চলার শক্তি ‘মা’ নারী শক্তি জয়িতা
- আপডেট সময় : ১০:৪৩:২২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২১ ৩০২ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
তাঁরা নিজেদের আলোয় আলোকিত করে সমাজের মলিনতা দূর করেছেন। শুভবোধের সারথী হয়ে পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলেছেন। নারীই ঈশ্বর! হ্যাঁ, কেন নয়, বলুনতো? নারী আমার ‘মা’, দেশ আমার ‘মা’, সহদোরা, স্ত্রী এবং পথ চলার “শক্তি” হচ্ছে নারী। সেই তিনিইতো ঈশ্বর। তাতে অবাক হবার কি আছে? যুক্তি তুলে ধরবার প্রয়োজন রয়েছে বলেও সমাজচিন্তকরা মনে করেন না। কারণ, নারী জাতিই আমাদের সকল প্রেরণার মন্ত্র। তাই নারী-ই ঈশ্বর, তা বার বার প্রমাণিত। এই বিশ্বাসটি আরও মজবুত করে তোলেন, লাভলী ইয়াসমিন, ড. মুসলিমা মুন, রাবেয়া বেগম, সানজিদা রহমান আদরী এবং অঞ্জনা বালা বিশ্বাসেরা।
বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু
বিষয়ক মন্ত্রকের উদ্যোগ
বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রক চলতি বছরে নানা ক্যাটাগরিতে দেশের পাঁচজন আলোকিত নারীকে পুরষ্কৃত করেছে। সমাজে নানাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য খুলনা বিভাগের পাঁচ নারী (মা) নিজেরদের প্রতিভায়ই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধীষ্ঠিত হয়েছেন। এই আলোকিত নারীদের গল্প সমাজকে শুধু আলোকিতই করেনা, নারী সমাজকে সকল বাধাবিপত্তি ডিঙ্গিয়ে সাম্মুখে এগিয়ে যাবার মন্ত্র শেখায়। তারাই আমাদের সমাজে শুভবোধের সারথী। তাদের হাত ধরেই সমাজের মলিনতা দূর হয়। এমন পাঁচ নারীর একজন লাভলী ইয়াসমিন।
সম্মুখে যুদ্ধে জয়ী লাভলী
২০০১ সালের কথা। অকস্মাত চাকরী হারান স্বামী। দু’চোখের সামনে তখন ঘোর আন্ধকার! সংসারে স্কুল পড়ুয়া সন্তান। এযেন বালির পাহাড়ের ধ্বস নামার সামিল। কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি তিনি। নিজের মানুষিক শক্তি এবং নিজ উদ্যোগে মাছ চাষে লেগে যান লাভলী ইয়াসমিন। এ পর্যায়ে মহিলা বিষয়ক অফিস এবং পরবর্তীতে যুব উন্নয়ন অফিস থেকে ঋণ পান। এরপরই মৎস্য অফিস তার পাশে দাঁড়ায়। সেখান থেকে লাখ টাকার ঋণ পাবার পর পায়ের তলার মাটি আরও পোক্ত হয়। এভাবেই ঝিনাইদহের গল্প হয়ে ওঠেন লাভলী ইয়াসমিন। সেই লাভলী ইয়াসমিনই আজ ঝিনাইদহের উত্তরকাষ্ট সাগরা গ্রামের মাটিকে ধন্য করেছেন। গ্রামের সাধারণ এক গৃহিনী থেকে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী লাভলী ইয়াসমীন এখন ঝিনাইদহের ঘরে ঘরে আলোচিত।
অঞ্জনা বালা বিশ্বাস
১৯৭১’র কালো দিনে স্বামী-সন্তানসহ পাকিস্তানী বাহিনীর জারজ সন্তান রাজাকার-আলবদররা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় অঞ্জনা বালা বিশ্বাসকে। এরপর ধারাবাহিক শারীরিক নির্যাতন। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে নির্যাতনের ক্ষতকে শক্তি পরিণত করেন। সংকল্প নিলেন, যতদিন বর্বর পাকিস্তানি এবং এদেশীয় কুলাঙ্গারদের কবল থেকে দেশ মুক্ত না হবে, তত দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবেন। অঞ্জনা বালার নেওয়া ছিলো সিভিল ডিফেন্স প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ। তাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় তেমন বেগ পেতে হয়নি তাকে। খুলনার ডুমুরিয়া রূপরামপুরের অঞ্জনার জন্ম ১৯৪৬ সালে। আমাদের সমাজে অঞ্জনা বালা হচ্ছে উদাহরণের এক বাতিঘর। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি যতদিন থাকবে, ততদিন অঞ্জনা বালা বিশ্বাসের এই অসামান্য অবদান অমলিন থাকবে।
ড. শেখ মুসলিমা মুন
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন বাবা। মায়ের স্বল্পআয়ের অর্থে চার ভাইবোনকে নিদারুন কষ্টের মধ্যে লেখাপড়া করতে হয়েছে। বিয়ের পরও লেখাপড়ার ইচ্ছেটা বাতিল করতে পারেননি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিভিএম (ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন) ডিগ্রি অর্জন করেন। সংসার ও সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি সামনে এগিয়ে যাবার মন্ত্র থেকে পিছু হঠেননি। ১৯তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রাণিসম্পদ ক্যাডারে যোগ দেন। ২০০৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপটে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় লিঙ্গীয় সম্পর্ক ও নারী ক্ষমতায়ন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকায় বাংলাদেশ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে কর্মরত। শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম ড. শেখ মুসলিমা মুন। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার রামনগর এলাকার আলোকিত নারী তিনি।
