PIB : পিআইবি’র সমৃদ্ধ আয়োজন ‘সাংবাদিকতায় ফ্যাক্টচেক বিষয়ক প্রশিক্ষণ’

- আপডেট সময় : ০৬:১৩:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ এপ্রিল ২০২২ ২৯৩ বার পড়া হয়েছে
প্রধান অতিথি আলমগীর হোসেনকে শুভেচ্ছা
আমিনুল হক, ঢাকা
‘সত্যি কথা বল, বে-পথে চল ওরে আমার মন’। মুখে সত্যের বুলি আওড়িয়ে বে-পথে চলার অভ্যেসটা যেন কথিপয় মানুষের দেহে লেপটে গিয়েছে। দায়িত্ববোধের বিচার না করে ধর্ম এবং সত্য এই দুটোর মিশেলে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিতে কসুর করছে না স্বার্থন্বেষীরা। বিভিন্ন ভাবে ধর্ম এবং রাজনীতিকে ব্যবহার করে ভুয়া ছবি ও সংবাদ পরিবেশন করে সমাজে অশান্তি ছড়ানো হয়ে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে নানা রকমের গুজব ছাড়ানো এবং সমাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির মতো কর্মকান্ডেও পিছপা হচ্ছে না একটি গোষ্ঠী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে ‘অজ্ঞতা’র সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটে থাকে। যার খেসারত গুণতে হয় একটা মোটা দাগের আমজনতাকে।
ভুয়া সংবাদ ও তথ্য বিভ্রান্তি অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে এবং মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। আর এই বিষয়গুলো ঘটার পেছনের বড় কারণটি হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অজ্ঞতা। অনেক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে সুযোগসন্ধ্যানী গোষ্ঠী। এই কাজটিতে যারা হাত পাকায় তারা জেনে বুঝেই করে থাকেন। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, সুযোগ বুঝে ফায়দা হাসিল করা।

মঞ্চে বা দিক থেকে ডিআরইউ সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু, প্রধান অতিথি আলমগীর হোসেন, পিআইবি ডিজি জাফর ওয়াজেদ এবং প্রশিক্ষক সাহস মোস্তাফিজ
বিশ্বে ধর্মীয় উন্মাদনায় বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করাটা খুবই সহজ। আর এসব গুজব ভেসে আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ব্যস! গায়ের কাপড় মাথায় বেধে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ার হিড়িক পড়ে। কিসের জন্য এই অস্থিরতা তা যাচাই বাছাই করার উদ্যোগ না নিয়েই অঘটন যা ঘটানোর তা ঘটিয়ে ফেলা হয়। যার মূলে অজ্ঞতা!
গুজব কিস্যার বয়ান
একটার পর একটা গা শিউরে ওঠা ঘটনা সামনে এনে হাজির করে তার সবিস্তার বয়ান তুলে ধরছিলেন সাহস মোস্তাফিজ। আমরা যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছি, তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আর নিজের অজ্ঞতার জন্য নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছিলাম। অবশ্য প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই পিআইবির সহকারী প্রশিক্ষক জিলহাজ উদ্দিন নিপুন আমায় বলেছিলেন, প্রশিক্ষন শেষে তফাতটা বুঝতে পারবেন। ধর্মীয় উন্মাদনা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার একটা উদাহরণ দিয়ে ফের মূল কথায় ফিরছি।
উদারহরণ
যেমন স্কুলে যাবার পথে মালালা ইউসূফ জাঁইকে গুলি করে হত্যার চেষ্ট চালায় বন্দুকধারীরা। পরবর্তীতে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটা ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর। উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকার বাসিন্দা মালালা। স্থানীয় তালিবানরা মেয়েদের স্কুলে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। মালালার পরিবার সেখানে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছিলো। মালালাকে পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য বার্মিংহ্যাম শহরের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে রাতারাতি সমাজিক তারকা বনে যান কিশোরী মালালা। তিনি এখন নানা বিষয়ে বিশ্ব নীতিনির্ধারনি সভায় ভাষণ দেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সী হিসাবে নোবেল পুরষ্কারও পেয়েছেন।
মঞ্চে বা দিক থেকে পিআইডির সহকারী প্রশিক্ষকজিলহাজ উদ্দিন নিপুন, এএফপির বাংলাদেশ ফ্যাক্টচেক এডিটর কদরদ্দিীন শিশির, এবং বক্তব্য রাখছেন সাহস মোস্তাফিজ
প্রশিক্ষণ শুরুর কথা
‘সাংবাদিকতায় ফ্যাক্টচেক বিষয়ক প্রশিক্ষণ’ শীর্ষক তিনদিনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সদস্য কর্মরত সাংবাদিকদের ফ্যাক্টচেক নিয়ে মৌলিক ধারণা, ভুয়া তথ্য, ছবি-ভিডিও, গুজব এবং ওয়েবসাইট যাচাই-বাচাই ছাড়াও সামাজিক ও সংবাদমাধ্যমে ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে হাতে কলমে ধারণা দিতেই এই প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। এই প্রশিক্ষনটি কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য খুই গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তির মতো কঠিন একটি আইন রয়েছে। এই প্রশিক্ষণ সাংবাদিকদের নিজেদের রক্ষায় ঢাল হিসাবে কাজ করবে।
প্রশিক্ষকরা তাদের লব্ধজ্ঞানের ভান্ডার উজার করে দিলেন। দেখালেন, একই ডিজাইনের অসংখ্য ওয়েবসাইট, ভুয়া ছবি ও নিউজ, ধর্মীয় এবং রাজনীতিকে উপজীব্য করে রগড়ানো মালমসলার সমন্বয়ে উপস্থান করা বিষয়গুলো সত্যের মিছিলে ঢুকে গিয়ে কিভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সরল মানুষের ঈমান আকিদাকে পুজি করে ফায়দা লুটে যাচ্ছে। যারা মুখোশের আড়ালে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে তাদের জন্য ব্যঙ্গ করেই বলতে হয় ‘সত্যি কথা বল, বে-পথে চল ওরে আমার মন’।
প্রশিক্ষক কদরুদ্দীন শিশির
কারণ কি ?
