৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐতিহাসিক দিন
‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রথম দেশ হিসেবে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। লোকসভার অধিবেশনে এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা করেন’
নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা
বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন ৬ ডিসেম্বর। এটিকে ইতিহাসের স্মারকও বলা চলে। এদিনে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ভারত ও ভুটান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। তারা মেতে ওঠেছিল হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে। তাদের অত্যাচার কতটা পাশবিক হতে পারে, তা আজ ইতিহাসের পাতা দখল করে রয়েছে।
পৃতিবীতে এমন নৃশংস হত্যা যজ্ঞ সংগঠঠিত হয়েছে বলে জানা নেই। মাত্র ন’মাসে হত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বের তাবত নৃশংসতাকে হার মানিয়েছে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে অতীষ্ট মানুষ নিজেদের জীবন রক্ষায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সংখ্যার দিক থেকে যা কোটির ওপরে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক
এসব শরণার্থী ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র ইত্যাদি যোগান দিয়ে কাঁধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধে সামিল হয়েছে মিত্রবাহিনী।
রক্তে ভেজা বাঙলার প্রান্তর। দুঃসময়ের দীর্ঘ ন’মাস! ঠিক সেই ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান ও ভারত। এদিন ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বর ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দিবস’ পালন করে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন।
ইতিহাসবিদদের মতে, এ স্বীকৃতির পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে বাংলাদেশ। গণতন্ত্র ও মানবতার বৈশ্বিক ইতিহাসে অসামান্য তাৎপর্য বহন করছে এ দিনটি।
দীর্ঘ ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিঠি পাঠায় মুজিবনগর সরকার। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় ৭১’ এর ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অধরাই থেকে যায় বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত স্বাধিকারের স্বীকৃতি। ৬ ডিসেম্বর ভুটান এবং ভারত বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ভারতের সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঘোষণা করলে উল্লাসে ফেটে পড়েন সংসদ সদস্যরা। জয় বাংলা স্লোগানে সেদিন মুখর হয়ে ওঠে ভারতের সংসদ।
দিনটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেদিনই আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে লাল সবুজে খচিত পতাকা।
ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে মুজিবনগর সরকার বলে, এ স্বীকৃতি মানবতা ও গণতন্ত্রের। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে অসামান্য তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন হিসেবে জ্বলজ্বল করছে ৬ ডিসেম্বর।
৬ ডিসেম্বরকে মৈত্রী দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত আসে ২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরকালে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক দিনটি ‘মৈত্রী দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ভারতীয় হাই কমিশন ঢাকায় মৈত্রী দিবসের ৫১তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশন একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ও সঙ্গীতসন্ধ্যার আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্প নেতৃত্ব, সংবাদমাধ্যমকর্মী, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণও এই উদ্যাপনে যোগ দেন।
হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা
সমাবেশে বক্তব্য প্রদানকালে, হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের বিগত ৫১ বছরের অর্জনসমূহ এবং ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করার সুযোগ হিসেবে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরেন। তিনি ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বকে ১৯৭১ সালের যৌথ আত্মত্যাগের মূলে নিহিত এবং ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতির দৃঢ় বন্ধনে লালিত বলে বর্ণনা করেন।
বিগত ৫০ বছরে উভয় দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ অর্জন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি দেশ দুইটির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কর্তৃক ১৯৭১ সালের ইতিহাস অনুধাবন করা ও সেই ঐতিহ্যের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রীর ক্ষেত্রে ভারত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এবং সবসময় বৃহত্তর সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পথে বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে একসঙ্গে হাঁটতে প্রস্তুত থাকবে।
দ্বিপাক্ষিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও নীতির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং পারস্পরিক আস্থা, সম্মান ও বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট এই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বকে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে উভয় দেশের অঙ্গীকারকে আবারও নিশ্চিত করে ভারতীয় ও বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক দলের বর্ণাঢ্য পরিবেশনার মধ্যদিয়ে এই আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।