বিশ্ব উষ্ণায়ন : শিয়রে সংকট ফণা তুলেছে!

- আপডেট সময় : ১০:৫৬:০৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১ ২০৭ বার পড়া হয়েছে
শিয়রে সংকট ফণা তুলেছে! বিশ্ব উষ্ণায়ন এর মাত্রা অতিক্রান্ত। গত ৭৩ বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি সেই বরফ যুগের তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ অর্ধেক নামিয়ে আনার ঘোষণা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের। চলতি বছরের ২২ এপ্রিলের ঘটনা। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মি. জো বাইডেন ঘোষণা করলেন, ‘২০৫০ সালের নাগাদ মার্কিন অর্থনীতিকে পুরোপুরি কার্বন মুক্ত করতে চান। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে যুক্তরাষ্ট্রে লাখো ভালো পারিশ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরির দাবিও করছেন বাইডেন। তবে রিপাবলিকানদের দাবি এই পরিকল্পনায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে’।
তবে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ অর্ধেক কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসন আশা করছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণকারী অন্য বড় দেশগুলোও তাদের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াবে।
চীনের পর যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কার্বন নিঃসরণ কমানোর বৈশ্বিক উদ্যোগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যান। কিন্তু বাইডেনের প্রশাসন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আবারও বিশ্ব নেতৃত্বের আসন পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন।
এই লক্ষে জলবায়ু বিষয়ক দুই দিনের ভার্চুয়াল সম্মেলন আয়োজন করেন। ২০০৫ সালে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হতো, সেই মাত্রার পরিমাণ ২০৩০ সালেই অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি এড়াতে এই দশকেই আমাদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাইডেনের এই সিদ্ধান্তকে ‘গেম চেঞ্জিং’ আখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরনের মাত্রা ৪৬ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাপান। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও ৪০-৫০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
কোন কোন খাত থেকে কার্বন নিঃসরনের পরিমাণ কমানো হবে তা বাইডেনের ঘোষণায় না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, গাড়ি নির্মাণ খাত এগিয়ে থাকবে। এই বছরের শেষ নাগাদ বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রকাশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এর আগে ২০৫০ সালে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামাতে একমত ইইউ। কয়লা-নির্ভরশীল দেশ পোল্যান্ডকে ছাড়াই ইউরোপে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় একমত হয়েছেন ইইউ নেতৃবৃন্দ। সিদ্ধান্ত জানাতে পোল্যান্ডকে সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। ব্রাসেলসে ম্যারাথন আলোচনার পর শুক্রবার ইইউ নেতারা পরিকল্পনায় মতৈকে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট শার্লস মিশেল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে ইউরোপের দৃঢ় সংকল্প বোঝাতে এ চুক্তি জরুরি ছিল। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে ২০১৫ সালে প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তির অন্যতম লক্ষ্যগুলোর একটি ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। ইইউ নেতারা ইউরোপকে এই লক্ষ্যপূরণ করা প্রথম মহাদেশ হিসেবে দেখতে চায়।
৮০০০ বছর তাপমাত্রা স্থির ছিল
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে বিগত ১০০বছরে তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে পূর্বের প্রায় ৮০০০ বছর তাপমাত্রা স্থির ছিল। বিজ্ঞানীরা আরও দাবি করেছেন যে, এরকম চলতে থাকলে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.৫ক্ক-২.০ক্ক ঈ পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে।
পৃথিবীর এই ক্রমবর্ধমান তাপবৃদ্ধিই বিশ্ব উষ্ণায়ন নামে অভিহিত। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সভ্যতার প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। এই উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিণ হাউস গ্যাসের প্রভাব, ওজোন স্তরের ক্ষয়। কিন্তু এইসবের পেছনে মূল কারণ হল মানবজাতি।
সময় যত এগোচ্ছে লাগামছাড়া উন্নয়নের প্রচেষ্টায় নিজের ক্ষতি নিজেই ডেকে আনছে মানুষ। কলকারখানা, যানবাহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পক্ষেত্র সবকিছুতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বাড়া, মিথেনের পরিমাণ বৃদ্ধি, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফারের কণা, ক্লোরফ্লুরোকার্বন এইসবই ওজোন স্তরের ক্ষতি এবং গ্রিণ হাউজের প্রভাব বৃদ্ধির সহায়ক।
গাছপালা কাটার ফলে বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এরফলেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মেরু অঞ্চলের বরফ গলনের কারণ। বরফের গলনে জলস্তরের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে পৃথিবীর একটা বিরাট অংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবে।
এছাড়াও এই বিশ্ব উষ্ণায়ন, আবহাওয়ার পরিবর্তনে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে, রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যাভাব, বাসস্থানের সংকট, খরা-বন্যার প্রকোপ, দুর্ভিক্ষ, ডেকে আনছে উষ্ণায়ন। সর্বোপরি মানুষের অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে। পরিবেশবিদ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র সব জায়গা চাপ বাড়ছে এই সমস্যার মোকাবিলার জন্য।
জীবাশ্ম জ্বালানীর, রাসায়নিক সার, মিথেনের ব্যবহার হ্রাস, ই-ওয়েস্ট বা ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য আমদানী বন্ধ করে অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, পরিকল্পিত বনায়ন, শক্তিসাশ্রয়ী আবাসন নির্মাণ করতে হবে। সবথেকে বড় কথা মানুষকে তার নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে হবে আসন্ন ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে, নয়তো মানুষ সহ পুরো সভ্যতাকে ধ্বংসের সম্মুখিন হতে হবে।
ফিরে আসার আর কোন উপায় নেই। মানব সমাজ অতিক্রম করেছে চূড়ান্ত সীমা। গোটা বিশ্ব জুড়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে যতই সচেতনতা, গবেষণা, আলোচনা সভা, বৈঠক চলুক না কেন আমরা পার করেছি লক্ষণ রেখা। বিপদ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমনটাই মনে করছেন জার্মান বিজ্ঞানী তথা অধ্যাপক মার্কাস রেক্স। তার বক্তব্য বিশ্ব উষ্ণায়ন বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখান থেকে আবার ফিরে আসা অসম্ভব।
বিজ্ঞানীর রেক্সের বক্তব্য অনুযায়ী, গ্রীষ্মকালের সুমেরু মহাসাগর থেকে যেভাবে উধাও হয়ে যাচ্ছে বরফ, সেখান থেকে প্রমাণিত বিপদ এখন শিয়রে। তার কথা অনুযায়ী বিশ্ব উষ্ণায়ন এর ক্ষেত্রে আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটা মাইন ফিল্ডে। একবার এদিক ওদিক হলেই মৃত্যু।
বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব কতটা পড়েছে তার পরীক্ষা করতেই অধ্যাপক রেক্সের নেতৃত্বে কুড়িটি দেশের ৩০০ জন বিজ্ঞানী সুমেরু মহাসাগরের অভিযান চালান। যেখানে প্রায় ৩৮৯ দিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। প্রায় দেড়শ টেরা বাইট তথ্য এবং এক হাজারেরও বেশি বরফ এর নমুনা নিয়ে তারা ফিরে আসেন জার্মানিতে।
এই গোটা অভিযানে খরচ পড়ে ১৪০ মিলিয়ন ইউরো। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বিজ্ঞানীরা সেখান থেকে কোন আশাপ্রদ খবর নিয়ে আসতে পারেননি।
কারণ তারা বলছেন যে, গ্রীষ্মকালে সুমেরু মহাসাগর এক দশক আগেও যতটা বড় ছিল বর্তমানে তা গলে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। যখন থেকে উত্তর মেরু সাগরে বরফ গলা শুরু হয়েছে মোটামুটিভাবে সেই গলনের মাত্রা রেকর্ড করতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা।
সেখানে দেখা গেছে ২০২০ সালে বসন্তকালে সবচেয়ে দ্রুত হারে বরফ গলেছে। যা দেখে বিজ্ঞানী রেক্সের আশঙ্কা হয়তো আর কয়েক দশক পরে সুমেরু মহাসাগরে বরফের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। অর্থাৎ বিপর্যয় নিশ্চিত।