সভ্যতার খাতিরে ফ্যাক্টচেকের মাফকাঠিতে বিচার করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, আমরা অনেক ভুলকেই সাদরে গ্রহণ করে থাকি। এর জন্য কাউকে দোষারোপ করা যায় না। চলার পথের ভাঁজে ভাঁজে সম্ভাবনার সঙ্গে সরিসৃপের মতো ওৎ পেতে রয়েছে দুশমন! উদারহরণ টেনে সাহস মোস্তাফিজ বলছিলেন, ফ্যাক্টচেকের সঙ্গে পশ্চিমী দুনিয়া অনেকটা আগে থেকেই পরিচিত এবং কাজ শুরু করলেও এশিয়ায় এর প্রসার ঘটে অনেক দেরিতে। গড়পরতা একেবারেই হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টচেক নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করে থাকেন। তাও স্বল্প পরিসরে। কারণ, এর সঙ্গে যে অর্থনৈতিক বিষয়টি তথা একটা টিম চালানোর মতো সক্ষমতা না থাকলে কাজটি চালিয়ে যাওয়া কঠিন। সাহস মোস্তাফিজ মনে করেন, প্রয়োজনের খাতিরেই আগামী দিনগুলোতে ফ্যাক্টচেক জনপ্রিয়তা পাবে।
বিষয়গুলো
ফ্যাক্টচেক সম্পর্কে ধারণা, ফ্যাক্টচেক কি এবং কেন প্রয়োজন, ভুয়া তথ্যের সাধারণ চরিত্র এবং এর সামাজিক প্রভাব, কিভাবে চেনা যাবে। ভুয়া ছবি ভিডিও, ডাটা ও বক্তব্য যাচাই সফটওয়ার ও অ্যাপসের সঙ্গে পরিচয়, গুগল, ফেইসবুক, ইউটিউব ও টুইটারে অ্যাডডভান্স সার্চ প্রযুক্তির ব্যবহার, ভুয়া ভিডিও এবং স্থান যাচাই করা ইত্যাদি বিষয়ে তিনদিনের টানা প্রশিক্ষণটি সাতদিনের হলে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করা যেতো।
প্রশিক্ষক ড. আবদুল কাবিল খান
তিনজন প্রশিক্ষক
সাহস মোস্তাফিজ, ড. আবদুল কাবিল খান এবং এএফপির ফ্যাক্টচেক বাংলাদেশ এডিটর কদরুদ্দীন শিশির। ফ্যাক্টচেক বিশেষজ্ঞ তিন প্রশিক্ষক তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার দুয়ার খুলে দিলেন প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ৩৫জনের সামনে। বড় পর্দায় বিষয়গুলো যখন হাজির করা হয়, তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করানোটাই কঠিন হয়ে ওঠে! তিনদিনের প্রশিক্ষণে ব্যক্তিগতভাবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনের অজান্তেই বললাম ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু, পা বাড়ালেই পথ’।
সমাপনী আয়োজন
তিনদিনের সমৃদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে উনত্রিশ মার্চ সমাপনী আয়োজনের প্রধান অতিথি হয়ে আসেন বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন পোর্টালের জনক আলমগীর হোসেন। পিআইবি মহাপরিচালক (ডিজি) একুশে পদকপ্রাপ্ত জাফর ওয়াজেদের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব এবং প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সম্পাদক কামাল মোশারেফ।
আলমগীর হোসেন নিজের করা রিপোর্টের উল্লেখ করে এবং উদাহরণ টেনে বলেন, এখনকার রিপোর্টারদের অনেকেই ঘটনাস্থল যেতে চান না। সিন্ডিকেট রিপোর্টিয়ের কারণে গঠনমূলক রিপোর্ট থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম। জাফর ওয়াজেদ বলেন, আমরা প্রশিক্ষণ দিতে চাই। পিআইবির দরজা রিপোর্টারদের জন্য সব সময়ই খোলা। কিন্তু যারা প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন, তারা যদি নিজেদের জন্য সময় মেনে কাজ করেন তাহলেই পিআইবির উদ্যোগ স্বার্থক।
নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, প্রশিক্ষণের বেলায় বয়স বিবেচ্য নয়। জ্ঞান বা পেশাগত দজ্ঞতা অর্জনে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। নুরুল ইসলাম হাসিব ডিআরইউর সকল সদস্যদের পর্যায়ক্রমের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার আশা করেন।