ঢাকা ১১:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

Sheikh Hasina : শেখ হাসিনার সফরকে যে দৃষ্টিতে দেখছে দিল্লি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:৫৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮৩ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : ফাইল ছবি

 

নিউজ ডেস্ক

প্রায় তিন বছর হতে চললো তিনি দিল্লিতে পা রেখেছিলেন। এরপর প্রায় টানা দু’বছর ধরে চলেছে কোভিড মহামারির বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়, এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে সেই সংকট আরও গভীর হয়েছে— বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই যে পরিস্থিতির ভুক্তভোগী। আর এর মধ্যেই সামনের বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন।

এমন একটা আবহেই সোমবার দিল্লিতে আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক– সব দিক থেকেই এই দ্বিপাক্ষিক সফরটিকে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের সরকার বা নীতিনির্ধারকরাও প্রবল আগ্রহ নিয়ে এই সফরের দিকে তাকিয়ে আছেন।

ইতিহাসের বন্ধন

ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচীর কথায়, ‘সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে, এমন কী সর্বোচ্চ পর্যায়েও বেশ ঘন ঘন বৈঠক হয়েছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে খুবই শক্তিশালী করে তুলবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ, এই সম্পর্কটা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।’

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এই আসন্ন সফরকে দিল্লি ঠিক কী চোখে দেখছে এবং এই সফর থেকে ভারত কী-ই বা প্রত্যাশা করছে?

পান্ডারা রোডের স্মৃতি

বস্তুত সফরের ঠিক আগে ঢাকায় বসেই ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআই-কে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শেখ হাসিনা, যেটি ভারতে খুবই ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তিনি সেখানে স্মৃতিচারণা করেছেন— বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভারত কীভাবে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল, তার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যার সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতটিও তিনি সেখানে ব্যাখ্যা করেছেন।

এএনআই-য়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশকে সেখানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে সেদিন যারা বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তারা আসলে চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থী শক্তিরা কোনোদিন ক্ষমতায় ফিরুক। আমার ১০ বছর বয়সী ছোট্ট ভাইকেও (শেখ রাসেল) তারা রেহাই দেয়নি।’

এএনআই-কে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন শেখ হাসিনা

তবে তখন ইউরোপে থাকা শেখ হাসিনা ঠিকমতো জানতেও পারেননি যে, পরিবারের কাদের কাদের হত্যা করা হয়েছে। সেই অভিশপ্ত ১৫ আগস্টের দিনদশেক পর দিল্লিতে পা রেখেই তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে জানতে পারেন— তার পরিবারের মোট ১৮ জন সদস্যকে সেদিন নির্মমভাবে ঠাষ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। সেই কথা বলতে বলতে কান্না ধরে রাখতেও কষ্ট হচ্ছিল তার।

শেখ হাসিনা আরও জানান, ‘মাত্র দুজন বিশ্বনেতা সেদিন আমাদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন– ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, আর যুগোশ্লোভিয়ার মার্শাল টিটো। ইন্দিরা গান্ধী আমাদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছিলেন বলেই আমরা কদিন বাদে দিল্লিতে পাড়ি দিই। পান্ডারা রোডের একটি বাড়িতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আমাদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তবে আমাদের নিজেদের নাম-পরিচয় পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল। পিতার হত্যাকারীদের নজর এড়াতে আমাদের সেখাতে থাকতে হতো ভিন্ন নাম-পরিচয়ে।’

ভারত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই শেখ হাসিনা পুরো সফরের সুরটি বেঁধে দিয়েছেন। তারা মনে করছেন, ভারতের প্রতি তার যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্তরে অসীম কৃতজ্ঞতা রয়েছে, সফরের আগে সে কথা উল্লেখ করে বিরাট মন ও উদারতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

‘আর একটা বিষয় হলো, পাকিস্তানের নাম হয়তো তিনি সরাসরি নেননি, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কথা বলে তিনি কাদের বোঝাতে চেয়েছেন সেটা স্পষ্ট’, বাংলা ট্রিবিউনকে এদিন বলছিলেন দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

শেখ হাসিনার বর্তমান সফরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে আলোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে দিল্লিতে অনেক পর্যবেক্ষকই নিশ্চিত। বিশেষত গত মাসেই যেভাবে আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ সাড়ে চারশো কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে, সেই পটভূমিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থাটা জানার জন্য ভারতের আগ্রহ থাকবে বলেই তারা ধারণা করছেন।

