ঢাকা ১০:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আসুন বৈঠকটা সেরে ফেলি

ভয়েস রিপোর্ট, ঢাকা
  • আপডেট সময় : ১২:০৭:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুন ২০২১ ২১৭ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। ২০১২ সালে ৯২৩, বর্তমানে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার । বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা।
———————————————————————————————–
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের তালিকায় আর স্বল্পোন্নত দেশ থাকবে না। এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ হয়েছিল নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশ আগে ছিল নিম্ন আয়ের দেশ। অথচ একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়েই অনেকের সংশয় ছিল। এমনকি বিজয় লাভের আগেই বাংলাদেশকে বলা হতে থাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বা বাস্কেট কেস।
————————————————————————————————–

একটি ঐতিহাসিক বৈঠক ও ‘হে কি’র নামকরণ

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের (হে কি) সভাপতিত্বে ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন’ গ্রুপের বৈঠক। বিষয় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। উপস্থিত কলাকুশলিদের মধ্যে ডেপুটি সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ডেভিড প্যাকার্ড, চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড, সিআইএ’র পরিচালক রিচার্ড হেলমস, আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ও জাপানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউ এলেক্সিস জনসন, ইউএসএআইডির উপপ্রশাসক মরিস উইলিয়ামস এবং ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন। নিঃসন্দেহে বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য বিষয় মূলত পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। বিশেষ করে মার্চে যে বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্যসংকট হবে, দুর্ভিক্ষও হবে এ বিষয়গুলো নিয়ে। এক পর্যায়ে বৈঠকের অলোচনাটা শুরু হলো :

হে কি: পূর্ব পাকিস্তানে কি দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা আছে?
ম উ : সেখানে কিছুদিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহের মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। তাদের প্রচুর ফসল আছে।
হে কি : তাহলে কি আগামী বসন্তের পরে?
ম উ : হ্যাঁ, যদি না তারা মার্চের মধ্যে নিজেদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না নিতে পারে।
হে কি : আমাদের তখন খাদ্য-সহায়তা পাঠাতে হতে পারে?
ম উ: হ্যাঁ।
হে কি : তাহলে এ ব্যাপারে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত।
ম উ : মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের আরও অনেক ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
এ জ : সেটা হবে একটা ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস।
হে কি : হ্যাঁ, তবে শুধু ‘আমাদের বাস্কেট কেস’ না।
সেই থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ যুক্ত হয়।

অর্থাৎ, দেশটিতে যে সাহায্য দেওয়া হোক, তা ঝুড়ির ফুটো দিয়ে পড়ে যাবে। এরপর অনেকটা লম্বা সময় ধরেই ‘বাস্কেট কেস’ প্রচলিত ছিলো। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলার জন্য এককভাবে হেনরি কিসিঞ্জারকে দায়ী করলেও আসলে কথাটা তার নিজে ছিল না।

কিসিঞ্জার বাবুর পথ অনুসরণ করে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনতা বিরোধীরা দেশটাকে লুটপাট করে নিজেদের আখের ঘুছিয়েছেন। কিসিঞ্জার বাবুর উক্তি সত্যে পরিণত করতে এতোটুকু কসুর করেননি তারা। খুনি মুশতাকের পূর্বসুরীরা বাংলাদেশের উন্নয়ন তো দূরের কথা ক্ষমতার লালসায় মত্ত ছিলেন।

অবশেষে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় সুবাতাস বইতে শুরু করে। চারি দিকে জেগে ওঠে ঘুমন্ত বাংলাদেশ। যুবসমাজ ফিরে পায় হারানো শক্তি। তারা ফের ঝান্ডা হাতে কাতারে কাতারে লেগে যায় উন্নয়ন কর্মকান্ডে। চারিদিকে দামামা বেজে ওঠে। এই আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। ঘুমন্ত তরুণ-যুবকরা জেগে ওঠে এক মায়ের ডাকে। মা ডাক দিলেন, এবার জেগে ওঠো, জেগো ওঠে হাল ধরো বাংলার। মাথা উচু করে বাচতে শিখো। তোমাদের বাচতে হবে, দেশকে গড়ে তুলতে হবে, উন্নয়নের ঝান্ডা উড়বে মহাকাশে।

মায়ের ডাক পৌছে যায় নোয়াপাড়া থেকে টঙ্গিপাড়া। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার গড়তে দীর্ঘ বছর পর ঘুমন্ত আমজনতাকে জাগিয়ে তোলেন মা। বললেন, তোমাদেরকেই গড়তে হবে সোনার বাংলা। মায়ের ডাকে সারা দিয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে ঝাপিয়ে পড়েন সর্বস্তরের মানুষ। সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা একটি দেশটি ধীরে ধীরে আলোকিত হতে থাকে।

