ঢাকা ০২:০৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:০২:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫ ২৮২ বার পড়া হয়েছে

লাবণ্য লিপি

ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সাংবাদিক-লেখক, সামাজ চিন্তিক, বন্ধুবৎসল লাবণ্য লিপি ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের বীরত্বগাথা’ বইটির প্রথম খন্ড প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাতেও তার অতৃপ্তি। কারণ, তার ব্যাপক চিন্তার অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি

আমিনুল হক

মেঘের মহাজন বিদায় নিয়েছে। উত্তর জনপদের কয়েকটি জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু তাপপ্রবাহ। ঢাকার আবহাওয়াও বেশ চড়া। গরমে হাঁসফাঁস। ঈদের লম্বা ছুটিতে অফিস-আদালত বন্ধ। যে কারণে লোডশেটিংয়ের যাতায়তও প্রায় বন্ধ রয়েছে। বিকাল নাগাদ গরম কিছুটা সহনীয় মাত্রা অনুভূত হয়। আদা মেশানো জলমুখে দিয়ে বন্ধু আবু আলীর মোটর বাইকে চড়ে বসলাম। আমার গন্তব্য নীকেতন।

নীল আকাশের সঙ্গে খন্ড খন্ড মেঘের মাখামাখি। ঈদের লম্বা ছুটিতে ব্যস্ততম ঢাকাকে অপরিচিত মনে হয়। ফাঁকা রাস্তায় দুরন্ত গতিতে মোটর বাইক চালাচ্ছে আবু আলী। মাঝে মাঝে গান গাইছে। মায়ের বেণুনীর মতো উড়াল সেতু পেরিয়ে তেজগাঁও প্রান্ত। ডানদিকে বাঁক নিয়ে শিল্পঞ্চলে প্রবেশ করলো আবু আলী। তার মোটর বাইক গিয়ে থামলো পরিবেশ বান্ধব দৈনিক আমাদের সময় কার্যালয়ের সবুজ ছায়ায়।

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা
মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী নারী

এই দৈনিকটির কার্যালয়ের সবুজ ছায়াতলে দু’দন্ড মুক্তবাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আমার গন্তব্যে যেতে বিদায় নিতে চাইলে, বন্ধু আবু আলী বললো, এক পেয়ালা চা পান করেই যাবেন। আর একজন প্রতিথযশা মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, আসুন। আবু আলী এগিয়ে গিয়ে লেখকের কাছে আমার বিষয়ে লম্বা পরিচয় তুলে ধরেন। এরপর এগিয়ে এলেন তিনি।

একমুখ হাসি দিয়ে আমায় আমন্ত্রণ জানালেন তার চেম্বারে। বললেন, আসুন। আমরা দুই বন্ধু গিয়ে বসলাম। তখনও আবু আলী বার বার আমার প্রসঙ্গ উচ্চারণ করছিলো। আবু আলী এবার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, তিনি হচ্ছেন একজন সিনিয়র সাব-এডিটর এবং আমাদের বিভাগীয় সম্পাদক। খুব ভালো লিখেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বই রয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাকে শ্রদ্ধা জানালাম। তার কর্মের ধারে কাছেও যেতে পারবো না। তার মুখে সব সময়ই স্মিত হাসি। নিরাবরণ মুখ। চোখে-মুখে আগামীকে জয় করার স্বপ্ন।

বন্ধু আবু আলী বিগত কয়েক বছর ধরেই আমার বই প্রকাশের কথা বলে বলে ক্লান্ত।  দু’বছর ধরে রীতিমত চাপপ্রয়োগ করে বললো, চূড়ান্ত বইয়ের পান্ডুলিপি নিয়ে যখন বসবেন-বলবেন। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় প্রতিভাবান এই তরুণ লেখক। এ পর্যন্ত তার ৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে।  তার প্রতিটি বই-ই পাঠক  প্রিয়তা পেয়েছে।

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী তরুণ

এরই মধ্যে সাংবাদিক-লেখক, সামাজ চিন্তক বন্ধুবৎসল লাবণ্য লিপি ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের বীরত্বগাথা’ বইটির প্রথম খন্ড প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাতে তার অতৃপ্তি। কারণ, তার ব্যাপক চিন্তার অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। নিঃশ্বাস ছাড়লেন লাবণ্য।  এখনও পর্যন্ত তার ১০টি বই প্রকাশিত হলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও কাজ করতে চান। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বই বের করে তাদের ঋণ স্বীকার করতে চান লাবণ্য।  লাবণ্য যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিলো, তখন তার মধ্যে একটা চঞ্চলতা কাজ করছিলো।