দিল্লির জেএনইউ-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজের কথায়, ‘মাত্র কিছুদিন আগেই যেভাবে শ্রীলঙ্কাকে ভারত প্রায় চারশো কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট বা জ্বালানি-খাদ্যশস্যের মতো পণ্যসামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছে – বাংলাদেশেও যাতে কখনোই সেরকম পরিস্থিতি তৈরি না-হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের উৎকণ্ঠা থাকবে এটা খুব স্বাভাবিক।’

দুদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বৈঠক

তবে এএনআই-কে দেওয়া ওই একই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু জোরালো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাবি করেছেন, তার দেশের পরিস্থিতি কখনোই শ্রীলঙ্কার মতো হবে না।

শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোভিড মহামারি বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো সংকটের মোকাবিলা করেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও খুবই শক্তিশালী, আর আমাদের ঠিক সময়ে আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করার ট্র্যাক-রেকর্ডও অসাধারণ। এমনকি উন্নয়নের সব পরিকল্পনা বাংলাদেশ করে থাকে খুবই হিসেব কষে, অপ্রয়োজনীয় ঋণ নিয়ে দেনায় ডুবে থাকাটা আমাদের স্বভাব নয়।’

এই বক্তব্য ভারতকে অবশ্যই ভরসা জোগাবে। তবে ড. ভরদ্বাজ এর পরেও বলছেন, ‘তা সত্ত্বেও যদি দরকার হয়, ভারত কিন্তু অবশ্যই বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। যে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সংযোগ অতোটা নিবিড় ছিল না, সেখানেও ভারত চার বিলিয়ন ডলার দিয়েছে… আর বাংলাদেশে তো ভারতের স্টেক তুলনায় অনেক বেশি, ফলে প্রয়োজনে সাহায্যের পরিমাণও অনেক বেশি হতে হবে।’ অর্থাৎ তিনি মনে করছেন, সফরের শেষে শেখ হাসিনা সেই আশ্বাস নিয়েও ফিরবেন– দরকারে ভারত পাশে থাকবে।

প্রতিদানের পালা

বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনা সরকার ভারতের জন্য যা যা করেছে, তার উপযুক্ত প্রতিদান ভারত দিতে পারেনি, এমন একটা ধারণা বাংলাদেশে অনেকের মধ্যেই আছে। আর ভারতও কিন্তু সেই উপলব্ধিটা নিয়ে ক্রমশ আরও বেশি সচেতন হচ্ছে। ভারতও যে বাংলাদেশের জন্য সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত– সফরে এই বার্তাটা দেওয়ার জন্য দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে এবারে একটা অতিরিক্ত তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।

দিল্লির থিংক ট্যাংক ভিআইএফের সিনিয়র ফেলো ও গবেষক শ্রীরাধা দত্তর কথায়, ‘শুধু ভারতের নর্থ-ইস্টে শান্তি ফেরানোর জন্য শেখ হাসিনার যা অবদান, শুধু ওটুকুর জন্যই ভারতের তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আসাম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যগুলোতে হিংসা-নাশকতা-বোমা বিস্ফোরণ এগুলোই ছিল এক সময় রুটিন। আর আজ আসামের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত বলছেন— বাংলাদেশের জন্যই তার রাজ্যবাসী এখন শান্তিতে ঘুমোতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ড. দত্ত মনে করছেন, বাংলাদেশ যে এখানে কত বিরাট সাহায্য করেছে এবং শেখ হাসিনা যেভাবে বিষয়টা ‘অ্যাড্রেস’ করেছেন, তার গুরুত্ব ভারত ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে এবং সেটা যেভাবে হোক পুষিয়ে দেবার একটা ঐকান্তিক আগ্রহ দিল্লিতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী তিস্তা চুক্তির সম্পাদন হয়তো এখনই সম্ভব হচ্ছে না, তবে ভারতের বরাক উপত্যকা (আসাম) থেকে সিলেটে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে এই সফরে ঐকমত্যে পৌঁছনো যাবে বলে দিল্লি আশা করছে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি ‘যার মেয়াদ ফুরোনোর কথা ২০২৬ সালে’ সেটির নবায়ন নিয়েও অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখছেন ভারতের কর্মকর্তারা।

