ঢাকা ০১:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

করোনা মোকাবেলার অভিজ্ঞতার আলোকে চাই নতুন ধাঁচের বাজেট

ড. আতিউর রহমান
  • আপডেট সময় : ০৮:১২:০১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ জুন ২০২১ ২০৫ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাংলাদেশের যেকোনো সাফল্যে আমরা যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, তেমনি জাতি হিসেবে বড় সংকট মোকাবেলার সময়ও আমাদের উচিত তাঁর দেখানো পথে এগোনো। করোনা মহামারির মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন। তার আগে আগে সংকট মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কেমন বাজেট প্রণীত হতো সেদিকে আলোকপাত করাকে তাই আমি খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সদ্যঃস্বাধীন দেশের শাসনভার কাঁধে নেওয়ার পর সেই সময় ছাইভস্ম থেকে দেশকে তুলে দাঁড় করানোর পথে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি। বঙ্গবন্ধু তাই তাঁর সহজাত সুবিবেচনার 

kalerkanthoজায়গা থেকে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে মোট জাতীয় বাজেটের ১১ শতাংশ বরাদ্দ করেছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতির জন্য। সম্পদের ব্যাপক সংকটের মধ্যেও অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন সাইক্লোন শেল্টার আর দুর্যোগকালে মানুষ ও গবাদি পশুর সুরক্ষার জন্য ‘কিল্লা’ নির্মাণে (পরে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ এগুলোকে ‘মুজিব কিল্লা’ বলতে শুরু করে)। শুধু তা-ই নয়, দুর্যোগ মোকাবেলায় শুধু সরকারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বৃহত্তর সমাজকে সংযুক্ত করতে তিনি বিপুলসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর জন্য দুর্যোগ মোকাবেলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মোটকথা, দুর্যোগের কবল থেকে মানুুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও সেই একই ধারায় দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তাই করোনার প্রথম ঢেউ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই জিডিপির ৪ শতাংশের বেশি সমমানের প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তাঁর ঘোষিত প্রণোদনা কর্মসূচির আলোকে নীতিনির্ধারকরা শেষ পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের জন্য একটি সময়োপযোগী বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন ও পাস করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবনায় মেগাপ্রকল্পগুলোর কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার যে উদ্যোগ সেই সময় নেওয়া হয়েছিল, সেটিও সুফল দিয়েছে।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রণোদনা কর্মসূচিগুলো কিন্তু মূলত মনিটারি পলিসি নির্ভর। আসন্ন অর্থবছরে তাই ফিসক্যাল পলিসি তথা রাজস্বনীতির ওপর ভিত্তি করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এবারের বাজেটে ব্যয় পরিকল্পনা এমন হতে হবে, যাতে স্বাস্থ্য সংকট থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য কাজের সুযোগ আরো বাড়ানো যায়। আমি মনে করি, আমাদের নীতিনির্ধারক ও নীতি বাস্তবায়নকারী সব অংশীজনই এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা সংকট মোকাবেলা করে এক ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাঁরা আসন্ন অর্থবছরে একটি উপযুক্ত বাজেট হাজির করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

চলতি অর্থবছরে করোনা মোকাবেলার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আমি নিশ্চিত, এবারের বাজেটেও একইভাবে করোনা মোকাবেলার জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা হবে। বিশেষ করে অন্তত সব জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যেন করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়, সে জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ জরুরি। সর্বোপরি করোনার টিকা যেন আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে দেশের নাগরিকদের অন্তত ৬০ শতাংশের জন্য নিশ্চিত করা যায়, সে জন্য দরকারবোধে অন্য খাতের বাজেট কাটছাঁট করে হলেও এই খাতে বরাদ্দ রাখা দরকার।

