ঢাকা ০৮:০৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নারীস্বাস্থ্য বিবেচনায় তামাকপণ্যের কর বাড়ানো দরকার

ড. নাজনীন আহমেদ
  • আপডেট সময় : ০৮:০৮:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ জুন ২০২১ ২০৭ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে যে বিষয়টি এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হচ্ছে এই রোগ থেকে বাঁচার একটি বড় হাতিয়ার। তাই আমাদের প্রতিদিনের জীবন যাপন অভ্যাস—এগুলো দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে যতটা কম নষ্ট করা যায়, ততই বিভিন্ন রকম আকস্মিক ও কঠিন অসুস্থতা বর্জন সম্ভব হয়। আর এটি যদি একটি দেশের বেশির ভাগ মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়, তাহলে সে দেশে সুস্থ, পরিশ্রমী জাতি গড়ে ওঠে।

ফলে দেশের শ্রমশক্তির সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়ে, যা দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এই জনশক্তি অসুস্থ কম হয়, ফলে তাদের শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয় কম, আর সার্বিকভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির খরচ কম হয়। যেসব অভ্যাসের দ্বারা মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে বা নিজে থেকেই তার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট করে এবং শরীরকে অসুস্থ করে তোলায় ভূমিকা রাখে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তামাক ও তামাকজাতপণ্য সেবন।

এই তামাকজাতপণ্যের মধ্যে বিড়ি-সিগারেট প্রভৃতি যেমন আছে, তেমনি ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য, যেমন—জর্দা, গুল ইত্যাদিও রয়েছে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় তিন কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহার করে। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ নানা রকম তামাকপণ্য সেবন করে থাকে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পরিচিত ধারণা হলো, তামাকপণ্য সেবনকারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি, কারণ তামাকপণ্য বলতে সাধারণভাবে মানুষ বিড়ি-সিগারেটকে বোঝে। যদিও বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ১ শতাংশেরও কম বিড়ি-সিগারেট সেবন করে থাকে; কিন্তু নারীদের প্রায় ২৫ শতাংশ জর্দা, গুল, পানের সঙ্গে তামাকপণ্য ইত্যাদি সেবন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে শহরের নারীদের (২২ শতাংশ) তুলনায় গ্রামীণ নারীদের (২৮ শতাংশ) তামাক সেবনের প্রবণতা আরো বেশি।

বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে এবং এদের বেশির ভাগই হলো নারী। কাজেই তামাক সেবনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে নারীরা বেশ জোরেশোরেই রয়েছেন এবং নারীদের ক্ষেত্রে এই স্বাস্থ্যঝুঁকির আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, যেসব নারী তামাক সেবন অবস্থায় সন্তানের জন্ম দেন এবং সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে সন্তান ধারণ পর্যায়ে কোনো নারী যদি সিগারেট সেবন করেন কিংবা অন্য ধরনের তামাকপণ্য সেবনে থাকেন, তবে তাঁর সন্তানের জন্মের সময় ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তা ছাড়া অনেক নারীর হৃদযন্ত্র, ফুসফুসসংক্রান্ত রোগ বেঁধে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা, পাকস্থলীর নানা ধরনের রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হাড়ের দুর্বলতা নারীর জন্য স্বাভাবিক অবস্থায়ই একটি সমস্যা।

তামাক সেবন যাঁরা করেন তাঁদের এই সমস্যা আরো বেশি হয়ে থাকে। এ দেশে কিশোর-কিশোরী এবং শিশুদের মধ্যেও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া নারী ও শিশুরা পরোক্ষভাবেও তামাকের ধোঁয়া সেবনকারী হয়ে থাকে। তাই নারী, সেই সঙ্গে শিশুসন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য তাঁদের তামাকপণ্য বর্জন করা জরুরি। তা ছাড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে বলেছে যে ধূমপায়ীদের করোনা সংক্রমণের প্রবণতা অধূমপায়ীদের তুলনায় অনেক বেশি।

