ঢাকা ১১:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চিন্তাশক্তির সঙ্গে কল্পনা শক্তিই পারে তরুণদের বদলে দিতে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:৫৯:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ ৩২৬ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

আমি তরুণদের বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। কারণ তরুণরা ঝুঁকি বা রিস্ক নিতে পারে যা অন্যরা পারেনা। তরুণদের ভিতরে অজেয়কে জয় করবার ক্ষুধা যেভাবে কাজ করে তা আর কিছুতে নেই। তরুণদের ভিতরের আবেগ, আনন্দ আর কষ্ট কান্না হয়ে যখন বৃষ্টির মতো ঝরে পরে তখন থেকেই সৃষ্টির যাত্রা শুরু হয়। এজন্য আমি সম্ভাবনাময় তরুণদের অনুপ্রাণিত মুখগুলি দেখে মনের গভীর থেকে বলি জয়তু তারুণ্য। হেলাল হাফিজের জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’;- এর দুটি পংক্তি “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ মনে করিয়ে দেয় অমিত শক্তির দুরন্ত তরুণদের কথা। সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। কথাটা বিশ্বাস হবার মতো কিনা জানিনা তবে ফেলনা নয়। তরুণদের বলবো তোমরা যদি কবিতা, গল্প কিংবা গান লিখতে পারো তবে তোমাদের চিন্তা শক্তি বাড়বে। চিন্তাশক্তি বাড়লে তোমাদের উদ্ভাবনী শক্তিও বাড়বে। প্রতিদিন নতুন নতুন ধারণা তোমাদের বিজ্ঞান ও গবেষণা চর্চায় সাফল্য নিয়ে আসবে। আবার সাহিত্য থেকেও তোমরা বিজ্ঞান ও গবেষণার ধারণা পেতে পারো।

সাহিত্যিকরা চিন্তাশক্তি আর কল্পনাশক্তি দিয়ে সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনী লিখেন। সাহিত্যের জাদুকরী শক্তি এতটাই বিস্ময়কর যার মাধ্যমে আজ যা আমাদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে হয়তো সেটাই তরুণদের অমিত সম্ভাবনার সৃজনশীল চিন্তাশক্তির মাধ্যমে আগামী দিন বাস্তবে পরিণত হবে। তরুণদের বলবো তোমরা যদি তোমাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারো তবে তোমার গবেষণা পৃথিবীকেই বদলে দেবে। পৃথিবী বদল মানে ঘুনেধরা পুরোনো প্রযুক্তির ধ্যান ধারণা বদলে ফেলে নতুন প্রযুক্তির সৃষ্টি। আলবার্ট আইনস্টাইন পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি তো বড় বড় সব গবেষণা করেছেন। কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয়, এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর কোনো ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার ছিল না। তাঁর সব বড় বড় আবিষ্কারের পেছনে মাত্র তিনটি জিনিস ছিল। এর দুটি হলো কাগজ, কলম আর সবচেয়ে বড়টি ছিল তাঁর চিন্তাশক্তি। তোমাদের বিজ্ঞান ও গবেষণা চর্চায় চিন্তাশক্তির প্রয়োগ দেখতে চাই। সায়েন্স ফিকশনের কথা বলছিলাম, কাল্পনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য।

 

এই অসম্ভব কল্পনার যুক্তিহীন সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষকেরা উদ্ভাবন করেন যুগান্তকারী সব জিনিস। লেখকের যুক্তিহীন অসম্ভব কল্পনাকে সত্যে পরিণত করার এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক। ফরাসি লেখক জুল ভার্নের টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি নামের সায়েন্স ফিকশন বইটি মার্কিন নৌবাহিনীর স্থপতি সাইমন লেককে এমনভাবে প্রেরণা যোগালো যে তিনি প্রথম ডুবোজাহাজ আবিষ্কার করে ফেললেন। ভার্নের ক্লিপার অব দ্য ক্লাউডস বইটি ইগর সিকোরস্কিকে এতটাই আকৃষ্ট করলো যে তিনি সেখানকার কল্পনা শক্তিকে চিন্তাশক্তিতে রূপান্তরিত করে আর আধুনিক হেলিকপ্টার উদ্ভাবন করে বসলেন।