লাঙ্গল-জোয়ালের বাংলাদেশের মহাকাশ জয়। জলের তলায় সাবমেরিন উড়ছে বাংলার লালসবুজে খচিত পাতাকা। খড়স্রোতা পদ্মায় আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে গড়ে ওঠা পদ্মা সেতু আগামী বছরেই উন্মুক্ত হবে যানবাহন চলাচলে। ঢাকা-থেকে মাওয়া পর্যন্ত বিশ্বমানের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।


২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের ভাষায় যা ইতিহাস। এটি প্রথম যা এতটা উচ্চমাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হলো। এটি ছিল নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি বাড়েনি।

১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরবর্তী ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ হারে। এরপর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উচ্চমুখী হয় অর্থাৎ ৬ শতাংশ। বর্তমান জিডিপির আকার ২৪ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার। স্বাধীনতার পর ৩৪ বছর লেগেছে জিডিপির আকার ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াতে।

নোয়াপাড়ার যুবক তথা ভারত উপমহাদেশের মহান বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, টঙ্গীপাড়ার যুবক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার লালসবুজে খচিত পতাকা অর্জনের মধ্য দিয়ে তা সম্পন্ন করেছেন।

১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের আগ্রাসী থাবা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে দেশটি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো। এর মধ্যে দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছেও। লাখো শহীদের ঘরে তখন শোকের মাতম। একই সঙ্গে রাস্তাঘাট, রেলপথসহ অবকাঠামো বিধস্ত। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ গড়ায় হাত দেন বঙ্গবন্ধু।

এরপর ধীরে ধীরে অর্থাৎ সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন করে বুক ভরা প্রত্যাশা নিয়ে এগুতে থাকেন বাংলার স্থপতি। তাকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ৯দিন আগে শেল কোম্পানি থেকে কিস্তিতে ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র কিনে নেন। তার দুর্শিতায় বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ ছাড়াও, শিল্প এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস।

সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি তুলনামূরক চিত্র তুলে ধরে বলেছে, বাংলাদেশকে শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে চেয়েছিল যে পাকিস্তান, এখন অনেক কিছুতে তার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। গত প্রায় ৪৮ বছরের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ এখন পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ১ হাজার ৫৩৮ ডলার। সেখানে পাকিস্তানের তা ১ হাজার ৪৭০ ডলার।

স্বাধীনতার সময় জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল প্রায় ৫৯ শতাংশ। আর শিল্পের অবদান ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশ। বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ২৯ শতাংশ। জিডিপির তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে। সেবা খাতের অবদান শীর্ষে। স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২০ শতাংশের বেশি।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

আসুন বৈঠকটা সেরে ফেলি

আপডেট সময় : ১২:০৭:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুন ২০২১

১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। ২০১২ সালে ৯২৩, বর্তমানে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার । বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা।
———————————————————————————————–
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের তালিকায় আর স্বল্পোন্নত দেশ থাকবে না। এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ হয়েছিল নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশ আগে ছিল নিম্ন আয়ের দেশ। অথচ একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়েই অনেকের সংশয় ছিল। এমনকি বিজয় লাভের আগেই বাংলাদেশকে বলা হতে থাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বা বাস্কেট কেস।
————————————————————————————————–

একটি ঐতিহাসিক বৈঠক ও ‘হে কি’র নামকরণ

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের (হে কি) সভাপতিত্বে ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন’ গ্রুপের বৈঠক। বিষয় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। উপস্থিত কলাকুশলিদের মধ্যে ডেপুটি সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ডেভিড প্যাকার্ড, চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড, সিআইএ’র পরিচালক রিচার্ড হেলমস, আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ও জাপানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউ এলেক্সিস জনসন, ইউএসএআইডির উপপ্রশাসক মরিস উইলিয়ামস এবং ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন। নিঃসন্দেহে বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য বিষয় মূলত পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। বিশেষ করে মার্চে যে বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্যসংকট হবে, দুর্ভিক্ষও হবে এ বিষয়গুলো নিয়ে। এক পর্যায়ে বৈঠকের অলোচনাটা শুরু হলো :

হে কি: পূর্ব পাকিস্তানে কি দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা আছে?
ম উ : সেখানে কিছুদিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহের মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। তাদের প্রচুর ফসল আছে।
হে কি : তাহলে কি আগামী বসন্তের পরে?
ম উ : হ্যাঁ, যদি না তারা মার্চের মধ্যে নিজেদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না নিতে পারে।
হে কি : আমাদের তখন খাদ্য-সহায়তা পাঠাতে হতে পারে?
ম উ: হ্যাঁ।
হে কি : তাহলে এ ব্যাপারে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত।
ম উ : মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের আরও অনেক ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
এ জ : সেটা হবে একটা ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস।
হে কি : হ্যাঁ, তবে শুধু ‘আমাদের বাস্কেট কেস’ না।
সেই থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ যুক্ত হয়।