করোনা দুর্যোগ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে পুরো স্বাস্থ্য খাতকেই ঢেলে সাজানোর দরকার। কাজেই এ ক্ষেত্রে শুধু আসন্ন অর্থবছরের জন্য নয়, বরং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালের সব অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ নিয়েই এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হবে। গত এক দশকের বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে স্বাস্থ্যে থেকে যাচ্ছে ৫ শতাংশের আশপাশে। আমার মনে হয়, আসন্ন অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দের অনুপাত মোট বাজেটের অন্তত ৭ শতাংশ হওয়া দরকার। আর অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালের মধ্যে এই অনুপাত ১০ থেকে ১২ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে।

আবার শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, এই বরাদ্দ কিভাবে ব্যয় করা হবে সেই অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার সময়ও সচেতন থাকতে হবে। সচরাচর স্বাস্থ্যের মোট ব্যয়ের ৬০ শতাংশ পরিচালন ব্যয় হিসেবে চলে যায়। স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে পরিচালন ব্যয়ের অংশ কমিয়ে উন্নয়ন ব্যয়ের অংশ বাড়াতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যে উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয়ের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। দেখা গেছে, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশই অব্যয়িত থেকে যায়। এ ছাড়া দেখা যায়, স্বাস্থ্যের মোট ব্যয়ের মাত্র এক-ুপঞ্চমাংশ যায় সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ বাবদ।

যদি এ বাবদ ব্যয় বাড়ানো যায় তাহলে দরিদ্র রোগীদের পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া আরো সহজ হবে। স্বাস্থ্য খাতে ওই অর্থে উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আসন্ন বাজেটে তাই গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল করা যায়, যেখানে এ ধরনের কাজে আগ্রহী সরকারি ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানকে অংশীদার করা হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাকে ডিজিটালি আরো সহজলভ্য এবং মনিটরিং করার জন্য কাজ করবে এমন স্টার্টআপগুলোও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি বাজেট প্রণয়নের সময় জীবিকার জন্য কর্মসংস্থানের কথাও বিবেচনায় রাখা চাই। আগেই বলেছি, চলতি অর্থবছরে মেগাপ্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রাখাটি ছিল একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেমন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, তেমনি এগুলো বাস্তবায়নের পর অর্থনীতি বেগবান হলে তার ফলেও আরো বহুগুণ বেশি মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হবে।

আসন্ন অর্থবছরেও কেনসিয়ান অর্থনীতির ধারা অনুসারে নগরে ও গ্রামাঞ্চলে সরকার বিপুল পরিমাণ পূর্তকর্ম হাতে নিলে সেখানে মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। এসব নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বিনিয়োগ পরিবেশও উন্নত হবে, ফলে আরো বেশি মানুষের টেকসই আয়ের সুযোগ হবে। আর রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য প্রণোদনাগুলোও চলমান রাখতে হবে, যাতে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।

এ ক্ষেত্রে আলাদা করে বলতে চাই কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের তথা এমএসএমই খাতের কথা। করোনা পরিস্থিতি আমাদের আরো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে যে আগামীতে এমএসএমই খাতের বিকাশ নিশ্চিত করতে না পারলে বৈশ্বিক অর্থনীতির বাস্তবতার কারণে আমরা গভীরতর সংকটে পড়ব। দুঃখের বিষয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমএসএমইগুলোর জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তার বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি।

২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষিত হলেও মার্চ মাস পর্যন্ত এর ৩০ শতাংশও ব্যয়িত হয়নি। আসন্ন অর্থবছরে তাই এ দিকটিতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। শর্তের বেড়াজালে আটকে এমএসএমই উদ্যোক্তারা যাতে সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হন তা নিশ্চিত করা চাই। তরুণ এবং নারী উদ্যোক্তারা এখন অনলাইনে অনেক উদ্যোগ নিচ্ছেন। আরো বিকশিত হতে তাঁদের ঋণ চাই। কিন্তু সেই ঋণ তাঁরা পাচ্ছেন না। তাঁদের স্টার্টআপগুলোকে সহায়তা করতে আরেকটু সাহসী হওয়া চাই। সরকার চাইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একেকজন তরুণ উদ্যোক্তাকে মাত্র এক লাখ টাকা বিশেষ ঋণ দিতে পারে। তাঁদের বিকাশের স্বার্থে ঋণ পাওয়ার প্রথম তিন বছর কোনো রকম সুদ বা আসল পরিশোধ করতে হবে না—এমন সুযোগ রাখলে তা খুবই ইতিবাচক ফল দেবে বলে আমার মনে হয়।