দিল্লি এই সফরে আরও একটি জিনিসের ওপর খুব জোর দিচ্ছে— তা হলো ‘ভিসা রেজিম’ আরও সহজ করে তোলা এবং বাংলাদেশি পর্যটকদের আরও বেশি সংখ্যায় ভারতে স্বাগত জানানো।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার কথায়, ‘‘আমরা কড়াকড়ি অনেক কমিয়ে দিয়েছি বলেই এখন ভারতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ থেকেই আসেন। এখন বর্ডারে বা ইমিগ্রেশনে যাতে তাদের ভোগান্তি না-হয় এবং ভারতে এসেও তারা যাতে ‘অ্যাট হোম’ ফিল করতে পারেন, সে দিকটার দিকে আমরা বিশেষভাবে নজর দিচ্ছি।’’

দিল্লিতে কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ প্রদীপ সরকারেরর কথায়, ‘পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্ট বা দুদেশের মানুষে মানুষে সংযোগ বাড়ানোই যে বন্ধুত্বকে দৃঢ় করার শ্রেষ্ঠ পথ, সেটা দুই দেশই আরও বেশি করে বুঝছে এবং তার ওপর জোর দিচ্ছে। যে কারণে ত্রিপুরার বাসিন্দারা আজকাল আগরতলা থেকে বাসে চেপে ঢাকা হয়ে কলকাতায় এসে নামতে পারছেন, কিংবা ঢাকার বাসিন্দারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেনে চেপে দার্জিলিং বেড়াতে যেতে পারছেন। শেখ হাসিনার এবারের সফরে এই ধরনের আরও উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যাবে বলেই আমি নিশ্চিত।’

সফরের তৃতীয় দিনে (৭ সেপ্টেম্বর) দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভারতের শীর্ষ বণিকসভা কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজের (সিআইআই) সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভায় মিলিত হবেন। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর জন্যও এই বৈঠকটির দিকে দিল্লি সাগ্রহে তাকিয়ে আছে। আশা করা হচ্ছে, সরাসরি শেখ হাসিনার কথা শুনে বিভিন্ন ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে লগ্নি করতে উৎসাহিত হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

Sheikh Hasina : শেখ হাসিনার সফরকে যে দৃষ্টিতে দেখছে দিল্লি

আপডেট সময় : ০৯:৫৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : ফাইল ছবি

 

নিউজ ডেস্ক

প্রায় তিন বছর হতে চললো তিনি দিল্লিতে পা রেখেছিলেন। এরপর প্রায় টানা দু’বছর ধরে চলেছে কোভিড মহামারির বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়, এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে সেই সংকট আরও গভীর হয়েছে— বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই যে পরিস্থিতির ভুক্তভোগী। আর এর মধ্যেই সামনের বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন।

এমন একটা আবহেই সোমবার দিল্লিতে আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক– সব দিক থেকেই এই দ্বিপাক্ষিক সফরটিকে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের সরকার বা নীতিনির্ধারকরাও প্রবল আগ্রহ নিয়ে এই সফরের দিকে তাকিয়ে আছেন।

ইতিহাসের বন্ধন

ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচীর কথায়, ‘সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে, এমন কী সর্বোচ্চ পর্যায়েও বেশ ঘন ঘন বৈঠক হয়েছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে খুবই শক্তিশালী করে তুলবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ, এই সম্পর্কটা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।’

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এই আসন্ন সফরকে দিল্লি ঠিক কী চোখে দেখছে এবং এই সফর থেকে ভারত কী-ই বা প্রত্যাশা করছে?

পান্ডারা রোডের স্মৃতি

বস্তুত সফরের ঠিক আগে ঢাকায় বসেই ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআই-কে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শেখ হাসিনা, যেটি ভারতে খুবই ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তিনি সেখানে স্মৃতিচারণা করেছেন— বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভারত কীভাবে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল, তার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যার সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতটিও তিনি সেখানে ব্যাখ্যা করেছেন।

এএনআই-য়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশকে সেখানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে সেদিন যারা বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তারা আসলে চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থী শক্তিরা কোনোদিন ক্ষমতায় ফিরুক। আমার ১০ বছর বয়সী ছোট্ট ভাইকেও (শেখ রাসেল) তারা রেহাই দেয়নি।’

এএনআই-কে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন শেখ হাসিনা

তবে তখন ইউরোপে থাকা শেখ হাসিনা ঠিকমতো জানতেও পারেননি যে, পরিবারের কাদের কাদের হত্যা করা হয়েছে। সেই অভিশপ্ত ১৫ আগস্টের দিনদশেক পর দিল্লিতে পা রেখেই তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে জানতে পারেন— তার পরিবারের মোট ১৮ জন সদস্যকে সেদিন নির্মমভাবে ঠাষ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। সেই কথা বলতে বলতে কান্না ধরে রাখতেও কষ্ট হচ্ছিল তার।

শেখ হাসিনা আরও জানান, ‘মাত্র দুজন বিশ্বনেতা সেদিন আমাদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন– ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, আর যুগোশ্লোভিয়ার মার্শাল টিটো। ইন্দিরা গান্ধী আমাদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছিলেন বলেই আমরা কদিন বাদে দিল্লিতে পাড়ি দিই। পান্ডারা রোডের একটি বাড়িতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আমাদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তবে আমাদের নিজেদের নাম-পরিচয় পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল। পিতার হত্যাকারীদের নজর এড়াতে আমাদের সেখাতে থাকতে হতো ভিন্ন নাম-পরিচয়ে।’

ভারত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই শেখ হাসিনা পুরো সফরের সুরটি বেঁধে দিয়েছেন। তারা মনে করছেন, ভারতের প্রতি তার যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্তরে অসীম কৃতজ্ঞতা রয়েছে, সফরের আগে সে কথা উল্লেখ করে বিরাট মন ও উদারতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

‘আর একটা বিষয় হলো, পাকিস্তানের নাম হয়তো তিনি সরাসরি নেননি, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কথা বলে তিনি কাদের বোঝাতে চেয়েছেন সেটা স্পষ্ট’, বাংলা ট্রিবিউনকে এদিন বলছিলেন দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

শেখ হাসিনার বর্তমান সফরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে আলোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে দিল্লিতে অনেক পর্যবেক্ষকই নিশ্চিত। বিশেষত গত মাসেই যেভাবে আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ সাড়ে চারশো কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে, সেই পটভূমিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থাটা জানার জন্য ভারতের আগ্রহ থাকবে বলেই তারা ধারণা করছেন।

দিল্লির জেএনইউ-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজের কথায়, ‘মাত্র কিছুদিন আগেই যেভাবে শ্রীলঙ্কাকে ভারত প্রায় চারশো কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট বা জ্বালানি-খাদ্যশস্যের মতো পণ্যসামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছে – বাংলাদেশেও যাতে কখনোই সেরকম পরিস্থিতি তৈরি না-হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের উৎকণ্ঠা থাকবে এটা খুব স্বাভাবিক।’

দুদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বৈঠক

তবে এএনআই-কে দেওয়া ওই একই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু জোরালো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাবি করেছেন, তার দেশের পরিস্থিতি কখনোই শ্রীলঙ্কার মতো হবে না।

শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোভিড মহামারি বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো সংকটের মোকাবিলা করেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও খুবই শক্তিশালী, আর আমাদের ঠিক সময়ে আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করার ট্র্যাক-রেকর্ডও অসাধারণ। এমনকি উন্নয়নের সব পরিকল্পনা বাংলাদেশ করে থাকে খুবই হিসেব কষে, অপ্রয়োজনীয় ঋণ নিয়ে দেনায় ডুবে থাকাটা আমাদের স্বভাব নয়।’

এই বক্তব্য ভারতকে অবশ্যই ভরসা জোগাবে। তবে ড. ভরদ্বাজ এর পরেও বলছেন, ‘তা সত্ত্বেও যদি দরকার হয়, ভারত কিন্তু অবশ্যই বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। যে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সংযোগ অতোটা নিবিড় ছিল না, সেখানেও ভারত চার বিলিয়ন ডলার দিয়েছে… আর বাংলাদেশে তো ভারতের স্টেক তুলনায় অনেক বেশি, ফলে প্রয়োজনে সাহায্যের পরিমাণও অনেক বেশি হতে হবে।’ অর্থাৎ তিনি মনে করছেন, সফরের শেষে শেখ হাসিনা সেই আশ্বাস নিয়েও ফিরবেন– দরকারে ভারত পাশে থাকবে।