তা ছাড়া ধূমপায়ীদের হৃদরোগ, ফুসফুসের নানা ধরনের  রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকায় তা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে অনুভূত হচ্ছে যে ধূমপান কেন বর্জন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই ভূমিকা পালন করতে পারে তিনভাবে। ১. তামাকজাতপণ্য বিক্রির ওপর করের হার ও করকাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে এর মূল্য বৃদ্ধি করা; ২. তামাকপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের ওপর কর বাড়ানো এবং ৩. সরকারের পক্ষ থেকে ধূমপানবিরোধী নানা প্রচার-প্রচারণা চালানো।

বাংলাদেশে তামাকপণ্যের মূল্যের শতাংশ হারে (ad valorem) সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয়। এ ছাড়া সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ বিভিন্ন ধরনের তামাকপণ্যের বৈশিষ্ট্য এবং ব্র্যান্ডভেদে ভিত্তিমূল্য এবং করে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশে এখনো তামাকপণ্যের মূল্য পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে কম, যেমন—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ২.৫৩ (সর্বনিম্ন মানের) থেকে শুরু করে ৭.৬ (সর্বোচ্চ মানের) ডলার।

অথচ পাশের দেশ ভারতে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাগুলো হলো ৬.৬৪ ডলার এবং ১৬.৬ ডলার। যদিও বাংলাদেশে শতাংশের বিচারে করহার অন্য দেশের তুলনায় বেশি। কিন্তু যেহেতু ভিত্তিমূল্য কম, তাই করহার বেশি হলেও সরকারের রাজস্ব আদায় অন্য দেশের তুলনায় কম। বাংলাদেশে ২০ শলাকার সিগারেটের ওপর সম্পূরক করের হার চূড়ান্ত খুচরা মূল্যে ৭১.৫ শতাংশ (যা ভারতে ৫৪ শতাংশ) হলেও মূল্য কম হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে তত বেশি নয়। কাজেই ভিত্তিমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে বরং সম্পূরক করহার যদি কমানো হয়, তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।

প্রগতির জন্য জ্ঞান বা প্রজ্ঞা নামক সংস্থা কর্তৃক এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে যদি সব ধরনের তামাকপণ্যের ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক কর ইউনিট হিসাবে ধার্য করা যায়, তাহলে তা আদায় করা সহজ হবে। সব পণ্যের জন্য শতাংশের বিচারে একটি হার ধরে নিয়ে মূল্য অনুযায়ী যে সম্পূরক কর আসে সেটা সরাসরি ইউনিট হিসাবে ধার্য করতে হবে। এতে কর আদায় সহজ হবে। তা ছাড়া ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যকেও করের আওতায় আনতে হবে।

এসব ক্ষেত্রে কর আরোপের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। কোন ধরনের জর্দা, গুল বিক্রিতে কত কর হবে সেটি নির্ধারণ করে এগুলোর বিক্রয়কে প্যাকেটজাত করতে হবে, যাতে কর আদায় করা সম্ভব হয়। এভাবে করকাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে বৈ কমবে না। তামাকজাতপণ্যের মূল্য কম রেখে কর আদায়ের প্রচেষ্টার চেয়ে অনুরূপ পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে করকাঠামো সহজ করে কর আদায় করা গেলে তাতে রাজস্ব আদায় বাড়বে, অন্যদিকে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা কমবে।

তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম হবে এবং সরকারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় কমানো যাবে। সেই দিক থেকে আবার রাজস্ব সাশ্রয় হবে। নারীদের মধ্যে যেহেতু ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের মাত্রা বেশি। আইনবহির্ভূত বা অনিয়ন্ত্রিত উপায়ে সস্তা তামাকপণ্য, বিশেষ করে গুল, জর্দা, সাদাপাতা এবং বিড়ি উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ থাকায় এদের বেশির ভাগই সরকারের কর জালের বাইরে রয়ে গেছে।

এসব পণ্য যেহেতু মোটাদাগে সরকারের করের আওতার বাইরে রয়ে গেছে, তাই এর মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক নারী স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছেন। নারীদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সেই সঙ্গে শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং এগুলোর ওপর কর আরোপ করতে হবে। তা ছাড়া এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও মনোযোগ দিতে হবে।

নারীদের মধ্যে তামাকজাতীয় পণ্য সেবন কমাতে হলে এগুলো থেকে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি সে সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে যেভাবে ধূমপানের ক্ষতির কথা উল্লেখ করা থাকে; জর্দা, গুল কিংবা খোলা বিক্রি হওয়া সাদাপাতা—এগুলোর ব্যাপারে এই ধরনের প্রচার-প্রচারণা নেই। ধোঁয়াবিহীন যেসব তামাকপণ্য প্যাকেটজাত অবস্থায় বিক্রি হয়, সেগুলোর গায়েও তামাকপণ্য ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা উল্লেখ করতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে।

দেখা যাচ্ছে যে নারীরা যেসব তামাকপণ্য বেশি ব্যবহার করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কর সুনির্দিষ্ট না থাকায়, এগুলোর মান নিয়ন্ত্রিত না থাকায় এবং জনগণের মধ্যে এক ধরনের মানসিকতা যে এগুলোর স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই—এসব কারণে তামাকপণ্যের ব্যবহারে আসলে নারীর স্বাস্থ্য বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে এগুলো সুনির্দিষ্ট প্যাকেজিং যাতে হয় তা বাধ্যতামূলক করে এবং সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে এগুলোর ব্যবহার কমানো যেতে পারে। এতে নারীদের স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আসন্ন বাজেটে তামাকজাতপণ্যের ওপর কর আরোপের ক্ষেত্রে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে; কিন্তু সেই একই হারে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়েনি, বিশেষ করে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের মূল্য বিভিন্ন বছরের ব্যবধানে তেমন বাড়েনি বললেই চলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় (নমিনাল) পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বেড়েছে ১১.৬ শতাংশ। তামাকপণ্যের ভিত্তিমূল্য যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি কর আরোপ করলে তার কারণেও মূল্যবৃদ্ধি হবে। এর দ্বারা নতুন ভোক্তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বিশেষ করে নারীস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এই পদক্ষেপগুলো নিতে হবে।

লেখক : সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

নারীস্বাস্থ্য বিবেচনায় তামাকপণ্যের কর বাড়ানো দরকার

আপডেট সময় : ০৮:০৮:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ জুন ২০২১

বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে যে বিষয়টি এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হচ্ছে এই রোগ থেকে বাঁচার একটি বড় হাতিয়ার। তাই আমাদের প্রতিদিনের জীবন যাপন অভ্যাস—এগুলো দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে যতটা কম নষ্ট করা যায়, ততই বিভিন্ন রকম আকস্মিক ও কঠিন অসুস্থতা বর্জন সম্ভব হয়। আর এটি যদি একটি দেশের বেশির ভাগ মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়, তাহলে সে দেশে সুস্থ, পরিশ্রমী জাতি গড়ে ওঠে।

ফলে দেশের শ্রমশক্তির সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়ে, যা দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এই জনশক্তি অসুস্থ কম হয়, ফলে তাদের শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয় কম, আর সার্বিকভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির খরচ কম হয়। যেসব অভ্যাসের দ্বারা মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে বা নিজে থেকেই তার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট করে এবং শরীরকে অসুস্থ করে তোলায় ভূমিকা রাখে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তামাক ও তামাকজাতপণ্য সেবন।

এই তামাকজাতপণ্যের মধ্যে বিড়ি-সিগারেট প্রভৃতি যেমন আছে, তেমনি ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য, যেমন—জর্দা, গুল ইত্যাদিও রয়েছে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় তিন কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহার করে। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ নানা রকম তামাকপণ্য সেবন করে থাকে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পরিচিত ধারণা হলো, তামাকপণ্য সেবনকারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি, কারণ তামাকপণ্য বলতে সাধারণভাবে মানুষ বিড়ি-সিগারেটকে বোঝে। যদিও বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ১ শতাংশেরও কম বিড়ি-সিগারেট সেবন করে থাকে; কিন্তু নারীদের প্রায় ২৫ শতাংশ জর্দা, গুল, পানের সঙ্গে তামাকপণ্য ইত্যাদি সেবন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে শহরের নারীদের (২২ শতাংশ) তুলনায় গ্রামীণ নারীদের (২৮ শতাংশ) তামাক সেবনের প্রবণতা আরো বেশি।

বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে এবং এদের বেশির ভাগই হলো নারী। কাজেই তামাক সেবনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে নারীরা বেশ জোরেশোরেই রয়েছেন এবং নারীদের ক্ষেত্রে এই স্বাস্থ্যঝুঁকির আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, যেসব নারী তামাক সেবন অবস্থায় সন্তানের জন্ম দেন এবং সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে সন্তান ধারণ পর্যায়ে কোনো নারী যদি সিগারেট সেবন করেন কিংবা অন্য ধরনের তামাকপণ্য সেবনে থাকেন, তবে তাঁর সন্তানের জন্মের সময় ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তা ছাড়া অনেক নারীর হৃদযন্ত্র, ফুসফুসসংক্রান্ত রোগ বেঁধে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা, পাকস্থলীর নানা ধরনের রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হাড়ের দুর্বলতা নারীর জন্য স্বাভাবিক অবস্থায়ই একটি সমস্যা।

তামাক সেবন যাঁরা করেন তাঁদের এই সমস্যা আরো বেশি হয়ে থাকে। এ দেশে কিশোর-কিশোরী এবং শিশুদের মধ্যেও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া নারী ও শিশুরা পরোক্ষভাবেও তামাকের ধোঁয়া সেবনকারী হয়ে থাকে। তাই নারী, সেই সঙ্গে শিশুসন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য তাঁদের তামাকপণ্য বর্জন করা জরুরি। তা ছাড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে বলেছে যে ধূমপায়ীদের করোনা সংক্রমণের প্রবণতা অধূমপায়ীদের তুলনায় অনেক বেশি।

তা ছাড়া ধূমপায়ীদের হৃদরোগ, ফুসফুসের নানা ধরনের  রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকায় তা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে অনুভূত হচ্ছে যে ধূমপান কেন বর্জন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই ভূমিকা পালন করতে পারে তিনভাবে। ১. তামাকজাতপণ্য বিক্রির ওপর করের হার ও করকাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে এর মূল্য বৃদ্ধি করা; ২. তামাকপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের ওপর কর বাড়ানো এবং ৩. সরকারের পক্ষ থেকে ধূমপানবিরোধী নানা প্রচার-প্রচারণা চালানো।

বাংলাদেশে তামাকপণ্যের মূল্যের শতাংশ হারে (ad valorem) সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয়। এ ছাড়া সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ বিভিন্ন ধরনের তামাকপণ্যের বৈশিষ্ট্য এবং ব্র্যান্ডভেদে ভিত্তিমূল্য এবং করে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশে এখনো তামাকপণ্যের মূল্য পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে কম, যেমন—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ২.৫৩ (সর্বনিম্ন মানের) থেকে শুরু করে ৭.৬ (সর্বোচ্চ মানের) ডলার।

অথচ পাশের দেশ ভারতে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাগুলো হলো ৬.৬৪ ডলার এবং ১৬.৬ ডলার। যদিও বাংলাদেশে শতাংশের বিচারে করহার অন্য দেশের তুলনায় বেশি। কিন্তু যেহেতু ভিত্তিমূল্য কম, তাই করহার বেশি হলেও সরকারের রাজস্ব আদায় অন্য দেশের তুলনায় কম। বাংলাদেশে ২০ শলাকার সিগারেটের ওপর সম্পূরক করের হার চূড়ান্ত খুচরা মূল্যে ৭১.৫ শতাংশ (যা ভারতে ৫৪ শতাংশ) হলেও মূল্য কম হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে তত বেশি নয়। কাজেই ভিত্তিমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে বরং সম্পূরক করহার যদি কমানো হয়, তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।

প্রগতির জন্য জ্ঞান বা প্রজ্ঞা নামক সংস্থা কর্তৃক এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে যদি সব ধরনের তামাকপণ্যের ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক কর ইউনিট হিসাবে ধার্য করা যায়, তাহলে তা আদায় করা সহজ হবে। সব পণ্যের জন্য শতাংশের বিচারে একটি হার ধরে নিয়ে মূল্য অনুযায়ী যে সম্পূরক কর আসে সেটা সরাসরি ইউনিট হিসাবে ধার্য করতে হবে। এতে কর আদায় সহজ হবে। তা ছাড়া ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যকেও করের আওতায় আনতে হবে।

এসব ক্ষেত্রে কর আরোপের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। কোন ধরনের জর্দা, গুল বিক্রিতে কত কর হবে সেটি নির্ধারণ করে এগুলোর বিক্রয়কে প্যাকেটজাত করতে হবে, যাতে কর আদায় করা সম্ভব হয়। এভাবে করকাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে বৈ কমবে না। তামাকজাতপণ্যের মূল্য কম রেখে কর আদায়ের প্রচেষ্টার চেয়ে অনুরূপ পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে করকাঠামো সহজ করে কর আদায় করা গেলে তাতে রাজস্ব আদায় বাড়বে, অন্যদিকে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা কমবে।

তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম হবে এবং সরকারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় কমানো যাবে। সেই দিক থেকে আবার রাজস্ব সাশ্রয় হবে। নারীদের মধ্যে যেহেতু ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের মাত্রা বেশি। আইনবহির্ভূত বা অনিয়ন্ত্রিত উপায়ে সস্তা তামাকপণ্য, বিশেষ করে গুল, জর্দা, সাদাপাতা এবং বিড়ি উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ থাকায় এদের বেশির ভাগই সরকারের কর জালের বাইরে রয়ে গেছে।

এসব পণ্য যেহেতু মোটাদাগে সরকারের করের আওতার বাইরে রয়ে গেছে, তাই এর মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক নারী স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছেন। নারীদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সেই সঙ্গে শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং এগুলোর ওপর কর আরোপ করতে হবে। তা ছাড়া এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও মনোযোগ দিতে হবে।

নারীদের মধ্যে তামাকজাতীয় পণ্য সেবন কমাতে হলে এগুলো থেকে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি সে সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে যেভাবে ধূমপানের ক্ষতির কথা উল্লেখ করা থাকে; জর্দা, গুল কিংবা খোলা বিক্রি হওয়া সাদাপাতা—এগুলোর ব্যাপারে এই ধরনের প্রচার-প্রচারণা নেই। ধোঁয়াবিহীন যেসব তামাকপণ্য প্যাকেটজাত অবস্থায় বিক্রি হয়, সেগুলোর গায়েও তামাকপণ্য ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা উল্লেখ করতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে।

দেখা যাচ্ছে যে নারীরা যেসব তামাকপণ্য বেশি ব্যবহার করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কর সুনির্দিষ্ট না থাকায়, এগুলোর মান নিয়ন্ত্রিত না থাকায় এবং জনগণের মধ্যে এক ধরনের মানসিকতা যে এগুলোর স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই—এসব কারণে তামাকপণ্যের ব্যবহারে আসলে নারীর স্বাস্থ্য বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে এগুলো সুনির্দিষ্ট প্যাকেজিং যাতে হয় তা বাধ্যতামূলক করে এবং সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে এগুলোর ব্যবহার কমানো যেতে পারে। এতে নারীদের স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আসন্ন বাজেটে তামাকজাতপণ্যের ওপর কর আরোপের ক্ষেত্রে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে; কিন্তু সেই একই হারে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়েনি, বিশেষ করে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের মূল্য বিভিন্ন বছরের ব্যবধানে তেমন বাড়েনি বললেই চলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় (নমিনাল) পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বেড়েছে ১১.৬ শতাংশ। তামাকপণ্যের ভিত্তিমূল্য যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি কর আরোপ করলে তার কারণেও মূল্যবৃদ্ধি হবে। এর দ্বারা নতুন ভোক্তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বিশেষ করে নারীস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এই পদক্ষেপগুলো নিতে হবে।

লেখক : সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