লাবণ্যর কথা আমাকে স্মৃতির জানালায় ঠেলে দেয়। সময়টা একাত্তরের মে মাসের শেষ। পাঁচ বন্ধু ভারতের ত্রিপুরার পথে বাড়ি ছাড়লাম। মা কেঁদে কেঁদে আঁচল ভিজিয়ে ফেলেছেন। মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা তার চোখের জলে ভেজানো আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিলেন। এরপর এক দন্ড সেখানে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে বন্ধুদের সঙ্গে পা বাড়ালাম। একদিন একরাত পেরিয়ে  যখন সোনামুড়া সীমান্তে পৌছে রেজিষ্ট্রেশন করতে লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম, তখন পড়ন্ত বিকেল। কিছুক্ষণ পরদেখা গেলো বড় থালার মতো লাল সূর্য্য ধীরে ধীরে তার মোলায়েম আলোর শেষ টুকু বিলিয়ে বিদায় নিয়েছে।

হারিআপ (hurry up) বিএসএফ তাড়া দিতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। এখানের কাজ শেষ করে পাশেই বিশাল দিঘিতে গোসল করে বাস স্টেশনে গিয়ে আগরতলার বাসে চেপে বসলাম। ভাড়া ছয় নয়া। আমাদের গন্তব্য আগরতলার কংগ্রেস ভবন।

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও অন্যান্য

চলুন ভাই চা খাওয়া হলো না, আবু আলীর একথায় নিজেকে সামলে নিলাম। লোকের অভাবে লাবণ্য চা খাওয়াতে পারেনি বলে তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা বুঝতে বাকী রইলো না। তার মমতামাখা অনুরোধ আবার আসবেন ভাই। আপনার সহযোগিতা চাই। লাবণ্য আমাকে দু’টো উপহার দিলেন। একটি তার প্রচেষ্টার ফসল নারীদের নিয়ে ঈদ আনন্দ বিশেষ সংখ্যা অপরটি পত্রিকার ঈদ আয়োজন বিশেষ সংখ্যা। হাজার কাপ চায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার  দু’টো বুকে চেপে লাবণ্য’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বন্ধু আবু আলীর সঙ্গে বেড়িয়ে এলাম। এবারে  আবু আলীকে বিদায় জানিয়ে আমার গন্তব্যে পা বাড়ালাম। পেছনে পড়ে থাকলো লাবণ্য’র স্মিত হাসি আর আবু আলীর উপহার সুন্দর বিকেলের গল্প।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা

আপডেট সময় : ১২:০২:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫

সাংবাদিক-লেখক, সামাজ চিন্তিক, বন্ধুবৎসল লাবণ্য লিপি ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের বীরত্বগাথা’ বইটির প্রথম খন্ড প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাতেও তার অতৃপ্তি। কারণ, তার ব্যাপক চিন্তার অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি

আমিনুল হক

মেঘের মহাজন বিদায় নিয়েছে। উত্তর জনপদের কয়েকটি জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু তাপপ্রবাহ। ঢাকার আবহাওয়াও বেশ চড়া। গরমে হাঁসফাঁস। ঈদের লম্বা ছুটিতে অফিস-আদালত বন্ধ। যে কারণে লোডশেটিংয়ের যাতায়তও প্রায় বন্ধ রয়েছে। বিকাল নাগাদ গরম কিছুটা সহনীয় মাত্রা অনুভূত হয়। আদা মেশানো জলমুখে দিয়ে বন্ধু আবু আলীর মোটর বাইকে চড়ে বসলাম। আমার গন্তব্য নীকেতন।

নীল আকাশের সঙ্গে খন্ড খন্ড মেঘের মাখামাখি। ঈদের লম্বা ছুটিতে ব্যস্ততম ঢাকাকে অপরিচিত মনে হয়। ফাঁকা রাস্তায় দুরন্ত গতিতে মোটর বাইক চালাচ্ছে আবু আলী। মাঝে মাঝে গান গাইছে। মায়ের বেণুনীর মতো উড়াল সেতু পেরিয়ে তেজগাঁও প্রান্ত। ডানদিকে বাঁক নিয়ে শিল্পঞ্চলে প্রবেশ করলো আবু আলী। তার মোটর বাইক গিয়ে থামলো পরিবেশ বান্ধব দৈনিক আমাদের সময় কার্যালয়ের সবুজ ছায়ায়।

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা
মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী নারী

এই দৈনিকটির কার্যালয়ের সবুজ ছায়াতলে দু’দন্ড মুক্তবাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আমার গন্তব্যে যেতে বিদায় নিতে চাইলে, বন্ধু আবু আলী বললো, এক পেয়ালা চা পান করেই যাবেন। আর একজন প্রতিথযশা মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, আসুন। আবু আলী এগিয়ে গিয়ে লেখকের কাছে আমার বিষয়ে লম্বা পরিচয় তুলে ধরেন। এরপর এগিয়ে এলেন তিনি।

