ভারতে করোনার দুঃসহ সময়ে অক্সিজেন বিপর্যয়ের সহজ সমাধান দিলেন বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল

- আপডেট সময় : ০৮:৩০:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মে ২০২১ ২৮২ বার পড়া হয়েছে

(ড. বিজন কুমার শীল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অণুজীব বিজ্ঞানী। ৯০-এর দশকে ব্ল্যাক বেঙ্গল প্রজাতির ছাগলের সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। ২০০২ সালে তিনি ডেঙ্গুর কুইক টেস্ট পদ্ধতির আবিষ্কারক। ২০০৩ সালে করোনাভাইরাসের (Coronavirus) পূর্বসূরি সার্সের (SARS) কুইক টেস্ট পদ্ধতিও তাঁরই আবিষ্কার। সর্বশেষ ২০২০ সালে বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষণাগারে কোভিড ১৯ শনাক্ত করার জন্য স্বল্প মূল্যের কিট আবিষ্কার করে আলোচিত হন ড. শীল। তিনি বাস করেন সিঙ্গপুরে। এই মুহূর্তে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে জেরবার ভারত। এই পরিস্থিতিতে পথ দেখিয়েছেন ড. শীল। তিনি তাঁর পরামর্শমূলক লেখাটি পাঠিয়েছেন)
১৩৬ কোটিরও বেশি অধিবাসীর ভারতভূমিতে করোনার যে তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে তাতে বিশ্ববাসী নিজেদের সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি একজন ক্ষুদ্র বিজ্ঞানী, করোনা রোগের উপর সামান্য বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে খুব খুশি হব।
এই মুহূর্তে ভারতে যে সমস্যাটি সব চেয়ে জটিল আকার ধারণ করেছে তা হল, অধিক মাত্রার শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের জন্য অপ্রতুল হাসপাতাল ও অক্সিজেন সরবরাহের স্বল্পতা। ফলে রোগী ও তাঁদের পরিবারে একটা বিরাট আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং বহু রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। আর এই ঘটনা আরও বেশি আতঙ্কিত করে তুলেছে সাধারণ মানুষকে।
এই অবস্থায় যে কাজটি সব চেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত তা হল, করোনা-আক্রান্ত রোগীর শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাকে কমিয়ে এনে তাকে হাসপাতালমুখী না করে বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এই কাজটি করা খুবই সহজ কিন্তু সঠিক সময়ে করা প্রয়োজন।
শ্বাসকষ্টের কারণ কী
করোনারোগীদের শ্বাসকষ্টের মূল কারণটি কী? বর্তমানে ভারত-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে মারাত্মক ভাইরাসগুলো ছড়াচ্ছে, এদের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, এরা অনেক কম সংখ্যক ভাইরাস দিয়ে রোগীকে আক্রান্ত করতে সমর্থ, যেটা পূর্বের ভাইরাসগুলোর মধ্যে ছিল না। এতে ভাইরাসটি অতি দ্রুত রোগীর ফুসফুসকে আক্রান্ত করে তার প্রতিরোধক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। করোনাভাইরাস ফুসফুসে ক্ষতের সৃষ্টি করে প্রতিরোধক্ষমতাকে ভেঙে দিচ্ছে এবং এরই সুযোগ নিচ্ছে অন্যান্য জীবাণু, যারা অহরহ নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করছে। মাছ যেমন জল দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, আমরাও ঠিক সেই ভাবে জীবাণু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। এটা ঠিক মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রদাহকে মোকাবিলা করার জন্য রক্তনালি থেকে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী কোষসমূহ শ্বাসথলিতে প্রবেশ করা শুরু করে এবং সঙ্গে নিয়ে আসে রক্তরস। যদি প্রদাহের তীব্রতা কমানো না যায়, তবে তা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলবে এবং এক পর্যায়ে স্রোতের মতো রক্তরস এবং প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী কোষ প্রবেশ করে শ্বাসথলিগুলোকে পরিপূর্ণ করে ফেলে। ফলে সেখানে অক্সিজেন ও কার্বন ড্রাই অক্সাইডের বিনিময়ে বাধার সৃষ্টি হয় এবং রোগীর রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। এ কারণে রোগী শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন (নিবন্ধের শেষে দ্রষ্টব্য: করোনা রোগের বর্তমান ভয়াবহ রূপের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা ও চিত্র-১)
চিত্র-১ – করোনা-আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসের ভয়াবহ রূপ কী ভাবে ধারণ করে। সাধারণত আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসের কোষের পাশাপাশি তার রোগ প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী কোষসমূহকে ধ্বংস করার কাজ শুরু করে করোনাভাইরাস। ফলে নিঃশ্বাসের সঙ্গে আসা জীবাণুসমূহ অতি সহজেই ফুসফুসকে আক্রমণ করে যা ক্রমেই ভয়াবহ অবস্থার দিকে যেতে শুরু করে। ফলে রোগীর ফুসফুসে জল জমে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটিয়ে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
এ পরিস্থিতিতে রোগীর প্রাণরক্ষার জন্য কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা জরুরি হয়ে পড়ে। তাঁকে নিয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হয় এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাব হলে তা ক্রমান্বয়ে প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে। এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুর মতো হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
পিসিআর টেস্ট (PCR Test) ছাড়াও করোনা রোগ কী ভাবে শনাক্ত করা যায়?
সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হল দ্রুততার সঙ্গে করোনা রোগ শনাক্ত করা। পিসিআর বা অ্যান্টিজেন (antigen test) টেস্ট করোনাভাইরাস শনাক্ত করার সঠিক পদ্ধতি। কিন্তু এই রোগটি শনাক্ত করার জন্য বেশি সময় নেওয়া অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই নতুন ভাইরাসের রোগ তৈরি করার ক্ষমতা অনেক বেশি এবং অনেক কম সময়ের মধ্যে এটা ফুসফুসকে আক্রান্ত করে ফেলে। তাই আপনার কোনো নিকট আত্মীয় বা পরিবারের বা আপনার এলাকায় যদি কেউ করোনা ভাইরাসপজিটিভ বলে শনাক্ত হয়ে থাকেন, আর আপনার যদি মাথাব্যথা অথবা শরীরব্যথা করে অথবা শরীর অবসন্ন মনে হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে যে আপনি করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন (চিত্র-২)।
ত্র-২ – প্রাথমিক লক্ষণ দেখে করোনা রোগ চেনার উপায়। যদি আপনার এলাকায় বা আপনার নিকট আত্মীয়ের করোনা রোগ হয়ে থাকে এবং আপনার মধ্যে চিত্রে উল্লিখিত প্রথম ছকের লক্ষণ দেখা দেয় তবে বুঝতে হবে আপনি করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাতে আতঙ্কের কিছু নেই। অবিলম্বে চিকিৎসা নেওয়া শুরু করলে, আপনি হাসপাতালের দ্বারস্থ না হয়েই ১০০ ভাগ সেরে উঠবেন।
জ্বর বা গলাব্যথা নাও হতে পারে বা পরে দেখা দিতে পারে। এমনটি হলেও আপনি কালবিলম্ব না করে পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করুন এবং গৃহের একটি আলাদা ঘরে থাকা-সহ মাস্ক পরা শুরু করুন। তবে ঘরের জানলা খোলা রাখবেন যাতে করে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাতাস আপনার ঘরে চলাচল করতে পারে ও পরিবারের অন্য সদস্যরা আপনার ঘরে এলে তাঁদের অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।
কী চিকিৎসা নেবেন এই অবস্থায়?
আপনার প্রথম কাজ হবে আক্রান্ত ফুসফুসকে রক্ষা করা, যাতে সুযোগসন্ধানী জীবাণু, ভাইরাস-আক্রান্ত ফুসফুসের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ ফেলতে না পারে। এ জন্য আপনাকে স্থানীয় যে কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবাযোটিক্স (Broad Spectrum Antibiotics) খাওয়া শুরু করতে হবে, যা আপনার ফুসফুসকে অন্য জীবাণু থেকে রক্ষা করবে (চিত্র ৩)। আমি আগেই বলেছি যে করোনাভাইরাস শুধু ফুসফুসের কোষকে আক্রান্ত করে না, ভাইরাসটি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টিকারী শক্তিকেও ধ্বংস করে। সুতরাং প্রতিরোধক্ষমতাকে সক্রিয় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন-সি গ্রহণ করা উচিত (চিত্র-৩)।
দিনে অন্তত ২০০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি (সকালে এবং রাত্রে) খান এবং সঙ্গে প্রচুর জল পান করুন (দিনে কমপক্ষে ৩-৪ লিটার)। এই ভিটামিন সি আপনার প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী কোষকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি ফুসফুসে রক্তরস ক্ষরণের জন্য দায়ী সাইটোকাইনস-এর (cytokines) উৎপাদন কমিয়ে দেবে এবং ফুসফুসে ভাইরাস দ্বারা যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুততার সঙ্গে সারিয়ে তুলবে। এই অতি সহজ চিকিৎসাটি যথাসময়ে নিতে পারলে আপনাকে হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হবে না। দেশে অক্সিজেনের প্রকট অভাব দেখা দেবে না এবং অনেক মূল্যবান জীবনকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
