ঢাকা ০৫:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পরিবেশ কি কেবলই বিদ্যা নাকি আরও অনেক কিছু?

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস (মালদা) পশ্চিমবঙ্গ 
  • আপডেট সময় : ০৮:২৭:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুন ২০২১ ২৮৭ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। স্মরণ করছি আরণ্যক ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। লেখকের অজস্র লেখনীর মধ্যে থেকে বেছে নিচ্ছি ‘হলুদ নদী সবুজ বন ’ নামক উপন্যাসটির কয়েকটি ছত্রকে। কেনোনা, আমি মনে করি, বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও সাম্প্রতিক কালের ইয়াস, বুলবুল, আয়লা, লায়লার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশের সুন্দরবনের চারিত্রিক গঠনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হলুদ নদী সবুজ বন’ এর অসম্ভব যোগসাজশ রয়েছে।

শুরুতেই একটি বাঘ-এর লোকালয়ে ঢুকে পড়া ও কিছু আরণ্যক জীবজন্তুকে আক্রমন করাকে কেন্দ্র করে লেখক এই মহা নিখিলের অনন্ত অঙ্গনের চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু প্রশ্ন বিশ্ববাসীর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন…..

আকাশে অষ্টমীর চাঁদ একপাশে হেলে পড়ে আছে। পৃথিবীতে তাই আবছা আঁধার। এই আঁধার চোখ মেলে দেখা যায়। সব জীবন্ত প্রাণীর চোখে এই মজার ধাঁধা—-খাঁটি অন্ধকার দেখার সাধ্য নেই। একটু আলো চাই। আঁধার একটু আবছা হওয়া চাই। নইলে চোখ টের পাবে না, অন্ধকারে একেবারেই অন্ধ হয়ে থাকবে।

এখন মাঝরাত্রি পার হয়ে গিয়েছে। রাত্রি কিন্তু নিঝুম হয়নি। রাত্রিচর পাখি ও পশুর আওয়াজ ঘুমন্ত পৃথিবীতে প্রাণের সাড়া তুলছে, বিচিত্র সে আওয়াজ— মধুর ও কর্কশ।

 

ওদের যেনো জগৎসংসারকে জানিয়ে দেবার দায় যে, প্রাণীরা রাত্রির অবসরে একটু শুধু ঘুমিয়েছে, তারা মরেনি, তারা আবার জাগবে….

উপরোল্লিখিত বাক্যগুলো এতক্ষণে আমাদেরকে একটু একটু করে স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, জগৎসংসারে যুক্ততার সূত্র অনুযায়ী কিছু জলজ প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের ইকোলজিকাল ছবি।

নেচার পত্রিকায় ‘আ সেফ অপারেটিং স্পেস ফর হিউম্যানিটি’ নামে একটি শিরোনামে বলা হয়েছে-আমাদের বাস্তুতন্ত্রের নানা সংগৃহীত উপাদানের মধ্যে প্রত্যেকটিরই ভারসাম্যের একটি সীমা আছে, যাকে বলা হয় প্ল্যানেটারি লিমিট। সেই সীমা অতিক্রম করলে বিপদ হবেই।

ফিরছি আবার ওই উপন্যাসে।

একটি আততায়ী বাঘকে মারতে ঔপন্যাসিক কয়েকটি শহুরে উদ্যোক্তাকে একত্রিত করেছেন। শহুরে কেনো? বাঘ তো কখনো শহুরে হয়না! সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল জানে কেবলই খিদে নামক যুদ্ধের মহানায়ক হতে। তা সে গরু, ছাগল, হরিণ এমনকি মানুষ পর্যন্তকে সে খিদে মেটাতে গলদঘরণ করে।

—— প্রকান্ড বাঘটা নিঃশব্দেই এসেছিলো। যে থাবার একঘায়ে গরু মহিষ, মানুষের ঘাড় ভেঙে দিতে পারে…..