আধুনিক মুঠোফোনের অগ্রদূত মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মটোরোলার গবেষণা পরিচালক মার্টিন কুপার মনে করেন, ১৯৭০-এর দশকে আধুনিক মুঠোফোন উদ্ভাবনের নেপথ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে মার্কিন টেলিভিশন সিরিজ ও চলচ্চিত্র স্টার ট্র্যাক-এ প্রদর্শিত যন্ত্র ‘কমিউনিকেটর’। এ যুগে গবেষকদের চাওয়া না পাওয়ার ঘাটতি নিয়ে সবাই যে অভিযোগ করেন, সেটি পুরপুরি সত্য না। যুক্তরাষ্ট্রের সিংগুলারিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার ডায়াম্যান্ডিস বলেন, উড়ন্ত মোটরগাড়ি (ফ্লাইং কার) আসছে। আর অসুস্থতা শনাক্তকারী যন্ত্র ‘ট্রাইকোডার’ শিগগিরই মানুষের হাতের নাগালে চলে আসবে। সিলিকন ভ্যালির অনেক ধারণা সায়েন্স ফিকশন থেকে নিয়ে অনেক গবেষক কাজ করে যাচ্ছেন। উদাহারণ হিসেবে বলা যায় গুগল এক্স ল্যাবের গবেষকেরা গুগল গ্লাস ও ফ্লাইং কার নিয়ে তাদের গবেষণা চালাচ্ছেন।

 

আর মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করেছে এলন মাস্কের স্পেস এক্স। প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে বিনিয়োগকারী জন টেইসম ধারণা করেন, সায়েন্স ফিকশনের প্রেরণায় খুব কম প্রযুক্তিপণ্যই উদ্ভাবন করা হয়েছে। তবে নতুন প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে দিতে সামর্থ হয়েছে এ ধরনের সাহিত্যকর্ম। তা ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারে ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষয়টি সায়েন্স ফিকশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, এর মাধ্যমে একটি ধারণার ভালো ও মন্দ বিষয়গুলি মানুষকে সচেতনত করে তুলে। প্রযুক্তির সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে ভাবার পরিবর্তে উদ্ভাবনেই বিজ্ঞানীদের বেশি আকৃষ্ট করে।

 

বিশ্বের রাজনৈতিক ও নৈতিক পরিবর্তেনের ফলে কল্পনা থেকে বাস্তব আবিষ্কার কতটুকু মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে, এ সংক্রান্ত বিষয়ে সাহিত্যিকদের ভাবনা ও দূরদর্শিতা বিজ্ঞানীদের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রযুক্তিবিদ জিম ওয়াল্ডোর বিপরীত মনোভাব পোষণ করে বলেন, কোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সায়েন্স ফিকশনের কখনও প্রতক্ষ্য ভূমিকা কখনো ছিল না। তবে নিজ উদ্ভাবনের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে নানামুখী ধারণা যাচাই করতে তিনি কল্পবিজ্ঞানের সহায়তা নিয়েছেন। প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল সম্পর্কে সায়েন্স ফিকশন ভাল ধারণা দিতে পারে।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইমাজিনেশনের গবেষকরা হায়ারোগ্লিফ নামের একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছেন। এতে মানুষের সামর্থ্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যৌথভাবে বিশ্লেষণমূখী কাজ করছেন বিজ্ঞানী ও কল্পবিজ্ঞানের লেখকেরা। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এড ফিন বলেন, ভবিষ্যতে মানুষকে আরও সৃজনশীল ও আরও উচ্চাভিলাষী করে সম্ভাবনার দিককে পরিপূর্ণভাবে উন্মোচন করাই তাঁদের লক্ষ্য। তরুণদের এই বিষয়গুলি নিয়ে বিভিন্নভাবে ভাবতে হবে। তরুণদের বলবো তোমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ভালো মানের জার্নালগুলো রয়েছে সেগুলো পড়তে হবে। এগুলো পড়লে তুমি জানতে পারবে বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণা কোন দিকে এগুচ্ছে। নেচার, সাইন্স আর সেল এর মতো জার্নালের মৌলিক গবেষণার আর্টিকেলগুলো পড়লে তোমার চিন্তা শক্তি তোমাকে বিজ্ঞানের অসম্ভবকে সম্ভব করার মনোবল যোগাবে।

 

