেই ‘কমিটমেন্ট’কে আবার প্রমাণ করল। তিনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে, দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তার সমাধান জরুরি। না হলে বাংলাদেশে অসন্তোষ বাড়বে। আমরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখতে চাই। তার ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এবং বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ দুদেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেল। মোদি নিজে বলেছেন, ‘সম্পর্ক এমনভাবে তৈরি করতে হবে যা

কোনোভাবেই ভাঙবে না। বাংলাদেশ-ভারতকে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে, এমন মন্তব্যও তার। মোদির এই সফরে ৪টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বেশকিছু প্রকল্প তিনি উদ্বোধন করেছেন। সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ দমনে সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূরীকরণ ইত্যাদি। আর প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসমাধি, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক ইত্যাদি। তাই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরনের চুক্তি ও সমঝোতার গুরুত্ব অনেক। আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থে এই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি। আমাদের সময়ের সৌজন্যে

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

মোদির বাংলাদেশ সফর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

আপডেট সময় : ১১:০১:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১

তারেক শামসুর রেহমান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬ মার্চ বাংলাদেশে এসেছেন। ২৭ মার্চ চলে গেছেন। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। মোদির এই সফর একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রমাণ করল বাংলাদেশকে তারা কত গুরুত্ব দেয়। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মোদির যোগদান প্রমাণ করল ভারত বঙ্গবন্ধুকে কোন দৃষ্টিতে দেখে। মোদি এক টুইট বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব ভারতীয় নাগরিকের নায়ক। তিনি একজন বীর।’ তিনি বাংলায় এই টুইট বার্তাটি দিয়েছিলেন। এই বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এটা স্পষ্ট করেছিলেন, ভারতীয়দের মনে বঙ্গবন্ধুর স্থান কোথায়। তৃতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার গুরুত্বও অনেক। নরেন্দ্র মোদি আমাদের জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, জীবনের শুরুর দিকে আন্দোলনগুলোর, অন্যতম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে শামিল হওয়া। তিনি আমাদের আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২০-২২ বছর। তিনি ও তার সঙ্গীরা সত্যাগ্রহ করেছিলেন। জেলেও গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এখানে অর্থাৎ বাংলাদেশে যতটা ইচ্ছা ছিল, ততটাই ছিল ওপারে অর্থাৎ ভারতে- তিনি এমনটাই মন্তব্য করেছেন। মোদি আরও বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি পারস্পরিক বিশ্বাসে সমাধান হতে পারে। জমি হস্তান্তর চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। করোনাকালেও তালমিল রেখে কাজ করেছি। বাংলাদেশে কাজে লাগছে মেড ইন ইন্ডিয়া ভ্যাকসিন।’ এটাই বাস্তবতা। করোনাকালে ভারতীয় টিকা বাংলাদেশে এসেছে, যখন বিশ্বের অনেক দেশ এখনো টিকা পায়নি। মোদির সফরের আগে ভারত থেকে এসেছে একশর ওপরে অ্যাম্বুলেন্স। মোদি তার বক্তৃতায় অনেক বাংলাদেশির নামও উল্লেখ করেছেন।

প্যারেড গ্রাউন্ডে মোদির বক্তৃতা ২০১৫ সালের জুন মাসে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের সালমা, সাকিব, নিশাত আর ওয়াসফিয়াদের প্রশংসা করেছিলেন। তার ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি এটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা চান। মোদির বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘নেইবারহুড ফাস্ট’ পলিসি। অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে তিনি গুরুত্ব দেন। এটা আবারও তিনি প্রমাণ করলেন। করোনার কারণে দীর্ঘ ১৫ মাস তিনি বিদেশ সফরে যাননি। করোনার মধ্যেই তিনি ঢাকায় এলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তার সরকারের বেশকিছু সিদ্ধান্ত খোদ ভারতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী এই ইস্যুতে ‘সুবিধা’ নিতে চাইছে। মুসলমানরা ভারতে নিগৃহীত হচ্ছেন এ ধরনের অভিযোগ থাকলেও এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যেমন আমরা ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস’ (এনআরসি) এবং ‘সিটিজেনস এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ (সিএএ) প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে পারি। এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী একটি দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাই বাংলাদেশ ভারতের ব্যাপারে কথা বলতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি গতকাল গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির ওড়াকান্দির মাতুয়া সম্প্রদায়ের ঠাকুরবাড়ির মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এটা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হলেও পশ্চিমবঙ্গে এটা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

কংগ্রেস সমর্থক জনৈক সাকেত গোখলে ভারতের নির্বাচন কমিশনে এক আর্জিতে মাতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে মোদির ভাষণ সম্প্রসারণ ও প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছেন। তার যুক্তি মোদির ভাষণ পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। ২৭ মার্চ সেখানে প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন শুরু হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মোদির এই ভাষণ ২৯ আসনে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব আসনে মাতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। সাতক্ষীরার একটি মন্দিরেও তিনি যান। মোদি বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব জানেন ও বোঝেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তা ভারত সমাধান করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে একবার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১৭) কিংবা নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর (২০১৫) এবং পরে ভার্চুয়াল বৈঠকেও (২০২০) আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তিস্তার পানিবণ্টনের। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তিস্তাচুক্তি হয়নি। সমস্যাটা ভারতের। এর সমাধান ভারতকেই করতে হবে। এভাবে বারবার যদি আশ্বাস দেওয়া হয় এবং সমস্যার যদি কোনো সমাধান না হয় তা হলে দুদেশের বন্ধুত্বের জন্য তা কোনো ভালো খবর নয়। বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। অথচ ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এ ধরনের হত্যাকা- হয় না।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি এখন সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। এই ঘাটতির পরিমাণ এখন হাজার হাজার কোটি টাকা। ভারতীয় শুল্কনীতির কারণেই বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। সাফটা চুক্তিতে বেশ কয়েকটি পণ্যের ব্যাপারে শুল্ক হ্রাসের কথা বলা হলেও ভারত তা কার্যকর করেনি। ইতোপূর্বে ভারতের পক্ষ থেকে যে ৫১৩টি পণ্যের ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ৩৫০টি পণ্য বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই রপ্তানি করা সম্ভব নয়। ভারত বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কহার না কমালেও বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কহার ধার্য ছিল শতকরা ৩০০ ভাগ। ১৯৯৪-৯৫ সালে তা কমিয়ে আনা হয় ৬০ ভাগে।

এখন শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৫ ভাগে। দুদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধায় জাহাজযোগে ভারতীয় পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। অথচ নেপালে ত্রিদেশীয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভারত এটা করছে দ্বিপাক্ষিকভাবে (ভারত-নেপাল)। শুষ্ক মৌসুমের জন্য বাংলাদেশ (রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত) একটা জলাধার নির্মাণ করতে চায় (গঙ্গা ব্যারাজ), সে ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। গত ১৬ মার্চ (২০২১) নয়াদিল্লিতে সচিব পর্যায়ে একটি সভা হয়েছে।

সেখানে ৬টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে বলে একটি সংবাদপত্র আমাদের জানিয়েছে (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার)। শুধু বলা হয়েছে, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘গুরুত্ব’ দেওয়া কিংবা অন্য ৬টি নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি আলোচনার চেয়ে আমাদের প্রয়োজন তিস্তার পানিবণ্টন। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য বসে থাকতে পারি না। ফলে চীনা অর্থায়নে তিস্তার পানির ব্যবস্থাপনার যে কথা বলা হয়েছে, তা দ্রুত একনেকে পাস করানো জরুরি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে যে গঙ্গার পানিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ এখন থেকে ৬ বছরের মধ্যে। অথচ এই সময়সীমায় মানুষ বেড়েছে, পানির চাহিদা বেড়েছে। তাই গঙ্গার পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে পুনরায় আলোচনা করা প্রয়োজন। হিমালয় অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য চীনকে সংযুক্ত করতে হবে।

একটি বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীন সিন্ধু, সুতলেন, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, সালভিন, হুয়াং হো এবং ইয়াংটমের মতো এশিয়ার বড় নদীগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। চীন তিব্বত মালভূমির বাইরে প্রবাহিত সব বড় নদীর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। তিব্বতের নদীগুলোয় জলবিদ্যুৎ সমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে চীন। এ অঞ্চলে প্রায় ২৮টি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চীন। ব্রহ্মপুত্রের পানিও সরিয়ে নিতে চাচ্ছে চীন। ফলে চীন যদি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তা হলে শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশেও পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এশিয়াটিক সোসাইটির এক গবেষণায় মন্তব্য করা হয়েছে যে, পানি নিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলো এক ধরনের ‘পানিযুদ্ধ’ শুরু করে দিতে পারে আগামী দিনগুলোতে। তাই আঞ্চলিকভাবে একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

গেল বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাসিনা-মোদি যে ভার্চুয়াল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে মোদি স্বীকার করেছিলেন তার নেইবারহুড ফাস্ট পলিসির অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই করোনাকালেও বাংলাদেশ সফর তার সেই ‘কমিটমেন্ট’কে আবার প্রমাণ করল। তিনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে, দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে তার সমাধান জরুরি। না হলে বাংলাদেশে অসন্তোষ বাড়বে। আমরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখতে চাই। তার ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এবং বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ দুদেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেল। মোদি নিজে বলেছেন, ‘সম্পর্ক এমনভাবে তৈরি করতে হবে যা

কোনোভাবেই ভাঙবে না। বাংলাদেশ-ভারতকে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে, এমন মন্তব্যও তার। মোদির এই সফরে ৪টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বেশকিছু প্রকল্প তিনি উদ্বোধন করেছেন। সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ দমনে সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূরীকরণ ইত্যাদি। আর প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসমাধি, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক ইত্যাদি। তাই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরনের চুক্তি ও সমঝোতার গুরুত্ব অনেক। আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থে এই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি। আমাদের সময়ের সৌজন্যে

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক