ঢাকা ০৯:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিশ্বের শান্তির আবেগ এবং মানবতার ‘পথিক’ কাজি নজরুল ইসলাম

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, মালদা (পশ্চিমবঙ্গ)
  • আপডেট সময় : ০৬:১৬:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ মে ২০২১ ২৮৬ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

এই উপমহাদেশীয় গরম কালের চিরআধুনিক ফসল-কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি কাজি নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্য পরিসরে অন্য সময় আলোচনা করা যেতেই পারে। তবে জৈষ্ঠ্যমাসের গরমের তীব্রতা আর কাজি নজরুল ইসলামের কলম-মননের আলোচনায় তাঁর একাধিক সৃষ্টির মধ্যে বেছে নেবো মাত্র দুুুু’টি মনোশান্তির গানের কলি। ১) মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুুুুসুম হিন্দু মুসলমান… ২) দূর্গম গিরী কান্তার মরু দুুস্তর পারাবার হে…


গনতন্ত্র, সার্বোভৌমত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষরাষ্ট্রে শান্তি এক মানবিক সুশীতল বৃৃৃক্ষছায়া। পথিকস্বরূপ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ছায়ায় আশ্রয় নেয়। নজরুল-এর ‘মোরা’ এখন তাই আমরা। আমরা দেখি, দেখেছি এবং দেখবো। এখানে ‘আমরা’-এই শব্দে ঘুরে ঘুরে আসে মহাবিশ্বের নিষ্পলক শান্তিকামী অজস্র চোখ! অতএব এই আমরাই দেখেছি গনচিতা জ্বলছে আর গন কবর খোড়া হচ্ছে। কেনো হচ্ছে, এই প্রশ্নে আজ বুঝি, সকল শুভ কর্মের মধ্যে নিহিত থাকে শান্তির নতুন স্থাপনা।

করোনায় মৃত্যু হলে, বৃহত্তর রাষ্ট্রের কথা মাথায় রেখে সেই মৃতদেহ আর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু, সে মৃত্যু যদি হয় অগুনতি! আর একটা দেশ যদি হয়, বিপুলা পৃথিবীরই একটা খন্ডিত অংশ, তবে এভাবেই বলা যায়-এ বিশ্ব আজ সমাগত সময়ের লাশভূমি।

এখানে কবি’র ভাষায়-এক সে দেশের মাটিতে পাই, কেউ গোরে কেউ শশ্মানে ঠাঁই, মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান। এই গীতিকবিতার শেষ স্তবকিত উচ্চারণ যেনো সমগ্র ভারতবর্ষের, তথা সমগ্র বাঙালির মননের অনন্ত অঙ্গন। এই অঙ্গন জুড়ে ফুটে থাকা কবি নজরুলের এক সুরে গাওয়া সমবেত প্রার্থনা সংগীত যেনো প্রস্ফুটিত শান্তির ফুল। আর, সেই ফুটন্ত হয়ে ফোটা ফুলের কারণ সুধা হলো আ-বিশ্বের বাঙালির প্রিয় একটাই কবি, কাজি নজরুল।

এই লেখাটির শুরুতে কাজি নজরুল ইসলাম এর ‘মোরা’, একই বৃন্তের দুটি কুসুম, আসলে আমরা। আমরা দেখেছি সেদিন শবদেহগুলো। এই দেখাতে একটা ঘটমান অতীত আছে। কোনো বিষয়ের বিজ্ঞানসম্মত ধারণায় অতীত থাকলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ থাকবেই। এই যেমন, সমস্ত বিশ্ব ব্যাপী কোভিড সংক্রমণের কালে টিকাকরণ নিয়ে যে সেদিন আশ্চর্যজনক উপস্থাপনা চলছিলো, তা আজকের টিকা আবিষ্কারের পরবর্তীতে কেমন যেনো একটি ছোট্ট আলোকবিন্দুর ন্যায় দেখাচ্ছে। খুলে বললে, এই যেমন, ভারতবর্ষের ২টি টিকা এখন বাজারে অপ্রতুল।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে যিনি দন্ডমুন্ডের কর্তা, সেই প্রধানমন্ত্রী গতবছরে কোভিডের কারণে লকডাউন ঘোষণা করবার প্রাক্কালে দেশের নাগরিকদের ক্ষতি যাতে না হয়, সেই জন্য জাতির উদ্দেশ্যে বললেন-সন্ধ্যাকালে ঘরবাড়ি অন্ধকার করে একটি মাত্র মোমবাতির প্রজ্জ্বলিত আলোকশিখা নিয়ে দাঁড়িয়ে মুখে শঙ্খ ফুঁ দিলে দেশ থেকে করোনা চলে যাবে।