তোমার মধ্যে সুপ্ত ও ঘুমন্ত একজন বিজ্ঞানীকে জাগিয়ে তুলবে। তোমাকে বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণায় অনুপ্রেরণা যোগাবে। মৌলিক গবেষণা হচ্ছে এমন এক গবেষণা যার মাধ্যমে তুমি যা সৃষ্টি করলে তা হয়তো আগে কেউ কখনো তেমনভাবে ভাবেনি। তবে আমি বলবো মৌলিক গবেষণা করার আগে ফলিত গবেষণাটাই করা বেশি দরকার। তরুণদের বলবো বিজ্ঞান ও গবেষণা চর্চার মাধ্যমে তোমাদের ভালোমানের জার্নালে তোমাদের গবেষণার ফলাফলগুলো প্রকাশ করতে হবে। গবেষণাপত্র খুব উঁচু মানের জার্নালে প্রকাশ করা এতো সহজ নয়। বার বার বিভিন্ন জার্নালে তোমার গবেষণাপত্র পাঠিয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। কিন্তু এতে হতাশ হলে চলবেনা। বরং তোমার গবেষণার সীমাবদ্ধতা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে ততো বেশি তুমি সেই সীমাবদ্ধতাগুলো জেনে গবেষণাকে সফল করে তুলতে হবে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার (১৯৫৩) পান জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিৎসক ও প্রাণরসায়নবিদ হ্যান্স অ্যাডলফ ক্রেবস। তিনি ইউরিয়া চক্র এবং সাইট্রিক এসিড চক্র আবিষ্কার করেন। তাঁর নামে সাইট্রিক চক্রের নামকরণ করা হয় ‘ক্রেবস সার্কেল’। ক্রেবসকে এই গবেষণাপত্রটি প্রথমবার প্রকাশের ক্ষেত্রে অপারগতা জানিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়কি ‘নেচার’ চিঠি পাঠিয়েছিল এবং পরেরবারের জন্য চেষ্টা করতে বলেছিল। তিনি এতে ভেঙ্গে তা পরে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন বলেই নোবেল পুরুস্কার তার ভাগ্যে জুটেছিল। তরুণদেরও এই ধরনের ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট ও লেখক,
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

চিন্তাশক্তির সঙ্গে কল্পনা শক্তিই পারে তরুণদের বদলে দিতে

আপডেট সময় : ০৯:৫৯:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

আমি তরুণদের বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। কারণ তরুণরা ঝুঁকি বা রিস্ক নিতে পারে যা অন্যরা পারেনা। তরুণদের ভিতরে অজেয়কে জয় করবার ক্ষুধা যেভাবে কাজ করে তা আর কিছুতে নেই। তরুণদের ভিতরের আবেগ, আনন্দ আর কষ্ট কান্না হয়ে যখন বৃষ্টির মতো ঝরে পরে তখন থেকেই সৃষ্টির যাত্রা শুরু হয়। এজন্য আমি সম্ভাবনাময় তরুণদের অনুপ্রাণিত মুখগুলি দেখে মনের গভীর থেকে বলি জয়তু তারুণ্য। হেলাল হাফিজের জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’;- এর দুটি পংক্তি “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ মনে করিয়ে দেয় অমিত শক্তির দুরন্ত তরুণদের কথা। সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। কথাটা বিশ্বাস হবার মতো কিনা জানিনা তবে ফেলনা নয়। তরুণদের বলবো তোমরা যদি কবিতা, গল্প কিংবা গান লিখতে পারো তবে তোমাদের চিন্তা শক্তি বাড়বে। চিন্তাশক্তি বাড়লে তোমাদের উদ্ভাবনী শক্তিও বাড়বে। প্রতিদিন নতুন নতুন ধারণা তোমাদের বিজ্ঞান ও গবেষণা চর্চায় সাফল্য নিয়ে আসবে। আবার সাহিত্য থেকেও তোমরা বিজ্ঞান ও গবেষণার ধারণা পেতে পারো।