একমুখ হাসি দিয়ে আমায় আমন্ত্রণ জানালেন তার চেম্বারে। বললেন, আসুন। আমরা দুই বন্ধু গিয়ে বসলাম। তখনও আবু আলী বার বার আমার প্রসঙ্গ উচ্চারণ করছিলো। আবু আলী এবার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, তিনি হচ্ছেন একজন সিনিয়র সাব-এডিটর এবং আমাদের বিভাগীয় সম্পাদক। খুব ভালো লিখেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বই রয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাকে শ্রদ্ধা জানালাম। তার কর্মের ধারে কাছেও যেতে পারবো না। তার মুখে সব সময়ই স্মিত হাসি। নিরাবরণ মুখ। চোখে-মুখে আগামীকে জয় করার স্বপ্ন।

বন্ধু আবু আলী বিগত কয়েক বছর ধরেই আমার বই প্রকাশের কথা বলে বলে ক্লান্ত।  দু’বছর ধরে রীতিমত চাপপ্রয়োগ করে বললো, চূড়ান্ত বইয়ের পান্ডুলিপি নিয়ে যখন বসবেন-বলবেন। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় প্রতিভাবান এই তরুণ লেখক। এ পর্যন্ত তার ৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে।  তার প্রতিটি বই-ই পাঠক  প্রিয়তা পেয়েছে।

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী তরুণ

এরই মধ্যে সাংবাদিক-লেখক, সামাজ চিন্তক বন্ধুবৎসল লাবণ্য লিপি ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের বীরত্বগাথা’ বইটির প্রথম খন্ড প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাতে তার অতৃপ্তি। কারণ, তার ব্যাপক চিন্তার অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। নিঃশ্বাস ছাড়লেন লাবণ্য।  এখনও পর্যন্ত তার ১০টি বই প্রকাশিত হলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও কাজ করতে চান। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বই বের করে তাদের ঋণ স্বীকার করতে চান লাবণ্য।  লাবণ্য যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিলো, তখন তার মধ্যে একটা চঞ্চলতা কাজ করছিলো।

লাবণ্যর কথা আমাকে স্মৃতির জানালায় ঠেলে দেয়। সময়টা একাত্তরের মে মাসের শেষ। পাঁচ বন্ধু ভারতের ত্রিপুরার পথে বাড়ি ছাড়লাম। মা কেঁদে কেঁদে আঁচল ভিজিয়ে ফেলেছেন। মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা তার চোখের জলে ভেজানো আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিলেন। এরপর এক দন্ড সেখানে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে বন্ধুদের সঙ্গে পা বাড়ালাম। একদিন একরাত পেরিয়ে  যখন সোনামুড়া সীমান্তে পৌছে রেজিষ্ট্রেশন করতে লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম, তখন পড়ন্ত বিকেল। কিছুক্ষণ পরদেখা গেলো বড় থালার মতো লাল সূর্য্য ধীরে ধীরে তার মোলায়েম আলোর শেষ টুকু বিলিয়ে বিদায় নিয়েছে।

হারিআপ (hurry up) বিএসএফ তাড়া দিতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। এখানের কাজ শেষ করে পাশেই বিশাল দিঘিতে গোসল করে বাস স্টেশনে গিয়ে আগরতলার বাসে চেপে বসলাম। ভাড়া ছয় নয়া। আমাদের গন্তব্য আগরতলার কংগ্রেস ভবন।

সেদিন বিকেলে লাবণ্যর দেখা
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও অন্যান্য

চলুন ভাই চা খাওয়া হলো না, আবু আলীর একথায় নিজেকে সামলে নিলাম। লোকের অভাবে লাবণ্য চা খাওয়াতে পারেনি বলে তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা বুঝতে বাকী রইলো না। তার মমতামাখা অনুরোধ আবার আসবেন ভাই। আপনার সহযোগিতা চাই। লাবণ্য আমাকে দু’টো উপহার দিলেন। একটি তার প্রচেষ্টার ফসল নারীদের নিয়ে ঈদ আনন্দ বিশেষ সংখ্যা অপরটি পত্রিকার ঈদ আয়োজন বিশেষ সংখ্যা। হাজার কাপ চায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার  দু’টো বুকে চেপে লাবণ্য’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বন্ধু আবু আলীর সঙ্গে বেড়িয়ে এলাম। এবারে  আবু আলীকে বিদায় জানিয়ে আমার গন্তব্যে পা বাড়ালাম। পেছনে পড়ে থাকলো লাবণ্য’র স্মিত হাসি আর আবু আলীর উপহার সুন্দর বিকেলের গল্প।