করোনার এই পুরো সংকটকালেই কৃষি আমাদের অর্থনীতির সুরক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করেছে। আসন্ন বাজেটে তাই কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। শাইখ সিরাজ সম্প্রতি একটি দৈনিকে যেমনটি লিখেছেন—এখনো সারে ভর্তুকি অব্যাহত রয়েছে বলেই কৃষক ধান আবাদ করছেন। তা না হলে সবাই হাই-ভ্যালু ফসলের চাষ শুরু করলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। তিনি আরো পরামর্শ দিয়েছেন, খাদ্যশস্যের পাশাপাশি কৃষির অন্য উপখাত অর্থাৎ মাছ, গবাদি পশু, পোলট্রি—এগুলোর দিকেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়া চাই।

এই উপখাতগুলোর একটি প্রধান সমস্যা হলো বাজারজাতকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। বাজেটে তাই এ লক্ষ্যে আলাদা প্রকল্প থাকতে পারে। এ ছাড়া সরকার ও ব্যক্তি খাত একই সঙ্গে যেন কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত হয় সে জন্য প্রণোদনা থাকতে পারে বাজেট প্রস্তাবে। যেমন—ব্যক্তি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনোটির সঙ্গে যৌথভাবে কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ করে তাহলে তাদের সে জন্য কর অবকাশ দেওয়ার কথা ভাবা যায়। কৃষি বীমার দাবিটিও বহুদিনের। আসন্ন বাজেটে এ লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অধীনে একটি বড় আকারের পাইলট প্রকল্প অন্তত থাকতে পারে।

বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ দিতে সরকারকে বাড়তি উপার্জন করতে হবে। আশার কথা হলো, এই করোনাকালেও রাজস্ব বৃদ্ধি কিন্তু ইতিবাচক ধারায়ই আছে। আগামী বাজেটে করজাল আরো বিস্তৃত করতে এনবিআরের অটোমেশন ও জনবল বৃদ্ধি অপরিহার্য। তাহলেই রাজস্ব হার বাড়বে। ভ্যাট ও আয়কর আইন সংস্কার করে এসবের নিয়ম-নীতি আরো সহজ করে ডিজিটাল ও অংশীজনবান্ধব করা গেলে রাজস্ব নিশ্চয়ই বাড়বে। তবে রাজস্ব বাড়াতে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য কঠিন করে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের করপোরেট করহার অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। সরকার তাই চলতি বছরেও আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমিয়েছে।

এ বছরও কমাবে—এমনটাই কাম্য। যাঁরা নিয়মিত কর দিচ্ছেন তাঁদের ওপর করের বোঝা কমিয়ে আরো নতুন নতুন করদাতাকে যুক্ত করাটাই সঠিক পথ বলে মনে করি। এতে রাজস্ব বাড়বে, কিন্তু বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে না। জানা গেছে, প্রায় ২৮ হাজার মামলায় আটকে আছে ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এসবের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে তাদের ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ও নিজস্ব প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। আর এডিআর বা সালিসি ব্যবস্থার মাধ্যমেও অনেক মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব।

জীবন বাঁচিয়ে জীবিকার সুযোগগুলো অটুট রাখাই হোক আসন্ন বাজেটের মূল দর্শন। চলমান সম্প্রসারণমূলক মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি বজায় রেখেই জীবন ও জীবিকার সংরক্ষণের উপায় খুঁজবেন আগামী বাজেট প্রণেতারা—এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। কালের কন্ঠের সৌজন্যে