অর্থাৎ, দেশটিতে যে সাহায্য দেওয়া হোক, তা ঝুড়ির ফুটো দিয়ে পড়ে যাবে। এরপর অনেকটা লম্বা সময় ধরেই ‘বাস্কেট কেস’ প্রচলিত ছিলো। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলার জন্য এককভাবে হেনরি কিসিঞ্জারকে দায়ী করলেও আসলে কথাটা তার নিজে ছিল না।

কিসিঞ্জার বাবুর পথ অনুসরণ করে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনতা বিরোধীরা দেশটাকে লুটপাট করে নিজেদের আখের ঘুছিয়েছেন। কিসিঞ্জার বাবুর উক্তি সত্যে পরিণত করতে এতোটুকু কসুর করেননি তারা। খুনি মুশতাকের পূর্বসুরীরা বাংলাদেশের উন্নয়ন তো দূরের কথা ক্ষমতার লালসায় মত্ত ছিলেন।

অবশেষে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় সুবাতাস বইতে শুরু করে। চারি দিকে জেগে ওঠে ঘুমন্ত বাংলাদেশ। যুবসমাজ ফিরে পায় হারানো শক্তি। তারা ফের ঝান্ডা হাতে কাতারে কাতারে লেগে যায় উন্নয়ন কর্মকান্ডে। চারিদিকে দামামা বেজে ওঠে। এই আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। ঘুমন্ত তরুণ-যুবকরা জেগে ওঠে এক মায়ের ডাকে। মা ডাক দিলেন, এবার জেগে ওঠো, জেগো ওঠে হাল ধরো বাংলার। মাথা উচু করে বাচতে শিখো। তোমাদের বাচতে হবে, দেশকে গড়ে তুলতে হবে, উন্নয়নের ঝান্ডা উড়বে মহাকাশে।

মায়ের ডাক পৌছে যায় নোয়াপাড়া থেকে টঙ্গিপাড়া। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার গড়তে দীর্ঘ বছর পর ঘুমন্ত আমজনতাকে জাগিয়ে তোলেন মা। বললেন, তোমাদেরকেই গড়তে হবে সোনার বাংলা। মায়ের ডাকে সারা দিয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে ঝাপিয়ে পড়েন সর্বস্তরের মানুষ। সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা একটি দেশটি ধীরে ধীরে আলোকিত হতে থাকে।

লাঙ্গল-জোয়ালের বাংলাদেশের মহাকাশ জয়। জলের তলায় সাবমেরিন উড়ছে বাংলার লালসবুজে খচিত পাতাকা। খড়স্রোতা পদ্মায় আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে গড়ে ওঠা পদ্মা সেতু আগামী বছরেই উন্মুক্ত হবে যানবাহন চলাচলে। ঢাকা-থেকে মাওয়া পর্যন্ত বিশ্বমানের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।


২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের ভাষায় যা ইতিহাস। এটি প্রথম যা এতটা উচ্চমাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হলো। এটি ছিল নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি বাড়েনি।

১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরবর্তী ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ হারে। এরপর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উচ্চমুখী হয় অর্থাৎ ৬ শতাংশ। বর্তমান জিডিপির আকার ২৪ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার। স্বাধীনতার পর ৩৪ বছর লেগেছে জিডিপির আকার ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াতে।

নোয়াপাড়ার যুবক তথা ভারত উপমহাদেশের মহান বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, টঙ্গীপাড়ার যুবক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার লালসবুজে খচিত পতাকা অর্জনের মধ্য দিয়ে তা সম্পন্ন করেছেন।

১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের আগ্রাসী থাবা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে দেশটি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো। এর মধ্যে দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছেও। লাখো শহীদের ঘরে তখন শোকের মাতম। একই সঙ্গে রাস্তাঘাট, রেলপথসহ অবকাঠামো বিধস্ত। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ গড়ায় হাত দেন বঙ্গবন্ধু।

এরপর ধীরে ধীরে অর্থাৎ সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন করে বুক ভরা প্রত্যাশা নিয়ে এগুতে থাকেন বাংলার স্থপতি। তাকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ৯দিন আগে শেল কোম্পানি থেকে কিস্তিতে ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র কিনে নেন। তার দুর্শিতায় বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ ছাড়াও, শিল্প এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস।

সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি তুলনামূরক চিত্র তুলে ধরে বলেছে, বাংলাদেশকে শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে চেয়েছিল যে পাকিস্তান, এখন অনেক কিছুতে তার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। গত প্রায় ৪৮ বছরের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ এখন পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ১ হাজার ৫৩৮ ডলার। সেখানে পাকিস্তানের তা ১ হাজার ৪৭০ ডলার।

স্বাধীনতার সময় জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল প্রায় ৫৯ শতাংশ। আর শিল্পের অবদান ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশ। বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ২৯ শতাংশ। জিডিপির তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে। সেবা খাতের অবদান শীর্ষে। স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২০ শতাংশের বেশি।