‘DR. ALIM A MARTYR OF 1971’ বিশ্ব ক্যানভাসে গণহত্যার দলিল (১)

- আপডেট সময় : ০১:৪৯:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ অগাস্ট ২০২২ ৫৯৮ বার পড়া হয়েছে
‘শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর ‘৭১-এ শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী’ বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ ‘DR. ALIM A MARTYR OF 1971 প্রকাশ’
‘অপারেশন সার্চলাইটের নামে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে গণহত্যায় মেতে ওঠে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধচলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী গোষ্ঠী ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা, প্রায় ৪ লাখ বাঙালি নারীকে পরিকল্পিত ধর্ষণ করে। পৃথিবীর কোন দেশে এতো অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যা ও ধর্ষণের নজির নেই। কিন্তু ভাষার কারণে গণহত্যা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনের ইতিহাস বিশ্বাবাসীকে জানাতে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর বইটি বাঙালির সেই আকাঙ্ক্ষা পুরণের একটি দলিল হিসাবে কাজ করবে’
আমিনুল হক, ঢাকা
শহিদের রক্তভেজা উঁচু দেওয়াল। ওপরের অংশটি ঈষত ঝুঁকে অবণত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। তাতে লেখা ‘DR. ALIM A MARTYR OF 1971’। এটি ‘৭১-এ শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী’ বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ। হল ভর্তি শ্রোতা। শোকাবহ পরিবেশ। অতিথিরা মঞ্চে উপবিষ্ট। এমন পরিবেশে ধীর পায়ে এসে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। শান্ত গলায় আয়োজনের কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দুচোখে তার অশ্রু। হৃয়ের রক্তক্ষরণ । এ অবস্থায় কথা বলা কষ্টের। নিজেকে সামলে নিয়ে আলোচনার ঐতিহাসিক স্মৃতির জানালা খুলে দিলেন। তিনি অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী। শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা।
যাকে নিয়ে জানান দিতে এই আয়োজন, তিনি শহিদ বুদ্ধিজীবী বিশিষ্ট চিকিৎসক আলীম চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে দখলদার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। তার হত্যার অন্যতম সহযোগিতায় ছিলো কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আবদুল মান্নান (মাওলানা)।

মানসী কায়েস ও ফারাহ নাজ অনুবাদ করা বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার বাতিঘর
১৯৭১
গোটা বাংলা জ্বলছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বারুদে। নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে মেতে ওঠেছে হানাদার সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এদেশিয় কিছু দালাল। গঠন করা হয় রাজাকার-আলবদর-আল শামস ও শান্তি কমিটি। দালালরা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নিলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। দেশের যখন এমন পরিস্থিতি, সারাবাংলার জানমাল যখন অরক্ষিত, তখনও গোপনে কাজ করে চলেছেন বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক, লেখক, ভাষা সৈনিক ও বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী। তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলেন শিক্ষাজীবন থেকেই। তিনি ভাবতেন মেহনতী মানুষের মুক্তি ছাড়া দেশ কোন দিনই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। এজন্য মানুষকে ভালোবাসতে হবে, তাদের সম্মান জানাতে হবে।
বাম দিক থেকে শহিদ কন্যা অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী, সংসদ সদস্য এ্যারোমা দত্ত, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শহিদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীর
এমন মানবতাবাদী মানুষ ডা. আলীম চৌধুরী ‘আশ্রয় দিয়েছিলেন আবদুল মান্নানকে (মাওলানা, যে কিনা ঢাকা শহরে রাজাকারের তালিকায় একনম্বর, কুখ্যাত)। এযেন খাল কেটে কুমির আনার সামিল। সহজ-সরল মানবদরদী এই চিকিৎসক পরবর্তী লোমহর্ষক কাণ্ডের কথা ক্ষুনাক্ষরেও আমলে আনেননি। ডা. আলীম চৌধুরীর মতো মানুষেরা এমন চিন্তা করতে পারেন না। আসহায় মান্নানকে সপরিবারে মাথা গোজার ঠাঁই দিয়েছেন তার স্বভাবসুলভ বিশ্বাস থেকে। যা নিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেছেন। মানুষের সেবা করে চলেন।
১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর
বাঙলার আকাশে তখন বিজয়ের ধ্বনি। ধ্বংসপ্রায় বাংলাদেশে লালসবুজে খচিত পতাকা উড্ডয়নের অপেক্ষায়। ভারতের বিমান বাহিনী তথা মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে বোমা নিক্ষেপ করছে। হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পনের নির্দেশনা ভেসে আসছে প্রচার মাধ্যমে। টান টান উত্তেজনায় উজ্জীবীত ডা. আলীম চৌধুরী। দীর্ঘ ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তির গানের সুরে জেগে ওঠবে ধ্বংসস্তুপ। এমন একটা মুহূর্তে দরজায় আঘাতের পর আঘাত। তার কিছুটা সময় আগেই একটি মাইক্রোবাস এসে থামে মান্নানের গেটের সামনে। কয়েকজন নেমে তার ঘরে যায়। তারপরই দোতলায় ওঠে এসে ডা. আলীম চৌধুরীরর দরজায় আঘাত হানে।
বা থেকে প্রকাশনার সংস্থা বাতঘিরের নির্বাহী জাফর আহমেদ রাশেদ, প্রকাশনার উদ্যোগক্তা খাদিজা রহমান, অনুবাদক ফারা নাজ, ডা. নুজহাত চৌধুরী
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ডা. আলীম। নিচ তলায় নেমে গিয়ে মান্নানের সঙ্গে কথা বলেন। ভাবলেশহীন মান্নান স্বfভাবিক ভাবেই বললো আপনি ওদের সঙ্গে যান। ডা. রাব্বিকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অজ্ঞতা ফিরে আসেন ডা. আলীম। দুই ও তিন বছর বয়সী দুটো অবুঝ সন্তান। কি অন্যায় করেছিলো তারা? দুই সন্তান এবং স্ত্রীর সামনে দিয়ে রাজাকাররা নিয়ে গেল একজন দেশ প্রেমিককে! আর আলীম চৌধুরীর আশ্রিত কুখ্যাত রাজাকার মান্নান সেসময় বসে হাসলো তামাশার হাসি।
শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী
ঝাপসা হয়ে আসা দু’চোখ মুছে মুছে সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির ইতিহাস লিখেছিলেন স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। হৃদয়ে রক্তক্ষণ ঘটিয়ে যে বর্ণনা তিনি তুলে এনেছিলেন, সেটি পড়া এবং শহীদজায়ার মুখোমুখি বসে সাক্ষাতকার নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সেদিন লালমাটিয়ার উদ্দীপন স্কুলে বসে কথা বলার সময় তার গলা ধরে আসছিলো। কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও বলে গিয়েছেন। যেমনটি বলেছেন নুজহাত চৌধুরী।
‘DR. ALIM A MARTYR OF 1971’
মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে হানাদার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীকে নিয়ে স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর লেখা ‘৭১ এ শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী’ বইটি মূলত বাংলাদেশের গণহত্যার একটি স্মরক। ১৯৯১ সালে বের হওয়া বইটির ইংরেজি অনুবাদ ‘DR. ALIM A MARTYR OF 1971’। যার ইংরেজি অনুবাদে হাত লাগিয়েছেন মানসী কায়েস ও ফারাহ নাজ। বইটি প্রকাশের অন্যতম উদ্যোক্ত খাদিজা রহমান। প্রকাশ করেছে ‘বাতিঘর প্রকাশনী’। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী জাফর আহমেদ রাশেদের অনুভূতি হচ্ছে, ইতিহাসের আলো ছড়াতেই বাতিঘরের জন্ম। এটি ইতিহাস লালনের উদ্যোগ।
অনুবাদক ফারা নাজ
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহনে মঙ্গলবার ঢাকার জাতীয় যাদুঘরের ‘সুফিয়া কামাল মিলনায়ত’নে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। যেখানে প্রধান অতিথি শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, মুখ্য আলোচক ডা. আলশি চৌধুরীর ছাত্র এবং বর্তমান ‘বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, আলোচকনায় অংশ নেন এ্যারোমা দত্ত এমপি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ, নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক ও সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহরিয়ার কবির, ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী মুকুল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও শহীদ সন্তান ডা. নুজহাত চৌধুরী। চলবে