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

করোনা মোকাবেলার অভিজ্ঞতার আলোকে চাই নতুন ধাঁচের বাজেট

আপডেট সময় : ০৮:১২:০১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ জুন ২০২১

বাংলাদেশের যেকোনো সাফল্যে আমরা যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, তেমনি জাতি হিসেবে বড় সংকট মোকাবেলার সময়ও আমাদের উচিত তাঁর দেখানো পথে এগোনো। করোনা মহামারির মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন। তার আগে আগে সংকট মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কেমন বাজেট প্রণীত হতো সেদিকে আলোকপাত করাকে তাই আমি খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সদ্যঃস্বাধীন দেশের শাসনভার কাঁধে নেওয়ার পর সেই সময় ছাইভস্ম থেকে দেশকে তুলে দাঁড় করানোর পথে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি। বঙ্গবন্ধু তাই তাঁর সহজাত সুবিবেচনার 

kalerkanthoজায়গা থেকে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে মোট জাতীয় বাজেটের ১১ শতাংশ বরাদ্দ করেছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতির জন্য। সম্পদের ব্যাপক সংকটের মধ্যেও অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন সাইক্লোন শেল্টার আর দুর্যোগকালে মানুষ ও গবাদি পশুর সুরক্ষার জন্য ‘কিল্লা’ নির্মাণে (পরে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ এগুলোকে ‘মুজিব কিল্লা’ বলতে শুরু করে)। শুধু তা-ই নয়, দুর্যোগ মোকাবেলায় শুধু সরকারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বৃহত্তর সমাজকে সংযুক্ত করতে তিনি বিপুলসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর জন্য দুর্যোগ মোকাবেলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মোটকথা, দুর্যোগের কবল থেকে মানুুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও সেই একই ধারায় দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তাই করোনার প্রথম ঢেউ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই জিডিপির ৪ শতাংশের বেশি সমমানের প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তাঁর ঘোষিত প্রণোদনা কর্মসূচির আলোকে নীতিনির্ধারকরা শেষ পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের জন্য একটি সময়োপযোগী বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন ও পাস করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবনায় মেগাপ্রকল্পগুলোর কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার যে উদ্যোগ সেই সময় নেওয়া হয়েছিল, সেটিও সুফল দিয়েছে।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রণোদনা কর্মসূচিগুলো কিন্তু মূলত মনিটারি পলিসি নির্ভর। আসন্ন অর্থবছরে তাই ফিসক্যাল পলিসি তথা রাজস্বনীতির ওপর ভিত্তি করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এবারের বাজেটে ব্যয় পরিকল্পনা এমন হতে হবে, যাতে স্বাস্থ্য সংকট থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য কাজের সুযোগ আরো বাড়ানো যায়। আমি মনে করি, আমাদের নীতিনির্ধারক ও নীতি বাস্তবায়নকারী সব অংশীজনই এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা সংকট মোকাবেলা করে এক ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাঁরা আসন্ন অর্থবছরে একটি উপযুক্ত বাজেট হাজির করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

চলতি অর্থবছরে করোনা মোকাবেলার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আমি নিশ্চিত, এবারের বাজেটেও একইভাবে করোনা মোকাবেলার জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা হবে। বিশেষ করে অন্তত সব জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যেন করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়, সে জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ জরুরি। সর্বোপরি করোনার টিকা যেন আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে দেশের নাগরিকদের অন্তত ৬০ শতাংশের জন্য নিশ্চিত করা যায়, সে জন্য দরকারবোধে অন্য খাতের বাজেট কাটছাঁট করে হলেও এই খাতে বরাদ্দ রাখা দরকার।