সাহিত্যিকরা চিন্তাশক্তি আর কল্পনাশক্তি দিয়ে সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনী লিখেন। সাহিত্যের জাদুকরী শক্তি এতটাই বিস্ময়কর যার মাধ্যমে আজ যা আমাদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে হয়তো সেটাই তরুণদের অমিত সম্ভাবনার সৃজনশীল চিন্তাশক্তির মাধ্যমে আগামী দিন বাস্তবে পরিণত হবে। তরুণদের বলবো তোমরা যদি তোমাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারো তবে তোমার গবেষণা পৃথিবীকেই বদলে দেবে। পৃথিবী বদল মানে ঘুনেধরা পুরোনো প্রযুক্তির ধ্যান ধারণা বদলে ফেলে নতুন প্রযুক্তির সৃষ্টি। আলবার্ট আইনস্টাইন পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি তো বড় বড় সব গবেষণা করেছেন। কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয়, এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর কোনো ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার ছিল না। তাঁর সব বড় বড় আবিষ্কারের পেছনে মাত্র তিনটি জিনিস ছিল। এর দুটি হলো কাগজ, কলম আর সবচেয়ে বড়টি ছিল তাঁর চিন্তাশক্তি। তোমাদের বিজ্ঞান ও গবেষণা চর্চায় চিন্তাশক্তির প্রয়োগ দেখতে চাই। সায়েন্স ফিকশনের কথা বলছিলাম, কাল্পনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য।

 

এই অসম্ভব কল্পনার যুক্তিহীন সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষকেরা উদ্ভাবন করেন যুগান্তকারী সব জিনিস। লেখকের যুক্তিহীন অসম্ভব কল্পনাকে সত্যে পরিণত করার এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক। ফরাসি লেখক জুল ভার্নের টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি নামের সায়েন্স ফিকশন বইটি মার্কিন নৌবাহিনীর স্থপতি সাইমন লেককে এমনভাবে প্রেরণা যোগালো যে তিনি প্রথম ডুবোজাহাজ আবিষ্কার করে ফেললেন। ভার্নের ক্লিপার অব দ্য ক্লাউডস বইটি ইগর সিকোরস্কিকে এতটাই আকৃষ্ট করলো যে তিনি সেখানকার কল্পনা শক্তিকে চিন্তাশক্তিতে রূপান্তরিত করে আর আধুনিক হেলিকপ্টার উদ্ভাবন করে বসলেন।

আধুনিক মুঠোফোনের অগ্রদূত মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মটোরোলার গবেষণা পরিচালক মার্টিন কুপার মনে করেন, ১৯৭০-এর দশকে আধুনিক মুঠোফোন উদ্ভাবনের নেপথ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে মার্কিন টেলিভিশন সিরিজ ও চলচ্চিত্র স্টার ট্র্যাক-এ প্রদর্শিত যন্ত্র ‘কমিউনিকেটর’। এ যুগে গবেষকদের চাওয়া না পাওয়ার ঘাটতি নিয়ে সবাই যে অভিযোগ করেন, সেটি পুরপুরি সত্য না। যুক্তরাষ্ট্রের সিংগুলারিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার ডায়াম্যান্ডিস বলেন, উড়ন্ত মোটরগাড়ি (ফ্লাইং কার) আসছে। আর অসুস্থতা শনাক্তকারী যন্ত্র ‘ট্রাইকোডার’ শিগগিরই মানুষের হাতের নাগালে চলে আসবে। সিলিকন ভ্যালির অনেক ধারণা সায়েন্স ফিকশন থেকে নিয়ে অনেক গবেষক কাজ করে যাচ্ছেন। উদাহারণ হিসেবে বলা যায় গুগল এক্স ল্যাবের গবেষকেরা গুগল গ্লাস ও ফ্লাইং কার নিয়ে তাদের গবেষণা চালাচ্ছেন।

 

আর মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করেছে এলন মাস্কের স্পেস এক্স। প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে বিনিয়োগকারী জন টেইসম ধারণা করেন, সায়েন্স ফিকশনের প্রেরণায় খুব কম প্রযুক্তিপণ্যই উদ্ভাবন করা হয়েছে। তবে নতুন প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে দিতে সামর্থ হয়েছে এ ধরনের সাহিত্যকর্ম। তা ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারে ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষয়টি সায়েন্স ফিকশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, এর মাধ্যমে একটি ধারণার ভালো ও মন্দ বিষয়গুলি মানুষকে সচেতনত করে তুলে। প্রযুক্তির সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে ভাবার পরিবর্তে উদ্ভাবনেই বিজ্ঞানীদের বেশি আকৃষ্ট করে।

 