দেশবাসীর মধ্যে আবেগের একটা কলরোল জেগেছিলো এই নিয়ে। ফলে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা পর্যন্ত আন-কাট আলোকবিন্দু ও শঙ্খ- ফুঁ কিন্তু বেজেছিলো দেশকে সামগ্রিকভাবে ভাইরাস মুক্ত করে শান্তির বার্তা দিতে এবং অবশ্য অবশ্যই তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই।

ঠিক এখানে এসেই স্মরণ করি কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতাটিকে। কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে কবি বলছেন–‘তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান, যুগযুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিতবুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।’

একজন প্রধানমন্ত্রীর ডাক, মানে কোভিডকালের তিমিররাত্রিতে দেশবাসীর কাছে কান্ডারী স্বরূপ আবেগময় বিশ্বশান্তির অমোঘ ডাক। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ডাক আর বাস্তবতা যখন একটি অবৈজ্ঞানিকতার অজ্ঞতা প্রকাশ করে দিলো, তখন ভারতবাসী মুষড়ে পরেও আত্মবলে বলিয়ান হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুরেই ঘুরে দাঁড়িয়ে কবির ভাষায় বলে উঠতে চাইলেন এবং ক্রমাগত চেয়েই যাচ্ছেন –‘কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’….

এই পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিলো ঘটমান অতীতের ইতিহাসের পাতায় জমা হওয়া একটুকরো ভারতীয় বিশ্বাস, যার নাম আক্ষরীক অর্থে চিরন্তনী উপমহাদেশীয় শান্তির জন্য জীবনের আবেগ।

কিন্তু ওই যে, যে দিন যায়, তা ভালোই যায়, আর যে দিন অনাগত ভবিষ্যতের জঠরে নিমজ্জিত, তাকে আমরা দেখিনি! কিন্তু তার রূপকল্পনা করবার চেষ্টা করার মধ্যে অপরাধটা কোথায়?

শুরুতে ঝাঁকুনি দেওয়া চিত্র-বাক্যকে পাঠক এখনও ভোলেননি নিশ্চয়ই। অতঃপরও কলম চলতে থাকুক এভাবেই-ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর দুঃখে প্রধানমন্ত্রী আবেগরুদ্ধ। তার মুখ মন্ডলে ক্যামেরা তখন জুম।

তিনি বলছেন- ‘এই ভাইরাস আমাদের আত্মজনকে’…এরপর এক গভীর নিস্তব্ধতা!! নিস্তব্ধতার অর্থ কান্না বা অপারঙ্গমতা, এটা ধরে নেওয়া যায়। তারপর বাক্য শেষ করলেন এই বলে-‘আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে’…

একটি বৃহত্তর রাষ্ট্রের ভোটের ঢেউ-এর অভিঘাত থাকেই! ঠিক যেমন কেভিডের প্রথম, দ্বিতীয় তৃতীয় ইত্যাদি ওয়েব। এক রাজ্যের ভোট পেরোতেই অন্যান্য রাজ্যের একাধিক মিউনিসিপ্যাল সহ পঞ্চায়েত ভোট আসন্ন। এমতাবস্থায় রাজনীতি ও আবেগকে পৃথকীকরণ করা হয়তো যায়না।

তবে সামনের বছরের মাঝামাঝি গোটাবিশ্বের টিকাকরণ সম্পূর্ণ করতে পাঁচহাজার কোটি ডলার লাগবে, যা সম্পূর্ণভাবে মুনাফা সহ ফেরত যোগ্য-এটা আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার কর্তৃক উন্নতশীল দেশগুলোর প্রতি ঘোষণা। আইএমএফ-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ এবং তার সহযোগী রুচির আগরওয়ালা তাদের রিপোর্টে (তথ্য-আনন্দ বাজার পত্রিকা ২২শে মে, ২০২১) বলেন-একটা লক্ষ্য মাত্রা ঠিক হয়েছে।

২০২১ সালের মধ্যে সব দেশের চল্লিশ শতাংশ মানুষের টিকাকরণ সম্পন্ন করতে হবে আর ষাট শতাংশকে দিতে হবে ২০২২এর প্রথমার্ধে। এতে অবশ্য অবশ্যই এবিশ্ব করোনা মুক্ত হবে যেমন, তেমনই ওই লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছাতে গেলে আহুত উন্নতশীল দেশগুলোর প্রত্যেকেরই আর্থিক লাভের অঙ্ক মূলধন বাদ দিয়ে যে লক্ষ কোটি টাকা ছোঁবে, তাতে পৃথিবীর উন্নতিকামী ও সুস্থ স্বাস্থ্যকামী দেশগুলোর অর্থকোষ সমৃদ্ধময় হবে। যার ফল স্বরূপ বিশ্ব শারীরিক-শান্তি নেমে আসবে, একথা আমরা ভাবতেই পারি।

এই ভাবনাতেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একধরণের জাতীয় আবেগ মিশে আছে। অতঃপর আবারও ফিরে যেতে হয় শেষ স্তবকে। –‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলো যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান। আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার’…..

আমরা আশাবাদী হতে চাই। চাই–কোভিডবিশ্ব আন্তর্জাতিক আন্তরিকতাসম্পন্ন এক বা একাধিক শাসকরূপ, কবি কাজি নজরুলের ভাষায় দক্ষ ত্রাতা হয়ে উঠে এ বিশ্বময় একটাই ধ্বনিকে উচ্চারিত করুন –

দেহ শান্তি..
দেশ শান্তি…..
মহাবিশ্ব শান্তি হি কেবলম…..

মানুষের হুঁশ আছে বলেই তো সম্মানিত যে কোনো ব্যক্তিই, তা প্রধানমন্ত্রী কিম্বা খেটে খাওয়া সাধারণ ব্যক্তির পরিচয়-তিনি একজন মানুষ। তিনি যে কোনো পরিস্থিতিতে জাতির ত্রাতা। তাই প্রশ্ন রাখা যায়-ই, যে, কোভিড কালের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কেনো আসমুদ্রহিমাচলের ত্রি-ভাগ জলধারায় এতো উথাল-পাথাল ঘনঘোর কৃষ্ণবর্ণের ঢেউ!!

যা-ই হোক না কেনো, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা রাজনৈতিক-সমাজে আবেগের একটা ট্রেন্ড আছে। যা একটা প্লাবনেরই তুল্যরূপ। এই যেমন যোদ্ধা রেড ভলান্টিয়ারেরা সারাবাংলাসহ ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে চষে বেড়াচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে । মৃতপ্রায় মানুষের কাছে জীবনীশক্তি অক্সিজেন পৌঁছে দিতে তারা বদ্ধপরিকর, তাদেরই জীবনকে বাজি রেখে। কিম্বা, রেজাউল করিম, যিনি পঞ্চায়েতের পুর্ত কর্মাধ্যক্ষ ও ধর্মীয়ভাবে বিপরীত ধর্মীয়। তবু তিনি নিতাই প্রামাণিকের সৎকার নিজের হাতে করলেন!

কেনো করলেন? কেননা, এই করোনায় মৃতকে তার আত্মীয় স্বজন না ছুঁলেও সৎকার করতেই হবে, এই সামাজিক বোধে অবিচল থেকে। তাই, সর্বশেষ লেখায় সচলায়তনকে চির সচল রাখার দাওয়াই একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই মহাবিশ্বের জীবন চলবে কেবলই জীবনের জন্য। নজরুলের কবিতার ….‘মোরা এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল, এক সে মায়ের বক্ষে ফলে একই ফুল ও ফল’…এই বোধকে না থমকে রেখে আমাদের সদা জাগরূক থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, প্রাবন্ধিক, কবি ও সংগঠক,

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

বিশ্বের শান্তির আবেগ এবং মানবতার ‘পথিক’ কাজি নজরুল ইসলাম

আপডেট সময় : ০৬:১৬:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ মে ২০২১

এই উপমহাদেশীয় গরম কালের চিরআধুনিক ফসল-কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি কাজি নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্য পরিসরে অন্য সময় আলোচনা করা যেতেই পারে। তবে জৈষ্ঠ্যমাসের গরমের তীব্রতা আর কাজি নজরুল ইসলামের কলম-মননের আলোচনায় তাঁর একাধিক সৃষ্টির মধ্যে বেছে নেবো মাত্র দুুুু’টি মনোশান্তির গানের কলি। ১) মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুুুুসুম হিন্দু মুসলমান… ২) দূর্গম গিরী কান্তার মরু দুুস্তর পারাবার হে…


গনতন্ত্র, সার্বোভৌমত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষরাষ্ট্রে শান্তি এক মানবিক সুশীতল বৃৃৃক্ষছায়া। পথিকস্বরূপ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ছায়ায় আশ্রয় নেয়। নজরুল-এর ‘মোরা’ এখন তাই আমরা। আমরা দেখি, দেখেছি এবং দেখবো। এখানে ‘আমরা’-এই শব্দে ঘুরে ঘুরে আসে মহাবিশ্বের নিষ্পলক শান্তিকামী অজস্র চোখ! অতএব এই আমরাই দেখেছি গনচিতা জ্বলছে আর গন কবর খোড়া হচ্ছে। কেনো হচ্ছে, এই প্রশ্নে আজ বুঝি, সকল শুভ কর্মের মধ্যে নিহিত থাকে শান্তির নতুন স্থাপনা।

করোনায় মৃত্যু হলে, বৃহত্তর রাষ্ট্রের কথা মাথায় রেখে সেই মৃতদেহ আর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু, সে মৃত্যু যদি হয় অগুনতি! আর একটা দেশ যদি হয়, বিপুলা পৃথিবীরই একটা খন্ডিত অংশ, তবে এভাবেই বলা যায়-এ বিশ্ব আজ সমাগত সময়ের লাশভূমি।

এখানে কবি’র ভাষায়-এক সে দেশের মাটিতে পাই, কেউ গোরে কেউ শশ্মানে ঠাঁই, মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান। এই গীতিকবিতার শেষ স্তবকিত উচ্চারণ যেনো সমগ্র ভারতবর্ষের, তথা সমগ্র বাঙালির মননের অনন্ত অঙ্গন। এই অঙ্গন জুড়ে ফুটে থাকা কবি নজরুলের এক সুরে গাওয়া সমবেত প্রার্থনা সংগীত যেনো প্রস্ফুটিত শান্তির ফুল। আর, সেই ফুটন্ত হয়ে ফোটা ফুলের কারণ সুধা হলো আ-বিশ্বের বাঙালির প্রিয় একটাই কবি, কাজি নজরুল।

এই লেখাটির শুরুতে কাজি নজরুল ইসলাম এর ‘মোরা’, একই বৃন্তের দুটি কুসুম, আসলে আমরা। আমরা দেখেছি সেদিন শবদেহগুলো। এই দেখাতে একটা ঘটমান অতীত আছে। কোনো বিষয়ের বিজ্ঞানসম্মত ধারণায় অতীত থাকলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ থাকবেই। এই যেমন, সমস্ত বিশ্ব ব্যাপী কোভিড সংক্রমণের কালে টিকাকরণ নিয়ে যে সেদিন আশ্চর্যজনক উপস্থাপনা চলছিলো, তা আজকের টিকা আবিষ্কারের পরবর্তীতে কেমন যেনো একটি ছোট্ট আলোকবিন্দুর ন্যায় দেখাচ্ছে। খুলে বললে, এই যেমন, ভারতবর্ষের ২টি টিকা এখন বাজারে অপ্রতুল।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে যিনি দন্ডমুন্ডের কর্তা, সেই প্রধানমন্ত্রী গতবছরে কোভিডের কারণে লকডাউন ঘোষণা করবার প্রাক্কালে দেশের নাগরিকদের ক্ষতি যাতে না হয়, সেই জন্য জাতির উদ্দেশ্যে বললেন-সন্ধ্যাকালে ঘরবাড়ি অন্ধকার করে একটি মাত্র মোমবাতির প্রজ্জ্বলিত আলোকশিখা নিয়ে দাঁড়িয়ে মুখে শঙ্খ ফুঁ দিলে দেশ থেকে করোনা চলে যাবে।

দেশবাসীর মধ্যে আবেগের একটা কলরোল জেগেছিলো এই নিয়ে। ফলে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা পর্যন্ত আন-কাট আলোকবিন্দু ও শঙ্খ- ফুঁ কিন্তু বেজেছিলো দেশকে সামগ্রিকভাবে ভাইরাস মুক্ত করে শান্তির বার্তা দিতে এবং অবশ্য অবশ্যই তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই।

ঠিক এখানে এসেই স্মরণ করি কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতাটিকে। কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে কবি বলছেন–‘তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান, যুগযুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিতবুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।’

একজন প্রধানমন্ত্রীর ডাক, মানে কোভিডকালের তিমিররাত্রিতে দেশবাসীর কাছে কান্ডারী স্বরূপ আবেগময় বিশ্বশান্তির অমোঘ ডাক। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ডাক আর বাস্তবতা যখন একটি অবৈজ্ঞানিকতার অজ্ঞতা প্রকাশ করে দিলো, তখন ভারতবাসী মুষড়ে পরেও আত্মবলে বলিয়ান হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুরেই ঘুরে দাঁড়িয়ে কবির ভাষায় বলে উঠতে চাইলেন এবং ক্রমাগত চেয়েই যাচ্ছেন –‘কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’….

এই পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিলো ঘটমান অতীতের ইতিহাসের পাতায় জমা হওয়া একটুকরো ভারতীয় বিশ্বাস, যার নাম আক্ষরীক অর্থে চিরন্তনী উপমহাদেশীয় শান্তির জন্য জীবনের আবেগ।

কিন্তু ওই যে, যে দিন যায়, তা ভালোই যায়, আর যে দিন অনাগত ভবিষ্যতের জঠরে নিমজ্জিত, তাকে আমরা দেখিনি! কিন্তু তার রূপকল্পনা করবার চেষ্টা করার মধ্যে অপরাধটা কোথায়?

শুরুতে ঝাঁকুনি দেওয়া চিত্র-বাক্যকে পাঠক এখনও ভোলেননি নিশ্চয়ই। অতঃপরও কলম চলতে থাকুক এভাবেই-ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর দুঃখে প্রধানমন্ত্রী আবেগরুদ্ধ। তার মুখ মন্ডলে ক্যামেরা তখন জুম।

তিনি বলছেন- ‘এই ভাইরাস আমাদের আত্মজনকে’…এরপর এক গভীর নিস্তব্ধতা!! নিস্তব্ধতার অর্থ কান্না বা অপারঙ্গমতা, এটা ধরে নেওয়া যায়। তারপর বাক্য শেষ করলেন এই বলে-‘আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে’…

একটি বৃহত্তর রাষ্ট্রের ভোটের ঢেউ-এর অভিঘাত থাকেই! ঠিক যেমন কেভিডের প্রথম, দ্বিতীয় তৃতীয় ইত্যাদি ওয়েব। এক রাজ্যের ভোট পেরোতেই অন্যান্য রাজ্যের একাধিক মিউনিসিপ্যাল সহ পঞ্চায়েত ভোট আসন্ন। এমতাবস্থায় রাজনীতি ও আবেগকে পৃথকীকরণ করা হয়তো যায়না।

তবে সামনের বছরের মাঝামাঝি গোটাবিশ্বের টিকাকরণ সম্পূর্ণ করতে পাঁচহাজার কোটি ডলার লাগবে, যা সম্পূর্ণভাবে মুনাফা সহ ফেরত যোগ্য-এটা আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার কর্তৃক উন্নতশীল দেশগুলোর প্রতি ঘোষণা। আইএমএফ-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ এবং তার সহযোগী রুচির আগরওয়ালা তাদের রিপোর্টে (তথ্য-আনন্দ বাজার পত্রিকা ২২শে মে, ২০২১) বলেন-একটা লক্ষ্য মাত্রা ঠিক হয়েছে।