করোনা দুর্যোগ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে পুরো স্বাস্থ্য খাতকেই ঢেলে সাজানোর দরকার। কাজেই এ ক্ষেত্রে শুধু আসন্ন অর্থবছরের জন্য নয়, বরং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালের সব অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ নিয়েই এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হবে। গত এক দশকের বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে স্বাস্থ্যে থেকে যাচ্ছে ৫ শতাংশের আশপাশে। আমার মনে হয়, আসন্ন অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দের অনুপাত মোট বাজেটের অন্তত ৭ শতাংশ হওয়া দরকার। আর অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালের মধ্যে এই অনুপাত ১০ থেকে ১২ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে।

আবার শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, এই বরাদ্দ কিভাবে ব্যয় করা হবে সেই অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার সময়ও সচেতন থাকতে হবে। সচরাচর স্বাস্থ্যের মোট ব্যয়ের ৬০ শতাংশ পরিচালন ব্যয় হিসেবে চলে যায়। স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে পরিচালন ব্যয়ের অংশ কমিয়ে উন্নয়ন ব্যয়ের অংশ বাড়াতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যে উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয়ের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। দেখা গেছে, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশই অব্যয়িত থেকে যায়। এ ছাড়া দেখা যায়, স্বাস্থ্যের মোট ব্যয়ের মাত্র এক-ুপঞ্চমাংশ যায় সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ বাবদ।

যদি এ বাবদ ব্যয় বাড়ানো যায় তাহলে দরিদ্র রোগীদের পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া আরো সহজ হবে। স্বাস্থ্য খাতে ওই অর্থে উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আসন্ন বাজেটে তাই গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল করা যায়, যেখানে এ ধরনের কাজে আগ্রহী সরকারি ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানকে অংশীদার করা হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাকে ডিজিটালি আরো সহজলভ্য এবং মনিটরিং করার জন্য কাজ করবে এমন স্টার্টআপগুলোও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি বাজেট প্রণয়নের সময় জীবিকার জন্য কর্মসংস্থানের কথাও বিবেচনায় রাখা চাই। আগেই বলেছি, চলতি অর্থবছরে মেগাপ্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রাখাটি ছিল একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেমন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, তেমনি এগুলো বাস্তবায়নের পর অর্থনীতি বেগবান হলে তার ফলেও আরো বহুগুণ বেশি মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হবে।

আসন্ন অর্থবছরেও কেনসিয়ান অর্থনীতির ধারা অনুসারে নগরে ও গ্রামাঞ্চলে সরকার বিপুল পরিমাণ পূর্তকর্ম হাতে নিলে সেখানে মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। এসব নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বিনিয়োগ পরিবেশও উন্নত হবে, ফলে আরো বেশি মানুষের টেকসই আয়ের সুযোগ হবে। আর রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য প্রণোদনাগুলোও চলমান রাখতে হবে, যাতে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।

এ ক্ষেত্রে আলাদা করে বলতে চাই কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের তথা এমএসএমই খাতের কথা। করোনা পরিস্থিতি আমাদের আরো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে যে আগামীতে এমএসএমই খাতের বিকাশ নিশ্চিত করতে না পারলে বৈশ্বিক অর্থনীতির বাস্তবতার কারণে আমরা গভীরতর সংকটে পড়ব। দুঃখের বিষয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমএসএমইগুলোর জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তার বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি।

২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষিত হলেও মার্চ মাস পর্যন্ত এর ৩০ শতাংশও ব্যয়িত হয়নি। আসন্ন অর্থবছরে তাই এ দিকটিতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। শর্তের বেড়াজালে আটকে এমএসএমই উদ্যোক্তারা যাতে সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হন তা নিশ্চিত করা চাই। তরুণ এবং নারী উদ্যোক্তারা এখন অনলাইনে অনেক উদ্যোগ নিচ্ছেন। আরো বিকশিত হতে তাঁদের ঋণ চাই। কিন্তু সেই ঋণ তাঁরা পাচ্ছেন না। তাঁদের স্টার্টআপগুলোকে সহায়তা করতে আরেকটু সাহসী হওয়া চাই। সরকার চাইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একেকজন তরুণ উদ্যোক্তাকে মাত্র এক লাখ টাকা বিশেষ ঋণ দিতে পারে। তাঁদের বিকাশের স্বার্থে ঋণ পাওয়ার প্রথম তিন বছর কোনো রকম সুদ বা আসল পরিশোধ করতে হবে না—এমন সুযোগ রাখলে তা খুবই ইতিবাচক ফল দেবে বলে আমার মনে হয়।

