কাপ্তাই হ্রদে ভেসে উঠল দুই কলেজছাত্রের মরদেহ পাহাড়ি জনপদের এক বেদনাদায়ক ট্র্যাজেডি
- আপডেট সময় : ০৪:৫১:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৩৫ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রিতিনিধি
পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটির নানিয়ারচরে দুর্গাপূজার আনন্দযাত্রা থেকে ফেরার পথে ঝড়ে উল্টে যাওয়া নৌকার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল দুই তরুণ। তিন দিন ধরে অদৃশ্য থাকার পর অবশেষে তাদের নিথর দেহ ভেসে উঠল কাপ্তাই হ্রদের বুকে। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথমে উদ্ধার হয় নানিয়ারচর কলেজের শিক্ষার্থী ডেনিজেন চাকমার লাশ। আর শুক্রবার সকালে মহাজনপাড়া এলাকায় পানির ওপর ভেসে ওঠে খাগড়াছড়ি কলেজের শিক্ষার্থী দীপেশ দেওয়ানের মরদেহ।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় শোকে মুহ্যমান তাদের পরিবার, সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও পুরো সাবেক্ষং ইউনিয়ন।
ঘটনাটি ঘটেছিল মঙ্গলবার রাতে। নানিয়ারচরের জগন্নাথ মন্দিরে দুর্গাপূজা দেখে বাড়ি ফিরছিলেন ছয়জন তরুণ। যাত্রীবাহী নৌকাটি মহাজনপাড়া এলাকায় পৌঁছাতেই আচমকা ঝড় শুরু হয়। কাপ্তাই হ্রদের ঢেউ ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নৌকাটি ডুবে যায়।
নৌকায় থাকা ছয়জনের মধ্যে চারজন সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন। কিন্তু দীপেশ দেওয়ান ও ডেনিজেন চাকমা নিখোঁজ হয়ে পড়েন। তৎক্ষণাৎ স্থানীয়রা এবং পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উদ্ধার অভিযান চালালেও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ভেসে ওঠা লাশ ও শোকের ঢেউ
তিন দিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে নোয়াপাড়া এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ভেসে ওঠে ডেনিজেন চাকমার মরদেহ। স্থানীয়রা উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে মহাজনপাড়া এলাকায় পানির উপর ভেসে ওঠে দীপেশ দেওয়ানের লাশ।
খবর ছড়িয়ে পড়তেই দুই গ্রামের মানুষ ছুটে আসেন হ্রদ পাড়ে। স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
সাবেক্ষং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুপন চাকমা বলেন, “আমরা দুই সম্ভাবনাময় তরুণকে হারালাম। তাদের মৃত্যু শুধু দুই পরিবারের নয়, পুরো সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি।”
ডেনিজেন চাকমা ছিলেন নানিয়ারচর কলেজের শিক্ষার্থী, দীপেশ দেওয়ান পড়তেন খাগড়াছড়ি কলেজে। উভয়ের বয়স কুড়ির কাছাকাছি। ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
বন্ধুরা বলছে, দীপেশ ছিলেন মেধাবী এবং শান্ত স্বভাবের ছেলে। ডেনিজেন ছিলেন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। দুই পরিবারই আর্থিকভাবে সাধারণ, কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলেছিলেন। অথচ এক ঝড়েই তাদের সব স্বপ্ন ভেসে গেল কাপ্তাই হ্রদের পানিতে।
কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম হ্রদ। অথচ বছরের পর বছর ধরে এখানে নৌযাত্রার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি।
- অধিকাংশ নৌকায় নেই পর্যাপ্ত লাইফজ্যাকেট।
- নৌযানগুলোতে নেই নিরাপত্তা মান বজায় রাখার তদারকি।
- আবহাওয়ার পূর্বাভাস উপেক্ষা করে প্রায়ই মাঝিরা যাত্রী নিয়ে হ্রদে নেমে পড়েন।
ফলে প্রতি বছরই ঘটে ছোট-বড় দুর্ঘটনা, ডুবে মারা যান অনেকে। কিন্তু এই মৃত্যু যেন কারও শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায় না।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিবারই দুর্ঘটনার পর প্রশাসন নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর সব ভুলে যায়। ফলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটে।
একজন গ্রামবাসী বলেন, “লাইফজ্যাকেট থাকলে হয়তো দুজনই বেঁচে যেত। প্রশাসনের কি দায়িত্ব নেই?”
দীপেশ ও ডেনিজেনের মৃত্যু আবারও মনে করিয়ে দিল, পাহাড়ি অঞ্চলে যাতায়াত এখনও কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। দুই তরুণের স্বপ্ন অকালেই থেমে গেল, কিন্তু তাদের চলে যাওয়া যেন অন্যদের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।
নৌপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, লাইফজ্যাকেট বাধ্যতামূলক করা এবং হ্রদে যাত্রীবাহী নৌযানের তদারকি বাড়ানো জরুরি হয়ে উঠেছে। নইলে প্রতি বছরই কাপ্তাই হ্রদ থেকে ভেসে উঠবে নতুন নতুন মরদেহ, আর পরিবারগুলো হারাবে তাদের প্রিয় সন্তানকে।
কাপ্তাই হ্রদের ঢেউয়ে হারিয়ে গেল দীপেশ ও ডেনিজেনের জীবন, কিন্তু তাদের গল্প থেকে পাওয়া শিক্ষা যেন সমাজ ও প্রশাসনের কাছে অমূল্য হয়ে ওঠে। একেকটি মৃত্যু যেন আরেকটি মৃত্যুর পূর্বাভাস না হয়—এটাই তাদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা হতে পারে।




