সানজিদা রহমান আদরী
২০০১ সালটি তার জীবনের কালো অধ্যায়। সেবার কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলো আদরী। সেই সময় বখাটেদের অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন আদরী। ঘাড় থেকে শরীরের বামপাশ বেয়ে কোমড় পর্যন্ত অ্যাসিডে ঝলসে যায়। দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে বাবার আদরের ফুটফুটে আদরী। বাবা গগন বিদারী চিৎকারেও সেদিন জাগাতে পারেননি সমাজের বিবেক! এতো বড় সর্নাশ যারা করল বরং তারাই উল্টো শাসানিতে স্তব্ধ হয়ে গেল প্রতিবাদ। টানা প্রায় ছয় মাস চিকিৎসার শেষে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেন বাবা। মামলা করায় জীবননাশের হুমকিতে পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে মামলা তুলে নিলেন আদরীর অসহায় বাবা। নেপথ্যে হাসলো সমাজপথিরা। কিন্তু হাল ছাড়েনি আদরী। পাষন্ডদের মুখে লাথি মেরে ফের কলেজে ভর্তি হলেন সানজিদা রহমান আদরী।
তবে, তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ব্র্যাকের সামাজিক কর্মসূচির আওতায় গঠিত পল্লী সমাজ। মূলত এই কর্মসূচির অনুপ্রেরণায়ই বিভীষিকাময় সব স্মৃতিকে মারিয়ে শিরদাড়া টান করে কলেজের পথে পা বাড়ান। এরপর ২০১৪ সালে সবাইকে তাক লাগিয়ে স্নাতক পাশ করেন। নড়াইল পৌরসভার টিকাদান কর্মসূচিতে নড়াইল সদর হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন সানজিদা রহমান আদরী। সমাজপতিদের চোখ রাঙানি এবং বখাটে পাষান্ডদের সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে সানজিদা এখন সফল। কোথাও অ্যাসিডে সন্ত্রাসের খবর পেলেই ছুটে যান। যথাসম্ভব সহায়তা করেন নির্যাতিতকে। নড়াইল সদরের সীমাখালী গ্রামের বাসিন্দা সানজিদা রহমান আদরী সমাজে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সফল জননী রাবেয়া বেগম
রাবেয়া বেগমের বয়স ৬১ বছর। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার শিবসা ব্রিজ রোড এলাকার বাতিখালীর বাসিন্দা একজন সফল জননী। স্বামী ছিলেন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। সংসারে আর্থিক অনটন পিছু ছাড়েনি। এ অবস্থায় সন্তানদের লেখাপড়া এবং সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। অজ্ঞতা সংসারে দৈন্য গোছাতে বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ শুরু করেন। এরপর বাড়ির পাশের ছোট পুকুরে মাছ চাষে হাত লাগান। নিজের উৎপাদিত সবজি, মাছ, মাংস, ডিমে সংসারের চাহিদা মিটিয়েও তিনি বিক্রি শুরু করেন। সেই টাকা ব্যয় করেছেন সন্তানদের লেখাপড়ায়। রাবেয়া বেগমের যুদ্ধটা থেমেছে, তাঁর চার সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
উল্লেখ্য, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের নানামুখী কর্মকান্ডের মধ্যে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রম একটি। জয়িতা হচ্ছে সমাজের সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীর একটি প্রতিকী নাম। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রকের দিক নির্দেশনায় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রতিবছর আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর হতে ১০ ডিসেম্বর) এবং বেগম রোকেয়া দিবস (৯ ডিসেম্বর) উৎযাপন কালে দেশব্যাপী “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক একটি অভিনব প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে। সমগ্র সমাজ নারী বান্ধব হবে এবং এতে করে সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ত্বরান্বিত করবে এই স্লোগানকে সামনে রেখে কার্যক্রমটি শুরু করা হয়েছে। যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃণমূলের সফল নারী তথা জয়িতাদের অনুপ্রানিত কর আসছে।