পহেলা বৈশাখ ঘিরে চারুকলায় এক সন্ধ্যার গল্প

- আপডেট সময় : ০৭:৩৫:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৭৮ বার পড়া হয়েছে
আমিনুল হক ভূইয়া
চারুকলার বারান্দায় বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক সম্রাট আকবরের বিশাল আকারের পটচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের গলিপথে হাটলেন তাজরিনা। বললেন, বাংলা নববর্ষ বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসে সমৃদ্ধ একটি দিন। পহেলা বৈশাখ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দিনটি আমাদের গর্বের ইতিহাস। বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ বাংলা নববর্ষ। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের প্রেরণা জোগায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে নববর্ষকে বরণ বাঙালি জাতিসত্তাকে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রেরণা জোগায়।
দক্ষিণ এশিয়া তথা এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল, যা ভৌগোলিকভাবে অঞ্চলটি আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ নিয়ে গঠিত। চীন ও আরবের পরে বাঙালিরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। দক্ষিণ এশিয়ার একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠী, যারা বঙ্গ অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা এবং বর্তমানে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকা, নিম্ন আসাম এবং মণিপুরের কিছু অংশে বসবাস করে। তবে, সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। এটইি ইতিহাস।

চারুকলার বকুল তলায় চলছে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান। খরতাপের চৈত্রমাসকে বিদায় জানিয়ে পহেলা বৈশাখের আহ্বানই ভেসে আসছিলো। বকুলতলার মঞ্চ ঘিরে হাজারো মানুষের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। একটি পরিবর্তি সময়ে পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনের আবাহনে মেতে ওঠেছে চারুকলা। নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় পা মেলাবে লাখো মানুষ। এই যাত্রা দেশবাসীর স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার যাত্রা। আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ধারণ করে বাঙালি হৃদয়ে আবর্তিত হয় নতুন বছরে নতুন দিন, আমরা উদ্দীপিত ও জাগ্রত হই।
তাজরিনা বলছিলো, দমবন্ধ পরিবেশ থেকে একটা জাতির মুক্তির আনন্দের পথ বেয়ে হাজির এবারের পহেলা বৈশাখ। একটা মুক্ত পরিবেশে মহামিছিলে হাটবো আমরা। সেই আয়োজনই চলছে চারুকলা ঘিরে। একমাসের অধিক সময় ধরে এখানকার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ছাড়াও এখানের পাঠ চুকিয়ে চলে যাওয়া অনেকেই নাড়িরটানে ছুটে আসেন এবং বর্ষবরণের উপকরণ তৈরির কাজে হাত লাগান, পরামর্শ দেন।

সম্রাট আকবরের পটচিত্রে সযত্নে তুলি চালাচ্ছেন নাজিম আহমেদ। আশপাশে দাঁড়িয়ে অসংখ্য দর্শণার্থী তা প্রত্যক্ষ করছেন। অনেকে জানতে চাইছেন এবারের নতুন সংযোজন নিয়ে। একমুখ হাসি দিয়ে তাদের উত্তর দিচ্ছেন নাজিম আহম্মদ। জানালেন, এবারে আনন্দ শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ পাঁচটি পটচিত্র। এরমধ্যে বাদশা আকবর, গাজীরপট, বেহুলা, বনবিবি ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পটচিত্রে চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ পালন করা হয় বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে। পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষের পঞ্জিকার প্রবর্তক মহামতি আকবর।

যতটা জানা যায়, হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে ভারতবর্ষে মোগল সম্রাজ্য পরিচালিত হতো। এই পঞ্জিকা মূলত চাঁদের উপর নির্ভরশীল। আর কৃষকদের কৃষি কাজ চাঁদের হিসাবের সঙ্গে মিলতো না বলেই অসময়ে খাজনা পরিশোধ করতে কৃষকদের দুর্ভোগ পোহাতে হতো। এই ভাবনা থেকেই কৃষকদের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর বর্ষ পঞ্জিতে সংস্কার আনেন। সম্রাট আকবরের আদেশে সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও হিজরি সন এর ওপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন।
তখন সন্ধ্যা। চারুকলার মোলায়েম পরিবেশ। গাছগাছালি ছুঁয়ে হাল্কা বাতাসে প্রশান্তির পরশ। ডানে-বামে সবাই বৈশাখের উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত। তাজরিনার সঙ্গে আলাপ করতে করতে ফোয়ারা পেরিয়ে বাম দিকে মোড় নিয়ে দু’কদম হেটে থেমে গেলো তাজরিনা। সেদিন ভোরেই এখানে একটি উপকরণ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ডান পাশে পোড়ানো শিল্পকর্মটি নতুন করে তৈরিতে মহাব্যস্ততা দেখা গেলো। এবার ৩৬ শে জুলাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তাজরিনা। দ্রুত কয়েকটি ছবি তোলার পর তার অনুসন্ধ্যানি দৃষ্টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঘিরে। তারও কয়েকটি ছবি ক্যামেরাবন্দী করলেন। বাদ যায়নি জাতীয় মাছ ইলিশের ছবি তোলা। মূলত তাজরিনা একজন চিত্রশিল্পী।

কবে থেকে আসলো বাংলা সন পালনের প্রচলন। স্মিত হাসলেন তাজরিনা। ইতিহাস বলছে, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সন গণনা করা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে খাজনা আদায়ে গণনা কার্যকর শুরু করা হয়েছিলো ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। পূর্বে ফসল কাঁটা ও খাজনা আদায়ের কারণে এই বছরের নাম ছিলো ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ আর বাংলা সন করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করতে হতো কৃষকদের। তখন থেকেই সম্রাট আকবর কৃষকদের জন্য মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। হালখাতার প্রচলনও সম্রাট আকবরের হাত ধরেই আসে।
ধারণা করা হয়, বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন, বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জৈষ্ঠ্য, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ এমন করেই বাংলায় নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়।

আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রেগরীয় বর্ষ পঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল-শোভাযাত্রা বাঙ্গালির নববর্ষ উদযাপনের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নেয়।
২০১৬ সালে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষাণা করে। বাংলাদেশে মহাধুমধামে নববর্ষ ১৪ এপ্রিল পালিত হলেও পাশ্ববর্তী দেশে পালন করা হয় ১৫ এপ্রিল। কারণ, দেশটিতে হিন্দু সম্প্রদায় তিথি পঞ্জিকা অনুসরণ করে থাকে। তবে, বাংলাদেশের মতো পহেলা বৈশাখ তথা বর্ষবরণের এমন মহাআয়োজন বিশ্বের আর কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না।