বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলবাসীর মুক্তির পাঁচবছর
- আপডেট সময় : ০৫:২০:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ অগাস্ট ২০২০ ৪৫১ বার পড়া হয়েছে
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা শেখ হাসিনার হাত ধরে ছিটমহলবাসীর মুক্তি
আমিনুল হক
ব্রিটিশ মাতব্বর সিরিল র্যাডক্লিফ যে মানবিক সমস্যার সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন, ৬৮ বছরের ছিটমহলবাসীদের সেই অবরুদ্ধ জীবনের মুক্তি আসে মানবতার ‘মা’ শেখ হাসিনার হাত ধরে। যারা দীর্ঘ বছর ভারতবর্ষকে শোষণ-নীপিড়নের ভারত মাতার অনেক সন্তানের রক্তের বিনিময়ে তাদের তাড়ানো সম্ভব হয়। সেই বৃটিশদের হাতে তুলে দেয়া হয় ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের দায়িত্ব। সে বছরের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে উড়ে আসেন মি. রেডক্লিফ। তাকে প্রধান করে গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। বিশাল ভারতবর্ষ ভাগ করে ভারত-পাকিস্তান মানচিত্র প্রকাশ করে এক কলঙ্কের গোড়াপত্তন করলেন মি. র্যাডক্লিফ। এই মানচিত্রের কারণে ১৬২টি খন্ডভূমি অর্থাৎ ছিটমলের সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অভ্যন্তরে। এমন ভাগাভাগি আশ্চর্যের খাতায় নাম লেখাতে পারে। ইতিহাস তাই বলছে।
পরিসংখ্যার থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহলে বসবাসরত লোকসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ছিল ১৪ হাজার। ২৪ হাজার ২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দুই দেশের ছিটমহল ছিল। তার মধ্যে ভারতের জমির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ১৫৮ একর এবং বাংলাদেশের ছিটমহলের জমির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে ৫৯ টি, পঞ্চগড়ে ৩৬ টি, কুড়িগ্রামে ১২ টি ও নীলফামারিতে ৪টি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার ৪৭টি ও জলপাইগুড়ি জেলায় ৪টি।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ
১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ কালো রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। তারপর বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ববঙ্গের সহজ সরল মানুষের ওপর রাতের আঁধারে হামলে পরে। তারা নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালায়। দলে দলে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা পাশাপাশি মেয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসিকে হামলা এবং ধর্ষণ করে। সারাবাংলায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে পাক সেনারা। সেময় কাতারে কাতারে মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাল-সবুজে খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা অর্জিত হয়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিটমহল বিলুপ্তি করতে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বঙ্গবন্ধু নেতেৃত্বে বাংলাদেশ হয়েছে এবং শেখ হাসিনার হাত ধরে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। এই ঐতিহাসিক মাইফলকের মধ্য দিয়ে ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটে ছিটমহলবাসীর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ এক নয়া ইতিহাস। যা কোন দিন বাংলার মানুষ ভুলবে না।
শেখ হাসিনার হাত ধরে মুক্ত ছিটমহল
২০১৫ সালের পহেলা আগস্ট বাংলাদেশ-ভারত নয়, ইতিহাস সৃষ্টি করেছে গোটা দুনিয়ায়। এদিন ৬৮টি বছরের বন্দিদশার অবসান ঘটে ছিটমহলবাসীর। এর সঙ্গে অবসান ঘটে পাকিস্তান-ভারত সীমানা নির্ধারণের অসহনীয় পরিস্থিতির। এই কাঙ্খিত দিনটির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষ শেখ হাসিনার জন্য বিশেষ প্রার্থনা করেন। আর বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন ছিটমহল বিলুপ্তি বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয়। ছিটমহল সমস্যার সমাধানের পরই সেখানে উন্নয়নের কাজে হাত লাগান শেখ হাসিনা। রাস্তাঘাট, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল অর্থাৎ মানুষের প্রয়োজনে যা দরকার তার কিছুরই কমতি নেই সেখানে। এ কয়েক বছরেই পাল্টে গেছে অবহেলিত ছিটমহলের চিত্র।
মুক্ত ছিটমহলে উন্নয়নের ছোঁয়া
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবনের অবসান ঘটিয়ে পেয়েছেন শতভাগ বিদ্যুতায়ন, প্রশস্ত পাকা রাস্তা, সরকারি উদ্যোগে নির্মিত মসজিদ ও মন্দির, বিটিসিএল কর্তৃক অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল সেন্টার, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাসহ সকল প্রকার নাগরিক সেবা। গত চার বছরে বিশেষ বরাদ্দে দাসিয়ারছড়ায় প্রায় ২২ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এলজিইডির মাধ্যমে ২৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তৈরী হয়েছে। কমিউনিটি রির্সোস সেন্টার, ৫টি মসজিদ, ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি মন্দির, ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নীলকমল নদীতে ব্রিজ, ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি হত দরিদ্র পরিবারের বসতবাড়ি নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ১৫টি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ১৪টি মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র। ৫টি হাইস্কুল, ১টি মাদ্রাসা ও একটি কলেজ।
৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের ৪ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছেন দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দারা। রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্জলন ও কেক কাটা ও দোয়া মমাহফিলেরর আয়োজন। ১ আগস্ট সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুস্পমাল্য অর্পন। এদিন দাশিয়ারছড়ার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার আয়োজন ও বিকাল ৩টায় ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা ও জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু’র আয়োজন করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ৭ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিবাচক ভূমিকায় ভারতীয় পার্লামেন্টের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হয়। এ বিলটি পাসের ক্ষেত্রে মাধ্য দিয়ে দীর্ঘ বছরের অমীমাংসিত ও জটিল স্থল সীমান্ত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হলো। ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সম্প্রতি আইনটি পাস হওয়ায় দুই দেশের সীমানাভুক্ত ছিটমহলগুলোতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আনন্দ বয়ে যাচ্ছে। ছিটের বাসিন্দা হিসেবে নয়, এবার তারা পরিচিত হবে নিজ নিজ দেশের পরিচয়ে, ভোগ করবে সকল নাগরিক সুবিধা।