যদি পেটের সমস্যা শুরু হয়, (প্রায় ৬০-৭০ ভাগ করোনা আক্রান্ত মানুষের হয়ে থাকে) তবে তার চিকিৎসা আপনার বাড়িতেই আছে। সেটা হল নিম ও হলুদের মিশ্রিত জল। কী ভাবে বানাবেন এটি? একমুঠো নিমপাতা ভালো করে গরমজলে ধুয়ে নিন এবং তা বেঁটে চা চামচের এক চামচ গরমজলের মধ্যে ভালো করে মিশিয়ে দশ মিনিট পর তা ছেঁকে নিয়ে সঙ্গে এক চা চামচ হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে চিনি বা মধু দিয়ে সকালে খালি পেটে পান করুন। পাতলা পায়খানা দেখা দিলে দিনে দু’ বার খেতে পারেন (চিত্র-৪)।
চিত্র ৪ – করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে (বিশেষত এই নতুন ভাইরাস, যা ভারত-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিরাজমান) রোগের একটি পর্যায়ে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং পাতলা পায়খানাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিমপাতা ভালো করে গরমজলে ধুয়ে নিন এবং তা বেঁটে চা চামচের এক চামচ গরমজলের মধ্যে ভালো করে মিশিয়ে দশ মিনিট পর তা ছেঁকে তার সঙ্গে এক চা চামচ হলুদগুঁড়ো মিশিয়ে চিনি বা মধু দিয়ে সকালে খালি পেটে পান করলে পেটের কোনো সমস্যা থাকবে না।
এই নিম পাতার রস এবং হলুদগুঁড়ো আপনার পেটের সুযোগসন্ধানী জীবাণুকে ধ্বংস করে আপনাকে সুস্থ করে তুলবে। যদি কাশি দেখা দেয় তবে আদা, গোলমরিচ, লবঙ্গ বেঁটে তা একটু চায়ের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে সেটি চিনি বা মধু দিয়ে গরম গরম পান করুন। আপনার কাশি সেরে যাবে (চিত্র-৫)। তবে প্রথম থেকে আমার পরামর্শমতো চিকিৎসা নিলে কাশি নাও হতে পারে।
চিত্র-৫ – এই ‘চা’টি বাংলাদেশে ‘বিজন চা’ নামে পরিচিত ও গত বছর করোনা রোগ উপশমে বেশ ভালো কাজ করেছে। আপনারা রান্না ঘরেই এটি বানাতে পারবেন এবং শুষ্ক কাশির জন্য খুব উপকারী।
মনে রাখবেন করোনাভাইরাস রোগের সুচনা করে বটে, কিন্তু রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় সুযোগসন্ধানী জীবাণুরা। তাই অঙ্কুরেই এদের বিনাশ করার ব্যবস্থা করুন। কারণ ভাইরাসকে বিনাশ করার ঔষধ না থাকলেও ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করার সুচিকিৎসা বাজারে বিদ্যমান ও সহজলভ্য।
করোনা রোগের বর্তমান ভয়াবহ রূপের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা
রোগীর অক্সিজেন কেন দরকার?
রক্তের অক্সিজেনের স্বল্পতা <৯০%।
কেন অক্সিজেনের স্বল্পতা?
ফুসফুসে অক্সিজেন ও কার্বন ডায়োঅক্সাইড বিনিময় ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হওয়া।
কেন ব্যাহত হচ্ছে?
ফুসফুসে জল জমার কারণে (Pleural effusion।
কেন জল জমেছে?
প্রবল Cytokines storm-এর জন্য রক্তনালি থেকে রক্তরস ও রোগ প্রতিরোধকারী কোষসমূহ ফুসফুসের বাযুথলিতে প্রবেশ করার কারণে।
কেন cytokines storm?
প্রচণ্ড প্রদাহের কারণে রোগ প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী কোষ থেকে প্রচুর cytokines তৈরি হয়।
কেন প্রদাহ সৃষ্টি হল?
করোনাভাইরাসের ক্ষতস্থানে ব্যাপক ভাবে secondary ইনফেকশন শুরুর কারণে।
কেন secondary ইনফেকশন?
রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল বা ভেঙে পড়ায়, সুযোগসন্ধানী জীবাণুরা ফুসফুসকে আক্রমণের সুযোগ পায়।
প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হল কেন?
করোনাভাইরাস শরীরের অন্যান্য কোষের ন্যায় রোগীর প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী কোষকেও ধ্বংস করে থাকে।
এ অবস্থার কী করণীয়?
রোগকে দ্রুত শনাক্ত করে secondary ইনফেকশনকে রোধ করা-সহ রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে বাড়ানো জরুরি প্রয়োজন।