উদয়ন চৌধুরী ও ড. বিরাজলক্ষী ঘোষ, কলকাতা
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) মূল্যায়নে বাংলাদেশের সকল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সেরা হয়েছে ‘সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’। আর দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থান ৬ষ্ঠ এবং সিলেটের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আওতাধীন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে ৮১.৫ নম্বর পেয়ে নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টি নজির গড়লো। ভারত, নেপাল, ভুটান এবং আফ্রিকা মহাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে লেখাপড়া করছেন। বিশেষ মেডিকেল কলেজগুলোতে এই হার সব চেয়ে বেশি’
অস্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালিয়েই নজির গড়লো সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। করোনাসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়টি সুষ্ঠু কর্মকান্ড পরিচালনায় সন্তুষ্ট ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। উপাচার্য প্রফেসর ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী জানান, অস্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে শিক্ষারগুণগত মানের বিচারে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ৬ষ্ঠ স্থানে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের নিরলস দায়িত্ব পালনের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হলে, এটি হবে আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়টি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাকে অধিক প্রাধান্য দেবে।
সিলেট শহরের চৌহাট্টায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী কার্যালয়ের সদর ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। চারিদিকে নানা জাতের ফুলের বাগান। ডানে-বামে ভবন। সাইনবোর্ডে লেখা ভাইস চ্যান্সেলরের অস্থায়ী কার্যালয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, এটি ছিলো সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের পুরানো বাসভবন। সেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী এটির সংস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী কার্যালয় করেছেন। চলতি বছর থেকে শুরু হয়েছে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম।
উপাচার্য জানান, বাংলাদেশের চিকিৎসাখাতে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং বিশ্বমানের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সিলেটে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা’ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। নতুন নামকরণের বিষয়টি সিন্ডিকেটের অনুমোদনের পর বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টে পাঠানো হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর অনুমোদন দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য দক্ষিণ সুরমার মোল্লারগাঁও এলাকায় ৮০.৩১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে শিগগিরই অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, চলতি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করা হয়েছে ওসমানী মেডিকেল কলেজসহ ২টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ১টি সরকারি নার্সিং কলেজ, ৩টি বেসরকারি নার্সিং কলেজ ও ১টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজসহ মোট ১১টি স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভর্তিও করা হয়েছে। প্রফেশনাল পরীক্ষা, শিক্ষার্থী ভর্তিসহ চলতি শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস, বিডিএস, পোস্ট বেসিক বিএসসি নাসিংসহ ৪টি ক্যাটাগরিতে ৭২০জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। কার্যক্রম পরিচালনায় ইউজিসির অনুমতি নিয়ে সীমিত পরিসরে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে এটি হচ্ছে বাংলাদেশের চতুর্থ সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যাল। উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা ও সেবারমান এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষা থেকে কোন বিভাগের মানুষ যেন বঞ্চিত না হয়, সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। যেটির নতুন নামকরণ ‘বঙ্গমাতা ফলিজলাতুন্নেছা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’।
ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্বপ্ন ছিলো লাঙ্গল-জোয়ালের এই দেশটির মানুষের মুক্তি এবং মৌলিক চাহিদাপূরণের মাধ্যমে ক্ষুদা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। বিশ্বে অনুকরণীয় বজ্রকণ্ঠের অধিকারী মহাননেতা চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা এবং অর্থণেতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে বিশ্বমানের শিক্ষা। থাকবে উন্নত চিকিৎসাসেবা। কিন্তু তাঁর পক্ষে না হলেও তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে জলের তলা থেকে মহাকাশ জয় করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা বাঙালির জীবনমান পরিবর্তন, শিক্ষার বিকাশ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন আন্দোলন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনার দুরদর্শিতায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন মাইল ফলক। ভারত, নেপাল, ভুটান এবং আফ্রিকা মহাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে লেখা পড়া করছেন। বিশেষ মেডিকেল কলেজগুলোতে এই হার সব চেয়ে বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু বার সিলেট ভ্রমণ করেছেন। আন্তরিনও ছিলেন এখানের কারাগারে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুজিব নগর সরকারের অধীনে ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা এবং প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকারী বর্ষীয়ান জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপির বাসায় অনেক বার এসেছেন। সেই বঙ্গমাতাও সিলেট ভ্রমণ করেছেন। বঙ্গমাতার নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ হওয়ার সিলেটবাসী কৃতজ্ঞ।
ভাইস চ্যান্সেলর
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য প্রফেসর ডা. মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ১৯৬০ সালের ২০ নভেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে সিলেটের জকিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৭৭ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮৩ সালে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিমেবি) ডা. মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী বর্তমান পদে নিয়োগ লাভের আগে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জনস (বিসিপিএস) থেকে এমসিপিএস (গাইনী) এবং ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিজিও ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে গাইনীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
কর্মজীবনে ডা. মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে মেডিকেল অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে চিকিৎসা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য এবং মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), ঢাকা এর নির্বাহী সদস্য ও শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি), ঢাকা এর নির্বাহী সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ), স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), অবস্টেট্রিকাল এন্ড গাইনোকোলজিকাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ, সিলেট ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। এসকল সংগঠনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।