বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষ
- আপডেট সময় : ১২:৪৭:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ মার্চ ২০২১ ২২২ বার পড়া হয়েছে
আবদুল্লাহ আল মামুন, কলকাতা থেকে
ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে বেকার হোস্টেলের তৃতীয় তলার দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারের ২৪ নম্বর কক্ষটি ছিল কলকাতায় মুসলিম ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার। পাশের ইসলামিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সূত্রে কক্ষটিতে থাকতেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে, পরামর্শে তৈরি হতো আন্দোলনের রূপরেখা।
১৯৪২ থেকে ২০২১। আট দশক। দীর্ঘ এই সময়ে একটি জাতির জনক, একজন বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কেউ কি এখানে এসেছেন, যাঁকে বিশ্ববাসী কিংবা এই উপমহাদেশের মানুষ মনে রাখবে! না, সরকারি এই হোস্টেল শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর তেমন কাউকে পায়নি।
তাইতো বেকার হোস্টেল তার গর্ব শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি ধরে রাখতে ২৪ নম্বর কক্ষটি ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ’রূপে সংরক্ষণ করেছে। এখন এই কক্ষের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর গৌরবময় অধ্যায়ের ছবি, টেবিলে রাখা পেইন্টিং আর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় মুদ্রিত গ্রন্থে দর্শনার্থীরা জানতে পারছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির কীর্তি।
বঙ্গবন্ধুর কলেজজীবনের বন্ধু নীহাররঞ্জন চক্রবর্তী গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া এই আবাসিক হোস্টেল আর তেমন কাউকেই পায়নি। তিনি একজন মহামানব। হাজার বছরেও এমন মানুষ ঘুরেফিরে আসে না। তাইতো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। শুধু বেকার হোস্টেল নয়, আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি, তাদের সবার জন্যই বিষয়টি অত্যন্ত গর্বের।’
কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. মোফাকখারুল ইকবাল গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেকার হোস্টেলে থাকার সময় ২৪ নম্বর কক্ষটি সব সময় ছাত্রনেতাসহ রাজনৈতিক কর্মীদের পদচারণে মুখর থাকত। কমপক্ষে দুটি পত্রিকা নিয়মিত রাখতেন বঙ্গবন্ধু।
এই পত্রিকা পড়তেও অনেকে তাঁর কাছে আসতেন। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু বেকার হোস্টেলের ছাত্রদের খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখতেন। এই কাজটি করতে গিয়ে অনেক সময় তাঁর নিজের খাওয়াই হতো না। বিষয়টি একবার ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ জানতে পারেন এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হোস্টেল সুপারকে নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ওই কক্ষে থাকতেন গোপালগঞ্জের স্কুলজীবনের সহপাঠী শাহাদাৎ হোসেন। টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা গ্রামের দরিদ্র বচন মিয়ার ছেলে শাহাদাতের হোস্টেলের খরচ জোগাতেন বঙ্গবন্ধু।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগের মন্ত্রী অধ্যাপক সত্যসাধন চক্রবর্তী ১৯৯৮ সালের ৩১ জুলাই মৌলানা আজাদ কলেজের (আগের ইসলামিয়া কলেজ) অধ্যক্ষ ড. সত্যব্রত ভট্টাচার্য্য এবং কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনার শেখ আহমেদ জালালের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষের নামফলক উন্মোচন করেন। পাশের ২৩ নম্বর কক্ষটিও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষের সঙ্গে।
গত দুই দিন শিয়ালদহের কাছে ৮ স্মিথ লেনে অবস্থিত বেকার হোস্টেল ঘুরে দেখা যায়, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে হোস্টেলটি জনমানবহীন ও তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। তবে পাশের মসজিদে নামাজের জন্য মুসল্লিরা আসেন। বেকার হোস্টেলের সবগুলো কলাপসিবল গেট এক বছর ধরেই বন্ধ রয়েছে। গতকাল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে হোস্টেলের তালা খোলা হয়। এরপর সকালে কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।
সেখানে প্রবেশের আগে বাঁ দিকের দেয়ালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/জীবন ও কারাজীবন’ শিরোনামে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করতেই সামনে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য। বাঁ পাশে ২৩ নম্বর কক্ষ। সেটি ভেতর থেকে যুক্ত করা হয়েছে ২৪ নম্বরের সঙ্গে। কক্ষের পূর্ব দিকের দেয়াল বরাবর বঙ্গবন্ধুর শোবার খাট, পাশে পড়ার টেবিল ও চেয়ার।
টেবিলের ওপর বঙ্গবন্ধুর তরুণ বয়সের একটি প্রতিকৃতি রাখা হয়েছে। পূর্ব পাশের দেয়াল ঘেঁষে বড় খোলা জানালার পাশে ছাত্রাবস্থার একটি ছবি, দরজার দিকের দেয়ালে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি ছবি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। টেবিলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচাসহ তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত একাধিক বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সময়ের বেশ কিছু দুর্লভ ছবি এই স্মৃতিকক্ষের দেয়ালে স্থান পেয়েছে।
কক্ষের ভেতরে কাঠের পার্টিশান দিয়ে অনেকটা ছোট ড্রয়িংরুমের মতো রাখা হয়েছে, যা ১৯৯৮ সালের আগে ছিল ২৩ নম্বর কক্ষ। সেখানে একটি কাঠের বুকশেলফ ছাড়াও রয়েছে একটি টেবিল ও আলমারি। এই টেবিলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত একাধিক বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
বেকার হোস্টেলের কর্মচারী কাশিনাথ লস্কর কালের কণ্ঠকে বলেন, হোস্টেলের আবাসিক ছাত্ররা ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রুমটি ব্যবহার করেছেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষে রূপান্তরের পর ২৩ ও ২৪ নম্বর কক্ষ দুটি আর ব্যবহার হয় না। হোস্টেলে প্রায় ২০০ রুম রয়েছে বলে তিনি জানান।
হোস্টেলটি শিয়ালদহ এলাকার কাছে ৮ স্মিথ লেনে অবস্থিত। হোস্টেলটি ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১০ সালে এডওয়ার্ড নরম্যান বেকার প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সরকারি ছাত্রাবাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাশের ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় এই হোস্টেলে থাকতেন। ইসলামিয়া কলেজের এখন নামকরণ হয়েছে মৌলানা আজাদ কলেজ। বেকার হোস্টেলের পাশে ইলিয়ট (গভ.) হোস্টেল নামের আরো একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। দুই হোস্টেলের মাঝে রয়েছে মসজিদ। এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত। হাজী মহসিন স্কয়ার ও রফি আহমেদ কিদওয়ানী সড়কের কাছেই স্মিথ লেনের অবস্থান। কালের কণ্ঠের সৌজন্যে