২০২১ সালের মধ্যে সব দেশের চল্লিশ শতাংশ মানুষের টিকাকরণ সম্পন্ন করতে হবে আর ষাট শতাংশকে দিতে হবে ২০২২এর প্রথমার্ধে। এতে অবশ্য অবশ্যই এবিশ্ব করোনা মুক্ত হবে যেমন, তেমনই ওই লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছাতে গেলে আহুত উন্নতশীল দেশগুলোর প্রত্যেকেরই আর্থিক লাভের অঙ্ক মূলধন বাদ দিয়ে যে লক্ষ কোটি টাকা ছোঁবে, তাতে পৃথিবীর উন্নতিকামী ও সুস্থ স্বাস্থ্যকামী দেশগুলোর অর্থকোষ সমৃদ্ধময় হবে। যার ফল স্বরূপ বিশ্ব শারীরিক-শান্তি নেমে আসবে, একথা আমরা ভাবতেই পারি।

এই ভাবনাতেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একধরণের জাতীয় আবেগ মিশে আছে। অতঃপর আবারও ফিরে যেতে হয় শেষ স্তবকে। –‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলো যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান। আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার’…..

আমরা আশাবাদী হতে চাই। চাই–কোভিডবিশ্ব আন্তর্জাতিক আন্তরিকতাসম্পন্ন এক বা একাধিক শাসকরূপ, কবি কাজি নজরুলের ভাষায় দক্ষ ত্রাতা হয়ে উঠে এ বিশ্বময় একটাই ধ্বনিকে উচ্চারিত করুন –

দেহ শান্তি..
দেশ শান্তি…..
মহাবিশ্ব শান্তি হি কেবলম…..

মানুষের হুঁশ আছে বলেই তো সম্মানিত যে কোনো ব্যক্তিই, তা প্রধানমন্ত্রী কিম্বা খেটে খাওয়া সাধারণ ব্যক্তির পরিচয়-তিনি একজন মানুষ। তিনি যে কোনো পরিস্থিতিতে জাতির ত্রাতা। তাই প্রশ্ন রাখা যায়-ই, যে, কোভিড কালের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কেনো আসমুদ্রহিমাচলের ত্রি-ভাগ জলধারায় এতো উথাল-পাথাল ঘনঘোর কৃষ্ণবর্ণের ঢেউ!!

যা-ই হোক না কেনো, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা রাজনৈতিক-সমাজে আবেগের একটা ট্রেন্ড আছে। যা একটা প্লাবনেরই তুল্যরূপ। এই যেমন যোদ্ধা রেড ভলান্টিয়ারেরা সারাবাংলাসহ ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে চষে বেড়াচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে । মৃতপ্রায় মানুষের কাছে জীবনীশক্তি অক্সিজেন পৌঁছে দিতে তারা বদ্ধপরিকর, তাদেরই জীবনকে বাজি রেখে। কিম্বা, রেজাউল করিম, যিনি পঞ্চায়েতের পুর্ত কর্মাধ্যক্ষ ও ধর্মীয়ভাবে বিপরীত ধর্মীয়। তবু তিনি নিতাই প্রামাণিকের সৎকার নিজের হাতে করলেন!

কেনো করলেন? কেননা, এই করোনায় মৃতকে তার আত্মীয় স্বজন না ছুঁলেও সৎকার করতেই হবে, এই সামাজিক বোধে অবিচল থেকে। তাই, সর্বশেষ লেখায় সচলায়তনকে চির সচল রাখার দাওয়াই একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই মহাবিশ্বের জীবন চলবে কেবলই জীবনের জন্য। নজরুলের কবিতার ….‘মোরা এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল, এক সে মায়ের বক্ষে ফলে একই ফুল ও ফল’…এই বোধকে না থমকে রেখে আমাদের সদা জাগরূক থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, প্রাবন্ধিক, কবি ও সংগঠক,