করোনার এই পুরো সংকটকালেই কৃষি আমাদের অর্থনীতির সুরক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করেছে। আসন্ন বাজেটে তাই কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। শাইখ সিরাজ সম্প্রতি একটি দৈনিকে যেমনটি লিখেছেন—এখনো সারে ভর্তুকি অব্যাহত রয়েছে বলেই কৃষক ধান আবাদ করছেন। তা না হলে সবাই হাই-ভ্যালু ফসলের চাষ শুরু করলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। তিনি আরো পরামর্শ দিয়েছেন, খাদ্যশস্যের পাশাপাশি কৃষির অন্য উপখাত অর্থাৎ মাছ, গবাদি পশু, পোলট্রি—এগুলোর দিকেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়া চাই।

এই উপখাতগুলোর একটি প্রধান সমস্যা হলো বাজারজাতকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। বাজেটে তাই এ লক্ষ্যে আলাদা প্রকল্প থাকতে পারে। এ ছাড়া সরকার ও ব্যক্তি খাত একই সঙ্গে যেন কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত হয় সে জন্য প্রণোদনা থাকতে পারে বাজেট প্রস্তাবে। যেমন—ব্যক্তি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনোটির সঙ্গে যৌথভাবে কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ করে তাহলে তাদের সে জন্য কর অবকাশ দেওয়ার কথা ভাবা যায়। কৃষি বীমার দাবিটিও বহুদিনের। আসন্ন বাজেটে এ লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অধীনে একটি বড় আকারের পাইলট প্রকল্প অন্তত থাকতে পারে।

বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ দিতে সরকারকে বাড়তি উপার্জন করতে হবে। আশার কথা হলো, এই করোনাকালেও রাজস্ব বৃদ্ধি কিন্তু ইতিবাচক ধারায়ই আছে। আগামী বাজেটে করজাল আরো বিস্তৃত করতে এনবিআরের অটোমেশন ও জনবল বৃদ্ধি অপরিহার্য। তাহলেই রাজস্ব হার বাড়বে। ভ্যাট ও আয়কর আইন সংস্কার করে এসবের নিয়ম-নীতি আরো সহজ করে ডিজিটাল ও অংশীজনবান্ধব করা গেলে রাজস্ব নিশ্চয়ই বাড়বে। তবে রাজস্ব বাড়াতে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য কঠিন করে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের করপোরেট করহার অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। সরকার তাই চলতি বছরেও আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমিয়েছে।

এ বছরও কমাবে—এমনটাই কাম্য। যাঁরা নিয়মিত কর দিচ্ছেন তাঁদের ওপর করের বোঝা কমিয়ে আরো নতুন নতুন করদাতাকে যুক্ত করাটাই সঠিক পথ বলে মনে করি। এতে রাজস্ব বাড়বে, কিন্তু বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে না। জানা গেছে, প্রায় ২৮ হাজার মামলায় আটকে আছে ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এসবের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে তাদের ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ও নিজস্ব প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। আর এডিআর বা সালিসি ব্যবস্থার মাধ্যমেও অনেক মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব।

জীবন বাঁচিয়ে জীবিকার সুযোগগুলো অটুট রাখাই হোক আসন্ন বাজেটের মূল দর্শন। চলমান সম্প্রসারণমূলক মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি বজায় রেখেই জীবন ও জীবিকার সংরক্ষণের উপায় খুঁজবেন আগামী বাজেট প্রণেতারা—এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। কালের কন্ঠের সৌজন্যে

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর