ঢাকা ১২:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গণহত্যার দায় থেকে পাকিস্তান রক্ষা পাবে না

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৫৫:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১ ২১৬ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা পালন করছি। করোনার সীমাবদ্ধতা না থাকলে উৎসবের পরিধি ও জাঁকজমকতা আরো ব্যাপক হতে পারত। তার পরও একমাত্র পাকিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সরকারপ্রধানরা ১৭ থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ঢাকায় আসছেন। তাঁরা সবাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বাংলাদেশের অদম্য সংগ্রামী শক্তির ভূয়সী প্রশংসা করছেন। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সেক্টরে একটানা বিস্ময়কর উন্নতি-সমৃদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন, বিশ্বের সব প্রান্তের পিছিয়ে পড়া জাতির জন্য বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। মার্চ মাসের ১১ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ তাঁর লেখার হেডলাইন করেছেন, দারিদ্র্য দূর করতে চাইলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।

বাংলাদেশ একাত্তরে যখন পাকিস্তানি শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়, তখন পাকিস্তানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সেক্টরের সব সূচক সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ছিল। আজ ৫০ বছরের মাথায় এসে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত, সব সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দুই-তিন গুণ বেশি। পাকিস্তানের কিছু রাজনৈতিক ও সুধীসমাজের ব্যক্তিরা প্রকাশ্য মিডিয়ায় বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মতো উন্নতি চাই। কিন্তু পাকিস্তানের সব কিছু যারা নিয়ন্ত্রণ করে সেই মিলিটারি ও মোল্লা গোষ্ঠী একাত্তরের মতো গোঁ ধরে বসে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য গণহত্যার বিচারসহ যা যা করা দরকার, সেগুলোর কিছুই তারা করছে না।

১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক ও তাদের নতুন প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক পক্ষের দ্বিজাতিতত্ত্বের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান ভেবেছিল বাঙালিরা একাত্তরের কথা ভুলে গেছে। কিন্তু যে ভয়াবহ গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ তারা চালিয়েছে সেটি কেউ কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবে না, তা ভুলে যাওয়ার নয়। মানবতার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই গণহত্যার অকাট্য দালিলিক প্রমাণ এখন বিশ্বসম্প্রদায়সহ সব মানুষের মুঠোর মধ্যে। প্রসঙ্গক্রমে কিছু দালিলিক প্রমাণ তুলে ধরি।

kalerkantho২৫ মার্চ শুরু হওয়া গণহত্যার অন্যতম কালপ্রিট ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা কর্তৃক লিখিত—‘A Stranger in my own country’ গ্রন্থের ভূমিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, We exploited East Pakistan and when the people rose demanding their right of self determination, the Pakistan military then in power retaliated with genocide. আরেক পাকিস্তানি অফিসার ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক ‘witness to surrender’ ৭৭ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে শেরেবাংলানগরে অবস্থিত নিজের কমান্ড পোস্ট থেকে বাইরে এসে শহরের দিকে তাকিয়ে জেনারেল টিক্কা খান বিদ্রুপের হাসিতে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরে কয়েকটি নেড়ি কুত্তা ছাড়া মানুষজন আছে বলে তো মনে হয় না।’ ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তান আর্মির অপারেশন প্রস্তুতির ভয়ংকর যুদ্ধংদেহী মনোভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে উপরোক্ত বইয়ের ৭২ পৃষ্ঠায় লেখক লিখেছেন, The setting was perfect for anything but a bloody holocaust. জেনারেল নিয়াজি তাঁর নিজের লেখা—‘The betrayal of East Pakistan’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে বলছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।’

গণহত্যার অন্যতম ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনাকারী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজের গা বাঁচানোর জন্য হামুদুর রহমান তদন্ত কমিটির কাছে বলেছেন, লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে বাঙালি অফিসারসহ ১৯৫ জন নিরীহ মানুষকে স্রেফ জবাই করা হয়। সালদা নদী এলাকায় ৫০০ জনকে হত্যা করা হয়। ৬৫ হাজার গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্দয়ভাবে ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।

প্রখ্যাত গণহত্যা গবেষক লিও কুপার ‘জেনোসাইড’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটির প্রচ্ছদেই উল্লেখ আছে ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ায় গণহত্যার শিকার হয় আট লাখ মানুষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬০ লাখ ইহুদি এবং একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ। ১৯৭২ সালে জানুয়ারির ৩ তারিখে তৎকালীন সোভিয়েতের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা প্রাভদা প্রকাশ করে, বাংলাদেশে ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। লন্ডনের মর্নিং নিউজ ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রকাশ করে, গত ৯ মাসে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। এ পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার, যারা তখন বাংলাদেশে নিয়োজিত ছিল তাদের লিখিত দলিল, পাকিস্তানের তদন্ত কমিশনের প্রদত্ত তথ্য এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও সংস্থার সূত্রগুলো তুলে ধরলাম, যাতে স্পষ্টই পাকিস্তানের গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়।

তারপর একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে অপারেশন শুরু করে, যার সাংকেতিক নাম অপারেশন সার্চলাইট, যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বেসামরিক এলাকায় নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের লিখিত আদেশ জারি করা হয়। আদেশনামায় টার্গেট হিসেবে উল্লেখ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও শিক্ষকদের বাসস্থান। ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইভাবে শাঁখারীবাজারসহ ঢাকার অন্যান্য বেসামরিক আবাসিক এলাকায় আলাদা আলাদা সেনাদলকে আক্রমণ চালানোর জন্য সুনির্দিষ্ট লিখিত আদেশ দেওয়া হয়, যার উল্লেখ রয়েছে অপারেশন সার্চলাইটের আদেশনামায়। এক রাতেই শাঁখারীবাজারে নিহত হয় প্রায় আট হাজার মানুষ। চকবাজারসহ ঢাকা শহরের অন্যান্য এলাকায়ও একই রকম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। পুরান ঢাকায় প্রধানত টার্গেট করা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে।

ঘুমন্ত নারী, শিশুসহ ঘরবাড়িতে গানপাউডারের মাধ্যমে আগুন দেওয়া হয়। বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে সারা রাত দাউদাউ করে পুরান ঢাকায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে। ইকবাল হলে প্রথম ধাক্কায়ই প্রায় ২০০ জন ছাত্র নিহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোবিন্দ্র চন্দ্র দেবসহ এক ডজনের ওপর শিক্ষককে ওই এক রাতেই হত্যা করা হয়।

বেসামরিক মানুষের ওপর এমন সমন্বিত অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বের আর কোথাও হয়নি। যুদ্ধ সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশনের প্রারম্ভে বলা হয়েছে, Even wars have limit, civilian should never be targetted. জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধরত বাহিনীকে ১০টি রুলস বা বিধি মান্য করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, যেখানে তিনটি বিধির মাধ্যমে বিশেষভাবে বেসামরিক মানুষের জন্য রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে এক নম্বর—Prohibit targeting civilians. Doing so is a war crime. বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী লিখিত আদেশ দ্বারা গণহত্যা চালায়, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক কনভেশন অনুযায়ী গণহত্যার অপরাধ কখনো তামাদি হয় না এবং কোনো রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষ এটাকে ক্ষমা করে দিতে পারে না। সুতরাং গণহত্যার দায় থেকে পাকিস্তানের রক্ষা নেই; রক্ষা পাবে না। কালের কণ্ঠের সৌজন্যে

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published.

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

গণহত্যার দায় থেকে পাকিস্তান রক্ষা পাবে না

আপডেট সময় : ১০:৫৫:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা পালন করছি। করোনার সীমাবদ্ধতা না থাকলে উৎসবের পরিধি ও জাঁকজমকতা আরো ব্যাপক হতে পারত। তার পরও একমাত্র পাকিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সরকারপ্রধানরা ১৭ থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ঢাকায় আসছেন। তাঁরা সবাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বাংলাদেশের অদম্য সংগ্রামী শক্তির ভূয়সী প্রশংসা করছেন। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সেক্টরে একটানা বিস্ময়কর উন্নতি-সমৃদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন, বিশ্বের সব প্রান্তের পিছিয়ে পড়া জাতির জন্য বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। মার্চ মাসের ১১ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ তাঁর লেখার হেডলাইন করেছেন, দারিদ্র্য দূর করতে চাইলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।

বাংলাদেশ একাত্তরে যখন পাকিস্তানি শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়, তখন পাকিস্তানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সেক্টরের সব সূচক সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ছিল। আজ ৫০ বছরের মাথায় এসে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত, সব সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দুই-তিন গুণ বেশি। পাকিস্তানের কিছু রাজনৈতিক ও সুধীসমাজের ব্যক্তিরা প্রকাশ্য মিডিয়ায় বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মতো উন্নতি চাই। কিন্তু পাকিস্তানের সব কিছু যারা নিয়ন্ত্রণ করে সেই মিলিটারি ও মোল্লা গোষ্ঠী একাত্তরের মতো গোঁ ধরে বসে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য গণহত্যার বিচারসহ যা যা করা দরকার, সেগুলোর কিছুই তারা করছে না।

১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক ও তাদের নতুন প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক পক্ষের দ্বিজাতিতত্ত্বের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান ভেবেছিল বাঙালিরা একাত্তরের কথা ভুলে গেছে। কিন্তু যে ভয়াবহ গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ তারা চালিয়েছে সেটি কেউ কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবে না, তা ভুলে যাওয়ার নয়। মানবতার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই গণহত্যার অকাট্য দালিলিক প্রমাণ এখন বিশ্বসম্প্রদায়সহ সব মানুষের মুঠোর মধ্যে। প্রসঙ্গক্রমে কিছু দালিলিক প্রমাণ তুলে ধরি।

