নিজ দপ্তরে কাজে মগ্ন সুবল কুমার দে
‘হিমালয়ের মতো মাতা উচু করা দুই দিকপালের সামনে বসে আছেন তিনি। মুখে স্মিত হাসি। বামপাশে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পাশেই সাম্যদৃষ্টি মেলে স্বামী বিবেকানন্দ। দুজনেই বাঙালি তথা বাংলার সংস্কৃতির আবদানে আদর্শ। স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমসাময়িক দুই কীর্তিমান পুরুষ। তাদের জন্ম কলকাতায় মাত্র বছর দেড়েকের ব্যবধানে। দু’জনের জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও মানুষকে হাঁটতে শিখিয়েছেন জাতি-ধর্ম বিভেদ ভুলে সত্যসুন্দর মঙ্গলালোকের পথে। যা আমাদের চলার পথে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে’
বাংলাদেশের বৃহত্তর কুমিল্লা তথা মেঘনার পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল ছাড়াও ফেণী, উত্তরে ব্রহ্মণবাড়িয়া জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে ছিলো ত্রিপুরা। এই বিশাল অঞ্চলটি জুড়ে ছিলো রাজশাসন। ১৯৪৭ সালে ত্রিপুরা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত মাণিক্য রাজবংশের ১৮৬জন রাজা অঞ্চলটি শাসন করেছেন। ইতিহাস বলছে, ত্রিপুরা ছিল বঙ্গদেশের হরিকেল জনপদের অংশ। যার ইঙ্গিত দেয় ত্রিপুরার বাংলাভাষাভাষি নাগরিকদের সংখ্যা। বাংলা সুলতানী আমলে এবং বৃটিশ শাসনকালে ত্রিপুরা ছিল একটি করদ রাজ্য।
১৯৪৭ সালে বিভাজনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ভারতের জমিনে মাথা উঁচু করে দাড়ায় কাঁটা তারের ভেড়া। তখন থেকেই ত্রিপুরার জনপরিসংখ্যা ভীষণভাবে পরিবর্তিত হয় এবং তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙালিরাই ত্রিপুরার জনসংখ্যার বড় অংশ হয়ে ওঠে। ত্রিপুরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৪৯ সালে। এর আগ পর্যন্ত ত্রিপুরা স্বাধীন রাজ্য ছিল। দেশ ভাগের পরও স্বাধীন ছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত। ত্রিপুরাও কিন্তু সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলো। ১৯৪৯ সালে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল কথিপয় রাজ কর্মচারী। তারা ত্রিপুরাকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দিতে অপচেষ্টা চালায়। কিন্ত বিষয়টি টের পেয়ে যান ত্রিপুরার মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী। ফলে ষড়যন্ত্র ভণ্ডল হয়।
সুবল বাবু বলেন, বল্লভ ভাই প্যাটেলের কাছে কালু চন্দ নামে এক বিশ্বস্থ দূতকে পাঠান মহারাণী। দূতের কাছে সব কিছু জেনে ত্রিপুরায় ভারতের সৈনিক পাঠিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর শিলংয়ে চুক্তির মধ্য দিয়ে ত্রিপুর ভারত ইউনিয়নে যোগ দেয়। এই স্বাধীন ত্রিপুরায় একবার নয়, সাত সাতবার পা রেখেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্র ঠাকুর। শান্তিনিকেতন তৈরীতেও ত্রিপুরার মহারাজার যোগদান ছিল। রাজর্ষী মূলত রাজাদের ঘিরে গল্প। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের স্বীকৃতি পায় ত্রিপুরা। সেই অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হিসাবে ত্রিপুরার বয়স প্রায় সমান।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবিতা এবং বাংলাভাষা প্রসারে অসামান্য অবদানের জন্য ‘মহারাজার’র আমন্ত্রণে ত্রিপুরায় আসেন কবি । তৎকালীন ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরে বসেই ‘রাজর্ষী’ লিখেন বিশ্ব কবি। রাজর্ষী সৃষ্টির স্থানটি এখন উন্মুক্ত ‘ মঞ্চ’। উদয়পুরে কোন পর্যটক পা রেখেই রাজর্ষী মঞ্চের সামনে এসে দাড়ায়। উদয়পুরের বিশালতা নিয়ে সুবল বাবু অন্য একটি অধ্যায়ে কথা বলবেন।
ত্রিপুরা রাজ্য তথা উত্তরপূর্ব ভারতের প্রবীণতম সম্পাদক ও সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সুবল কুমার দে। একান্ন বছর আগের কঠিন সিদ্ধান্তের কথা মনে হলে এখনও হাতছানি দেয় টুকরো টুকরো স্মৃতির সিম্ফনি। ১৯৭০ সালে মধ্যগগনে অবস্থান সুবল বাবুর। একদিকে দূরন্ত যৌবন অন্যদিকে প্রচণ্ড মেধা। এই দু’য়ের সমন্বয়ে তার জীবন ধাবমান। তাছাড়া এই বয়সেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ‘ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক’। দুর্দান্ত মেধাবীদের বাতিঘরে সিপিআই এম এল। সেই বিবেচনায় একজন মেধাবী ও সাহসী যোদ্ধা সুবল বাবুকে দলে টেনে নিতে সক্ষম হয় চারু মজুদারের নেতৃত্বের সিপিআই এম এল।
কর্মবীর সুবল কুমার দে
১৯১৪ সালের মে মাস। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সদ্য নোবেল সম্মানপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতি আকাশ ছোঁয়া। বিশ্ববাঙালির অহংকার রবীন্দ্রনাথ এক ধ্রুবতারা হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন গোটা দুনিয়ায়। সেই বছরেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভারতের মসনদে বৃটিশরাজ। তারা ঘোষণা দিলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে পরাধীন দেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেবে। শাসকের এমন প্রতিশ্রুতিতে সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে জেগে ওঠে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার আকাঙ্খা। তারা দলে দলে যুদ্ধে যোগ দিলেন। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হলে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের বেকার অবস্থায় বাড়ি যাবার নির্দেশ দিল যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। তারা তখন ব্যস্ত যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণে ভার্সাই চুক্তি এবং জাতিপুঞ্জের গঠন নিয়ে। বঞ্চিত ভারতবাসী তখন ক্ষোভে ফুঁসছে। এসময়ে হানা দেয় চরম আর্থিক মন্দা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি ইত্যাদি।
বড়লাট মন্টেগু-চেমসফোর্ড রাওলাট আইন করে শাসকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলো। যা মেনে নিতে পারেনি ভারতীয়রা। সময়টা ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে অহিংস এক সমাবেশ চলছিলো। সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রায় হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে শাষকগোষ্ঠী। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় এটি। ‘সভ্যতার মোড়কে এমন বর্বরতা’কে মেনে নিতে পারেননি কবি গুরু। তিনি শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠালেন চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজকে। পঞ্জাবে যে ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে সমস্ত ভারতবাসীর মধ্যে একজন বুদ্ধিজীবীও প্রতিবাদ করবেন না, এটা কবি গুরু মেনে নিতে পারেননি।
স্মৃতির গলি পথ বেয়ে ফিরে এলেন সুবল বাবু। তাকে অনেকটা অস্থির মনে হচ্ছে। টেবিলের নানা কাগজপত্র ঠিক করে রাখছেন। চেয়ার ঘুরিয়ে একবার পাশের কম্পিউটার টেবিলের দিকে তাকালেন। এবারে জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে একটু জল খেলেন। বুঝলেতো, আমার সমস্যা হচ্ছে, যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। এটাকে অনেকে সহজভাবে নিতে পারেন না। আর নিবেই বা কেন বলো? আমাকেতো সেই স্রোতে টেনে নিতে পারবে না।
ত্রিপুরা ভারতের যুক্ত হয় ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর। এর আগ পর্যন্ত ত্রিপুরা স্বাধীন রাজ্য ছিল। দেশ ভাগের পরও স্বাধীন ছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত। ত্রিপুরাও কিন্তু সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলো। ১৯৪৯ সালে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল কথিপয় রাজ কর্মচারী। তারা ত্রিপুরাকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দিতে অপচেষ্টা চালায়। কিন্ত বিষয়টি টের পেয়ে যান ত্রিপুরার মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী। ফলে ষড়যন্ত্র ভণ্ডল হয়।
জাতীয় কংগ্রেস ভারতের প্রাচীন জাতীয় রাজনৈতিক দল। যা কংগ্রেস নামে পরিচিত। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা। যার মধ্যে ছিলেন, দাদাভাই নওরোজি, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ, মহাদেব গোবিন্দ প্রমুখ। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে কংগ্রেস দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরী অবস্থা জারি করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এই পরামর্শ আসলো পশ্চিমবঙ্গের তথকালীন মুখ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের তরফে। তখন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচিন চন্দ্র সিং। কেন্দ্র শাষিত ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ৭১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। জরুরি শাসন শেষে আদি কংগ্রেস ভেঙ্গে গিয়ে ‘জনতা দল’ নামের রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটির নেতৃত্বে আসলেন ইন্দিরার মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগকারী জগজীবন রাম। কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকলেন ইন্দিরা গান্ধি।
কিভাবে ভারতের জাতীয় একটি রাজনৈতিক দলের পলেস্তেরা খসে পড়তে থাকে তার সবিস্তার বর্ণনা ওঠে আসছিল সুবল বাবুর কন্ঠে। বলছিলেন, কংগ্রেসে ভাঙ্গনের ইতিহাস বহু পুরানো। মূলত ভারতের যতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে, তার অধিকাংশই কংগ্রেসের ঘর থেকেই এসেছে। অনেকে আবার রাজনীতিতে হাতে খড়ি কংগ্রেসের পতাকা উড়িয়ে। নানা কারণে সেই কংগ্রেস ত্যাগীরা নতুন রাজনৈতিক শিবিরে হাত উচু করেছেন। ফের হাত নামিয়ে অপর কোন দলের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। সুবল বাবু বলেন, ভারতের যতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে, তার সবকটিই কংগ্রেস ত্যাগী। যেমন ধরো ১৯২৫ সালের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব কংগ্রেস ভেঙ্গে কমিউনিষ্ট পার্টির অব ইন্ডিয়ার জন্ম। এই কমিউনিষ্ট পার্টি থেঙ্গে ৬৪’ নভেম্বরে জন্ম নিলো সিপিআইএম।