বিশ্বের রাজনৈতিক ও নৈতিক পরিবর্তেনের ফলে কল্পনা থেকে বাস্তব আবিষ্কার কতটুকু মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে, এ সংক্রান্ত বিষয়ে সাহিত্যিকদের ভাবনা ও দূরদর্শিতা বিজ্ঞানীদের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রযুক্তিবিদ জিম ওয়াল্ডোর বিপরীত মনোভাব পোষণ করে বলেন, কোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সায়েন্স ফিকশনের কখনও প্রতক্ষ্য ভূমিকা কখনো ছিল না। তবে নিজ উদ্ভাবনের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে নানামুখী ধারণা যাচাই করতে তিনি কল্পবিজ্ঞানের সহায়তা নিয়েছেন। প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল সম্পর্কে সায়েন্স ফিকশন ভাল ধারণা দিতে পারে।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইমাজিনেশনের গবেষকরা হায়ারোগ্লিফ নামের একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছেন। এতে মানুষের সামর্থ্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যৌথভাবে বিশ্লেষণমূখী কাজ করছেন বিজ্ঞানী ও কল্পবিজ্ঞানের লেখকেরা। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এড ফিন বলেন, ভবিষ্যতে মানুষকে আরও সৃজনশীল ও আরও উচ্চাভিলাষী করে সম্ভাবনার দিককে পরিপূর্ণভাবে উন্মোচন করাই তাঁদের লক্ষ্য। তরুণদের এই বিষয়গুলি নিয়ে বিভিন্নভাবে ভাবতে হবে। তরুণদের বলবো তোমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ভালো মানের জার্নালগুলো রয়েছে সেগুলো পড়তে হবে। এগুলো পড়লে তুমি জানতে পারবে বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণা কোন দিকে এগুচ্ছে। নেচার, সাইন্স আর সেল এর মতো জার্নালের মৌলিক গবেষণার আর্টিকেলগুলো পড়লে তোমার চিন্তা শক্তি তোমাকে বিজ্ঞানের অসম্ভবকে সম্ভব করার মনোবল যোগাবে।

 

তোমার মধ্যে সুপ্ত ও ঘুমন্ত একজন বিজ্ঞানীকে জাগিয়ে তুলবে। তোমাকে বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণায় অনুপ্রেরণা যোগাবে। মৌলিক গবেষণা হচ্ছে এমন এক গবেষণা যার মাধ্যমে তুমি যা সৃষ্টি করলে তা হয়তো আগে কেউ কখনো তেমনভাবে ভাবেনি। তবে আমি বলবো মৌলিক গবেষণা করার আগে ফলিত গবেষণাটাই করা বেশি দরকার। তরুণদের বলবো বিজ্ঞান ও গবেষণা চর্চার মাধ্যমে তোমাদের ভালোমানের জার্নালে তোমাদের গবেষণার ফলাফলগুলো প্রকাশ করতে হবে। গবেষণাপত্র খুব উঁচু মানের জার্নালে প্রকাশ করা এতো সহজ নয়। বার বার বিভিন্ন জার্নালে তোমার গবেষণাপত্র পাঠিয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। কিন্তু এতে হতাশ হলে চলবেনা। বরং তোমার গবেষণার সীমাবদ্ধতা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে ততো বেশি তুমি সেই সীমাবদ্ধতাগুলো জেনে গবেষণাকে সফল করে তুলতে হবে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার (১৯৫৩) পান জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিৎসক ও প্রাণরসায়নবিদ হ্যান্স অ্যাডলফ ক্রেবস। তিনি ইউরিয়া চক্র এবং সাইট্রিক এসিড চক্র আবিষ্কার করেন। তাঁর নামে সাইট্রিক চক্রের নামকরণ করা হয় ‘ক্রেবস সার্কেল’। ক্রেবসকে এই গবেষণাপত্রটি প্রথমবার প্রকাশের ক্ষেত্রে অপারগতা জানিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়কি ‘নেচার’ চিঠি পাঠিয়েছিল এবং পরেরবারের জন্য চেষ্টা করতে বলেছিল। তিনি এতে ভেঙ্গে তা পরে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন বলেই নোবেল পুরুস্কার তার ভাগ্যে জুটেছিল। তরুণদেরও এই ধরনের ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট ও লেখক,
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।