kalerkantho২৫ মার্চ শুরু হওয়া গণহত্যার অন্যতম কালপ্রিট ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা কর্তৃক লিখিত—‘A Stranger in my own country’ গ্রন্থের ভূমিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, We exploited East Pakistan and when the people rose demanding their right of self determination, the Pakistan military then in power retaliated with genocide. আরেক পাকিস্তানি অফিসার ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক ‘witness to surrender’ ৭৭ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে শেরেবাংলানগরে অবস্থিত নিজের কমান্ড পোস্ট থেকে বাইরে এসে শহরের দিকে তাকিয়ে জেনারেল টিক্কা খান বিদ্রুপের হাসিতে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরে কয়েকটি নেড়ি কুত্তা ছাড়া মানুষজন আছে বলে তো মনে হয় না।’ ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তান আর্মির অপারেশন প্রস্তুতির ভয়ংকর যুদ্ধংদেহী মনোভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে উপরোক্ত বইয়ের ৭২ পৃষ্ঠায় লেখক লিখেছেন, The setting was perfect for anything but a bloody holocaust. জেনারেল নিয়াজি তাঁর নিজের লেখা—‘The betrayal of East Pakistan’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে বলছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।’

গণহত্যার অন্যতম ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনাকারী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজের গা বাঁচানোর জন্য হামুদুর রহমান তদন্ত কমিটির কাছে বলেছেন, লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে বাঙালি অফিসারসহ ১৯৫ জন নিরীহ মানুষকে স্রেফ জবাই করা হয়। সালদা নদী এলাকায় ৫০০ জনকে হত্যা করা হয়। ৬৫ হাজার গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্দয়ভাবে ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।

প্রখ্যাত গণহত্যা গবেষক লিও কুপার ‘জেনোসাইড’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটির প্রচ্ছদেই উল্লেখ আছে ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ায় গণহত্যার শিকার হয় আট লাখ মানুষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬০ লাখ ইহুদি এবং একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ। ১৯৭২ সালে জানুয়ারির ৩ তারিখে তৎকালীন সোভিয়েতের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা প্রাভদা প্রকাশ করে, বাংলাদেশে ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। লন্ডনের মর্নিং নিউজ ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রকাশ করে, গত ৯ মাসে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। এ পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার, যারা তখন বাংলাদেশে নিয়োজিত ছিল তাদের লিখিত দলিল, পাকিস্তানের তদন্ত কমিশনের প্রদত্ত তথ্য এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও সংস্থার সূত্রগুলো তুলে ধরলাম, যাতে স্পষ্টই পাকিস্তানের গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়।

তারপর একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে অপারেশন শুরু করে, যার সাংকেতিক নাম অপারেশন সার্চলাইট, যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বেসামরিক এলাকায় নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের লিখিত আদেশ জারি করা হয়। আদেশনামায় টার্গেট হিসেবে উল্লেখ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও শিক্ষকদের বাসস্থান। ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইভাবে শাঁখারীবাজারসহ ঢাকার অন্যান্য বেসামরিক আবাসিক এলাকায় আলাদা আলাদা সেনাদলকে আক্রমণ চালানোর জন্য সুনির্দিষ্ট লিখিত আদেশ দেওয়া হয়, যার উল্লেখ রয়েছে অপারেশন সার্চলাইটের আদেশনামায়। এক রাতেই শাঁখারীবাজারে নিহত হয় প্রায় আট হাজার মানুষ। চকবাজারসহ ঢাকা শহরের অন্যান্য এলাকায়ও একই রকম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। পুরান ঢাকায় প্রধানত টার্গেট করা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে।

ঘুমন্ত নারী, শিশুসহ ঘরবাড়িতে গানপাউডারের মাধ্যমে আগুন দেওয়া হয়। বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে সারা রাত দাউদাউ করে পুরান ঢাকায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে। ইকবাল হলে প্রথম ধাক্কায়ই প্রায় ২০০ জন ছাত্র নিহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোবিন্দ্র চন্দ্র দেবসহ এক ডজনের ওপর শিক্ষককে ওই এক রাতেই হত্যা করা হয়।

বেসামরিক মানুষের ওপর এমন সমন্বিত অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বের আর কোথাও হয়নি। যুদ্ধ সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশনের প্রারম্ভে বলা হয়েছে, Even wars have limit, civilian should never be targetted. জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধরত বাহিনীকে ১০টি রুলস বা বিধি মান্য করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, যেখানে তিনটি বিধির মাধ্যমে বিশেষভাবে বেসামরিক মানুষের জন্য রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে এক নম্বর—Prohibit targeting civilians. Doing so is a war crime. বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী লিখিত আদেশ দ্বারা গণহত্যা চালায়, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক কনভেশন অনুযায়ী গণহত্যার অপরাধ কখনো তামাদি হয় না এবং কোনো রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষ এটাকে ক্ষমা করে দিতে পারে না। সুতরাং গণহত্যার দায় থেকে পাকিস্তানের রক্ষা নেই; রক্ষা পাবে না। কালের কণ্ঠের সৌজন্যে

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com