এমনই একটি বাঘকে ঔপন্যাসিক বন ঘেষা লক্ষ্মণ নামক এক গৃহস্থের গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে গরুকে হত্যা করিয়ে দিলেন।
একটি হত্যার বদলে আরও একটি প্রাণীর হত্যাকান্ড সংঘটিত হোলো কতগুলো শহুরে হুজুগে মানুষ আর একজন মাত্র গ্রামীণ মানুষ ঈশ্বরের হাতে। এতগুলো মানুষের বন্দুকের নলের থেকে কার তাক্ বাঘকে ঘায়েল করলো, সে শুধু জানেন ঈশ্বর।

কেননা, বাঘটির মৃত্যুর পর তিন তিনটি পেট্রোম্যাক্স-এর আলোয় দেখা বহুরূপীর মতো বাঘটার পেছনে দাঁড়ানো ঈশ্বরকে ঔপন্যাসিক দায়ী করেছেন।

আসলে জলাজঙ্গল-এর এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে- এই ‘ঈশ্বর’ আসলে কোনো মানুষ নয়। নব্য শহরের কলকারখানা ঘেড়া চিমনির কালো রঙের ধোঁয়ায় ঢাকা গভীর অরণ্যের নিভৃতি ভঙ্গকারীদের জন্যে ‘ঈশ্বর’ আসলে প্রকৃতি। এই ঈশ্বরের হাতেই নির্বিচারে অরণ্যের হত্যালীলার পার্ষদেরা শেষ বিচার পায়!

প্রকৃতির জলবায়ু দ্রুতগতীতে পরিবর্তীত হচ্ছে। লাগামছাড়া শিল্পায়নের নামে অপরিকল্পিত ভাবনায় বলিদান করতে হচ্ছে অরণ্যকে। অথচ এই অরণ্যের ভিতরে থাকে অসংখ্য অরণ্যচারী, যারা স্থলচর, খেচর, উভচরও। মানুষ ও সেইসব প্রাণীদের সহাবস্থানে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা হয়। আতুরঘর হিসেবে পৃথিবীর তিনভাগ মাটিতে মানুষসহ অসংখ্য স্থলচর প্রাণীর বসবাস। অথচ শক্তিশালী প্রাণী হিসেবে মানুষ অবলীলায় উন্নয়নের নামে জঙ্গল সংলগ্ন মাটি কেটে সভ্যতার ইমারত গড়ছে।

ওই যে ‘হলুদ নদী আর সবুজ বন’ এর মরা বাঘটার আততায়ী হিসেবে অহং প্রদর্শন করা ক্লাবকালচারে অভ্যস্ত রবার্টসন, প্রভাস! এরা লেখকের পরিভাষায় এক-একজন আধুনিক বিশ্বের বন ধ্বংসকারী। হ্যাঁ, প্রশ্ন করতে হয়- একটি বাঘ কখন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে? যখন লোকালয় নামক একদা অরণ্যকে মানুষ নির্বিচারে ধ্বংস করে, তখনই ফুরিয়ে যাওয়া একদা বনচারী জঙ্গলরাজ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সেই তথাকথিত মানুষের সাম্রাজ্যে এসে হামলা করে।

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি শ্রী কল্যাণ রুদ্র তার লেখা পৃথিবীর ক্রমহ্রাসমান জীববৈচিত্র্যে বলেছেন, মানুষ বাস্তুতন্ত্র থেকে নানা উপাদান নিয়ে বেঁচে থাকেন। একজন মানুষ বাস্তুতন্ত্রকে যতটা প্রভাবিত করেন, তা হিসেব করা হয় তার ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট থেকে। পরিমাপ করার একক হোলো গ্লোবাল হেক্টর।

কোনও দেশের জনসংখ্যা, ভোগ্যদ্রব্যের উৎপাদন, অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি, বর্জ্যের পরিমাণ ইত্যাদির নিরিখে ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট পরিমাপ করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন-একজন মানুষের ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট ১.৭ গ্লোবাল হেক্টর এর মধ্যে থাকলে পৃথিবী তার ভারসাম্যকে সামলে নিতে পারে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ভারতে তা ১.৬ গ্লোবাল হেক্টর থাকলেও উত্তর আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়াসহ উত্তর এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট ৫ গ্লোবাল হেক্টর অতিক্রম করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে জন প্রতি ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট ২.৮ গ্লোবাল হেক্টর। অর্থাৎ আমরা বায়ো ক্যাপাসিটি অতিক্রম করে বায়ো ডাইভার্সিটিতে আছি।