প্রতিদানের পালা

বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনা সরকার ভারতের জন্য যা যা করেছে, তার উপযুক্ত প্রতিদান ভারত দিতে পারেনি, এমন একটা ধারণা বাংলাদেশে অনেকের মধ্যেই আছে। আর ভারতও কিন্তু সেই উপলব্ধিটা নিয়ে ক্রমশ আরও বেশি সচেতন হচ্ছে। ভারতও যে বাংলাদেশের জন্য সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত– সফরে এই বার্তাটা দেওয়ার জন্য দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে এবারে একটা অতিরিক্ত তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।

দিল্লির থিংক ট্যাংক ভিআইএফের সিনিয়র ফেলো ও গবেষক শ্রীরাধা দত্তর কথায়, ‘শুধু ভারতের নর্থ-ইস্টে শান্তি ফেরানোর জন্য শেখ হাসিনার যা অবদান, শুধু ওটুকুর জন্যই ভারতের তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আসাম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যগুলোতে হিংসা-নাশকতা-বোমা বিস্ফোরণ এগুলোই ছিল এক সময় রুটিন। আর আজ আসামের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত বলছেন— বাংলাদেশের জন্যই তার রাজ্যবাসী এখন শান্তিতে ঘুমোতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ড. দত্ত মনে করছেন, বাংলাদেশ যে এখানে কত বিরাট সাহায্য করেছে এবং শেখ হাসিনা যেভাবে বিষয়টা ‘অ্যাড্রেস’ করেছেন, তার গুরুত্ব ভারত ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে এবং সেটা যেভাবে হোক পুষিয়ে দেবার একটা ঐকান্তিক আগ্রহ দিল্লিতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী তিস্তা চুক্তির সম্পাদন হয়তো এখনই সম্ভব হচ্ছে না, তবে ভারতের বরাক উপত্যকা (আসাম) থেকে সিলেটে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে এই সফরে ঐকমত্যে পৌঁছনো যাবে বলে দিল্লি আশা করছে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি ‘যার মেয়াদ ফুরোনোর কথা ২০২৬ সালে’ সেটির নবায়ন নিয়েও অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখছেন ভারতের কর্মকর্তারা।

দিল্লি এই সফরে আরও একটি জিনিসের ওপর খুব জোর দিচ্ছে— তা হলো ‘ভিসা রেজিম’ আরও সহজ করে তোলা এবং বাংলাদেশি পর্যটকদের আরও বেশি সংখ্যায় ভারতে স্বাগত জানানো।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার কথায়, ‘‘আমরা কড়াকড়ি অনেক কমিয়ে দিয়েছি বলেই এখন ভারতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ থেকেই আসেন। এখন বর্ডারে বা ইমিগ্রেশনে যাতে তাদের ভোগান্তি না-হয় এবং ভারতে এসেও তারা যাতে ‘অ্যাট হোম’ ফিল করতে পারেন, সে দিকটার দিকে আমরা বিশেষভাবে নজর দিচ্ছি।’’

দিল্লিতে কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ প্রদীপ সরকারেরর কথায়, ‘পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্ট বা দুদেশের মানুষে মানুষে সংযোগ বাড়ানোই যে বন্ধুত্বকে দৃঢ় করার শ্রেষ্ঠ পথ, সেটা দুই দেশই আরও বেশি করে বুঝছে এবং তার ওপর জোর দিচ্ছে। যে কারণে ত্রিপুরার বাসিন্দারা আজকাল আগরতলা থেকে বাসে চেপে ঢাকা হয়ে কলকাতায় এসে নামতে পারছেন, কিংবা ঢাকার বাসিন্দারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেনে চেপে দার্জিলিং বেড়াতে যেতে পারছেন। শেখ হাসিনার এবারের সফরে এই ধরনের আরও উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যাবে বলেই আমি নিশ্চিত।’

সফরের তৃতীয় দিনে (৭ সেপ্টেম্বর) দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভারতের শীর্ষ বণিকসভা কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজের (সিআইআই) সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভায় মিলিত হবেন। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর জন্যও এই বৈঠকটির দিকে দিল্লি সাগ্রহে তাকিয়ে আছে। আশা করা হচ্ছে, সরাসরি শেখ হাসিনার কথা শুনে বিভিন্ন ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে লগ্নি করতে উৎসাহিত হবে।