মন্দির, বৈভব, বাণিজ্য মধ্যযুগের বিশ্বের গতিমুখ বদলে দেয়া চোল আখ্যান

- আপডেট সময় : ০৯:৪৩:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫ ৬৮ বার পড়া হয়েছে

বৃহদীশ্বর মন্দির। এই মন্দিরটি ১১শ শতাব্দীতে চোল সাম্রাজ্যের রাজা রাজারাজা চোল প্রথম নির্মাণ করেন। ২০১৬ সালের ১২ জুলাই এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয়।

চোলরা ভারত মহাসাগরে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যতটা মঙ্গোলরা ছিল মধ্য ইউরেশিয়ায়
লুণ্ঠিত ধন দিয়ে গড়ে ওঠে তার বিশালাকৃতির মন্দির, আজ যা বৃহদীশ্বর মন্দির নামে পরিচিত
চোলদের এই সময়কে বলা যেতে পারে রেনেসাঁর দক্ষিণ ভারতীয় সংস্করণ, অথচ এটি ঘটছিল ইউরোপে রেনেসাঁরও ৩০০ বছর আগে
বৃহদীশ্বর মন্দির। যা কিনা ১১শ শতাব্দীতে চোল সাম্রাজ্যের রাজা রাজারাজা চোল প্রথম নির্মাণ করেন। ২০১৬ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়।
সময়টা ১০০০ খ্রিস্টাব্দ। মধ্যযুগের ইউরোপে তখন বড় ওলটপালট চলছে। আমরা এখন যেগুলোকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে জানি, যেমন নর্ম্যানশাসিত ইংল্যান্ড বা টুকরো টুকরো ভূখণ্ড মিলে পরে যে ফ্রান্স হলো সেগুলোর তখন অস্তিত্বই নেই।
বড় বড় গথিক টাওয়ারগুলো তখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়নি। অনেক দূরে সমৃদ্ধ কনস্টান্টিনোপল বাদ দিলে মহাদেশটিতে তখন হাতে গোনা কয়েকটি নগর।
অথচ সেই বছরই পৃথিবীর আরেক প্রান্তে দক্ষিণ ভারতের এক রাজা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিশালাকৃতির এক মন্দির নির্মাণের। এই রাজাকে ডাকা হতো রাজ-রাজ, রাজাদের রাজা, বাংলায় রাজাধিরাজ বললেই বেশি মানায়। তিনি ছিলেন মধ্যযুগের তাক লাগানো সাম্রাজ্যগুলোর অন্যতম চোল সাম্রাজ্যেও রাজা।
তার পরিবার মন্দির, ধনসম্পদ আর বাণিজ্যের সুবাধে মধ্যযুগের বিশ্বের গতিমুখই বদলে দিয়েছিল, অথচ ভারতের বাইরে এই সাম্রাজ্য এখনও অনেকটাই অচেনা।
ইতিহাসবিদ অনিরুধ কানিসেটির কলমে তারই খানিকটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে বিবিসি। চলুন ঘুরে আসা যাক।
রাজারাজা চোলের সেই মন্দির মাত্র ১০ বছরেই মাথা তুলে দাঁড়ায়। ২১৬ ফুট উঁচু মন্দিরটি বানাতেই লেগেছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টন গ্রানাইট। উচ্চতায় এর ওপরে তখন কেবল মিশরের পিরামিডগুলো। মন্দিরের কেন্দ্রে সোনায় মোড়ানো ১২ ফুট লম্বা হিন্দু দেবতা শিবের মূর্তি, পান্না আর মুক্তো তো অসংখ্য।
বাতি দিয়ে সাজানো বিশাল হলঘরের ভেতর মুক্তো দ্বারা অলংকৃত ৬০টি ব্রোঞ্জের মূর্তি; এই মুক্তো আবার আনা হয়েছে সাম্রাজ্যের দখলে থাকা লঙ্কা দ্বীপ থেকে। কোষাগারে টনকে টন সোনা আর রুপোর মুদ্রা, সঙ্গী নেকলেস, নানাবিধ রত্ন। আরও ছিল ভারতের দক্ষিণ উপদ্বীপের বিজিত রাজাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া শিঙা ও ঢাক। এসবই তাকে পরিণত করেছিল যুগের সবচেয়ে সম্পদশালী সম্রাটে।
চোল সাম্রাজ্য, ১০৩০ সাল।
একাদশ শতকের প্রাক্কালে চোলরা ছিল অন্য ৮-১০টি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর একটি, ক্ষমতার জোর বাড়াতে যারা লড়ছে কাবেরি প্লাবনভূমিতে, পলিবাহিত বিস্তৃর্ণ এক অঞ্চল, এখন যাকে আমরা তামিল নাড়ু হিসেবে চিনি।
কিন্তু চোলদের আলাদা করেছিল তাদের অন্তহীন উদ্ভাবন সক্ষমতা। মধ্যযুগ, সেই সময়েও তাদের রানিরা ছিল বেশ প্রভাবশালী, দায়িত্ব পালন করতেন সাম্রাজ্যের মুখপাত্র হিসেবেও।
তামিল গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে, পুরনো কাদামাটির আশ্রমগুলোতে ঝলমলে পাথর বসিয়ে রাজারাজার দাদি সেম্বিয়ান মহাদেবী তাদের পরিবারকে শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন, যা তাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে।
সেম্বিয়ান ছিলেন নটরাজের পূজারী। নটরাজ শিবের আরেক রূপ, যিনি নৃত্যের রাজা বা দেবতা হিসেবে পরিচিত।
২০২৩ সালে দিল্লিতে জি২০ সম্মেলন ভেন্যুতে নটরাজের মূর্তি।
আজকাল নটরাজ তেমন অপরিচিত না হলেও মধ্যযুগে এমনটা ছিল না। সেম্বিয়ান তার মন্দিরগুলো গড়ে তুলেছিলেন নটরাজকে কেন্দ্র করেই। চোলরা পরেও এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখে। ধীরে ধীরে নটরাজ হয়ে ওঠে চোল রাজবংশের প্রতীক।
রাজারাজা চোলও দাদির মতোই জনসংযোগ আর দেবতাভক্তিতে সিদ্ধ ছিলেন। অবশ্য এক জায়গায় দুজনের পার্থক্যও আছে।
রাজারাজা ছিলেন দখলবাজ রাজা। ৯৯০ সালের দিকে তিনি তার সেনাদল নিয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলকে ছায়া দেওয়া পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পাড়ি দেন এবং বন্দরে শত্রুদের উপস্থিতিতেই তাদের জাহাজগুলো পুড়িয়ে দেন।
এরপর, লঙ্কা দ্বীপের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে তিনি সেখানে একটি চোল উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই মূল ভূখণ্ডের প্রথম ভারতীয় রাজা যিনি দ্বীপটিতে একটি স্থায়ী ঘাঁটি গড়তে পেরেছিলেন।
সবশেষে তিনি দাক্ষিণাত্যের দুর্গম মালভূমিতেও পা ফেলেন এবং একটি অংশ দখল করেন। এতসব বিজয়ের লুণ্ঠিত ধন দিয়ে গড়ে ওঠে তার বিশালাকৃতির মন্দির, আজ যা বৃহদীশ্বর মন্দির নামে পরিচিত।
বিশাল ধনসম্পদ তো ছিলই, দক্ষিণ ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো থেকে চোলদের এই মন্দিরে প্রতিবছর ৫,০০০ টন চালও আসতো। আজকের দিনে এই পরিমাণ চাল পরিবহনে এয়ারবাস এ৩৮০-এর মতো ১২টি বিশাল বিমানের দরকার পড়বে।
বৃহদীশ্বর হয়ে উঠল চোল রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী কেন্দ্র, যা জনকল্যাণ ও সেবার একটি বৃহৎ-মন্ত্রণালয়ের মতো কাজ করতো। এর অন্যতম প্রধান কাজ ছিল রাজারাজের বিপুল সম্পদ নতুন সেচ ব্যবস্থা, সম্প্রসারিত চাষাবাদ এবং ভেড়া ও মহিষের পালের পেছনে ব্যয় করা। তখন বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রই এত ব্যাপক ও গভীর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কথা কল্পনা করতে পেরেছিল।
চোলরা ভারত মহাসাগরে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যতটা মঙ্গোলরা ছিল মধ্য ইউরেশিয়ায়।
রাজারাজা চোলের উত্তরসূরি, রাজেন্দ্র চোল, তামিল বণিক গোষ্ঠীগুলো সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছিলেন ব্যবসায়ী আর সরকারের মধ্যে অংশীদারিত্ব, যেমনটা আমরা পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও দেখতে পাবো যারা আরও কয়েকশ বছর পরে এসে ভারতবর্ষে রাজত্ব করবে।
বৃহদীশ্বর মন্দিরের গম্বুজ , যেখানে ফুটে উঠছে সেসময়কার শিল্পীদের মুন্সিয়ানা
১০২৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজেন্দ্র বণিকদের জাহাজে তার সেনা মোতায়েন করেন এবং মালয় উপকূলের কেদাহ নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে হামলে পড়ে তুমুল লুটপাট চালান। শহরটি তখন মূল্যবান কাঠ ও মশলার বাণিজ্যে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করছিল।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী অনেকে একে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চোলদের ‘উপনিবেশ স্থাপন’ হিসেবে দেখলেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা তেমনটা মনে করেন না। চোলদের নিজস্ব নৌবাহিনী ছিল এমন প্রমাণ মেলে না, তবে তাদের শাসনকালে তামিল বণিকদের প্রভাব বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
একাদশ শতকের শেষের দিকে, এই বণিকেরা উত্তর সুমাত্রার স্বাধীন বন্দরগুলো পরিচালনা করতো। এক শতাব্দী পর তাদের দেখা মিলবে এখনকার মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভেতরেও, সেসময় এমনকি তারা জাভাতে কর সংগ্রাহকের কাজও করেছে।
ত্রয়োদশ শতকে কুবলাই খানের বংশধরদের অধীনে মোঙ্গল-শাসিত চীনে তামিল বণিকরা কোয়ানজু বন্দরে সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এমনকি তারা পূর্ব চীন সাগর উপকূলে শিবের একটি মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে কারণে ১৯ শতকে, ব্রিটিশ রাজের শাসনামলে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া ভারতীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের বড় অংশই যে তামিল তা আর কাকতালীয় হয়ে দাঁড়ায় না।
একের পর এক এলাকা জয় আর বৈশ্বিক সংযোগ চোল শাসিত দক্ষিণ ভারতকে একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল, পরিণত হয়েছিল দুনিয়াজোড়া বাণিজ্য নেটওয়ার্কের নেক্সাসে।
চোল অভিজাতরা যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিল মন্দির নির্মাণে বিনিয়োগ করতো। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত অনেক সামগ্রী সংগ্রহ করা হতো বিশ্বের বিভিন্ন অংশ থেকে। তাদের ব্রোঞ্জ তৈরির কাঁচামাল তামা ও টিন আসতো মিশর, এমনকি স্পেন থেকেও। দেবতাদের কর্পূর ও চন্দন কাঠ আসতো সুমাত্রা আর বোর্নিও থেকে।
তামিল মন্দিরগুলো বিশাল কমপ্লেক্স ও জনসমাগমের স্থানে পরিণত হয়েছিল, বাজার দিয়ে ঘেরা এই মন্দিরগুলোর ছিল বিপুল পরিমাণ ধানিজমিও।
কাবেরিতে চোলদের রাজধানী অঞ্চল, এখন যেটা কুম্বাকোনাম শহর, গড়ে উঠেছিল ডজনখানেক এরকম মন্দির এলাকার সমন্বয়ে, এর জনসংখ্যা ছিল কয়েক লাখ। সেসময় সম্ভবত ইউরোপের বেশিরভাগ শহর এমনটা কল্পনাও করতে পারতো না।

চোল এ শহরগুলোতে আশ্চর্যজনকভাবে বহুসংস্কৃতি ও বহুধর্মের মেলামেশা ছিল। চীনা বৌদ্ধরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতো তিউনিশিয়ার ইহুদিদের সঙ্গে, তন্ত্রেমন্ত্রে পারদর্শী বাঙালি ব্যবসা করতো লঙ্কার মুসলিম বণিকদের সঙ্গে।
আজ তামিলনাড়ু ভারতের সবচেয়ে নগরায়িত রাজ্য, এর অনেক শহরই চোল যুগের মন্দির ও বাজারগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। নগরায়ন ও স্থাপত্যে চোলদের এই অগ্রগতির সঙ্গে সমানতালে বিকশিত হয়েছে তাদের শিল্প, সাহিত্যও।
মধ্যযুগের তামিল ধাতব শিল্পকর্ম, যা বানানো হয়েছিল চোল-যুগের মন্দিরগুলোর জন্য, সম্ভবত মানুষের হাতে বানানো সবচেয়ে নিপুণ কাজ, মানুষের মূর্তি বানানোর ক্ষেত্রে তাদের যে দক্ষতা ছিল তাতে তারা খুব সহজেই মাইকেলেঞ্জেলো বা দোনাতেল্লোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতেন। চোল রাজাদের প্রশংসা আর দেবতাদের উপাসনা করতে তামিল কবিরা আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস এমনকি জাদুবাস্তবতার ধারণারও বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
চোলদের এই সময়কে বলা যেতে পারে রেনেসাঁর দক্ষিণ ভারতীয় সংস্করণ, অথচ এটি ঘটছিল ইউরোপে রেনেসাঁরও ৩০০ বছর আগে।
পশ্চিমা বড় বড় জাদুঘরে যে এখনও চোল যুগের ব্রোঞ্জ মূর্তি, বিশেষ করে নটরাজের ব্রোঞ্জ মূর্তি মেলে, তা মোটেই অবাক করা বিষয় নয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এগুলো আসলে সেই কালের সাক্ষী- যে কাল ছিল সমুদ্রপথে দূর-দূরান্তকে যুক্ত করার অভাবনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিশালাকৃতির মন্দির আর অঢেল ধনসম্পদ এবং বণিক, শাসক ও শিল্পীদের কাল, যারা আজ আমরা যে দুনিয়ায় বসবাস করি তার আকার গড়ে দিয়েছিলেন।