এই যে একের পর এক বিধ্বংশী ঝড়সহ সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়া, এবং সভ্যতার চরম অস্থিরতাকে আবাহন করা! এও তো একরকমের যে গাছের ডালে বসবাস, তারই শির উচ্ছেদ করা! বেঁচে থাকার জন্য সুমিষ্ট জলভান্ডার থেকে অধিক পরিমাণে জলত্তোলনসহ একের পর এক অরণ্য হত্যা, পাহাড় ফাটিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্বরান্বিতকরণ প্রক্রিয়ার ফলেই আজ কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণকালে আমরা সিলিন্ডারে ভরা অক্সিজেনের শরনার্থী!

তবুও আশা-নিরাশার দোলাচলে দোদুল্যমান মানুষ আবারও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘হলুদ নদী আর সবুজ বন’ এর শেষ পর্যায়ে পৌঁছে শুনতে পান–সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের কালে জলাজঙ্গলের আদি মনুষ্যি লখার মা গলা চড়িয়ে বলেন, বড্ড তুই নরম মানুষ, নইলে এ দশা হয়? চালাটা পরে গিয়েছে, উপায় কি, পায়ের নীচের মাটিতো সরে যায়নি! আয় সবাই মিলে মানুষটাকে ধরাধরি করে নৌকায় তুলি…

হ্যাঁ, আজ এটাই সত্যি আর এটাই প্রতিজ্ঞাবাক্য যে, ধ্বংসকারী মানুষই তার সৃজনী দিয়ে বরাভয়ী প্রকৃতির নৌকোতে ভরাডুবী মানুষকে তুলবে—-আমরা আশাবাদী।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

পরিবেশ কি কেবলই বিদ্যা নাকি আরও অনেক কিছু?

আপডেট সময় : ০৮:২৭:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুন ২০২১

৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। স্মরণ করছি আরণ্যক ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। লেখকের অজস্র লেখনীর মধ্যে থেকে বেছে নিচ্ছি ‘হলুদ নদী সবুজ বন ’ নামক উপন্যাসটির কয়েকটি ছত্রকে। কেনোনা, আমি মনে করি, বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও সাম্প্রতিক কালের ইয়াস, বুলবুল, আয়লা, লায়লার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশের সুন্দরবনের চারিত্রিক গঠনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হলুদ নদী সবুজ বন’ এর অসম্ভব যোগসাজশ রয়েছে।

শুরুতেই একটি বাঘ-এর লোকালয়ে ঢুকে পড়া ও কিছু আরণ্যক জীবজন্তুকে আক্রমন করাকে কেন্দ্র করে লেখক এই মহা নিখিলের অনন্ত অঙ্গনের চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু প্রশ্ন বিশ্ববাসীর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন…..

আকাশে অষ্টমীর চাঁদ একপাশে হেলে পড়ে আছে। পৃথিবীতে তাই আবছা আঁধার। এই আঁধার চোখ মেলে দেখা যায়। সব জীবন্ত প্রাণীর চোখে এই মজার ধাঁধা—-খাঁটি অন্ধকার দেখার সাধ্য নেই। একটু আলো চাই। আঁধার একটু আবছা হওয়া চাই। নইলে চোখ টের পাবে না, অন্ধকারে একেবারেই অন্ধ হয়ে থাকবে।

এখন মাঝরাত্রি পার হয়ে গিয়েছে। রাত্রি কিন্তু নিঝুম হয়নি। রাত্রিচর পাখি ও পশুর আওয়াজ ঘুমন্ত পৃথিবীতে প্রাণের সাড়া তুলছে, বিচিত্র সে আওয়াজ— মধুর ও কর্কশ।

 

ওদের যেনো জগৎসংসারকে জানিয়ে দেবার দায় যে, প্রাণীরা রাত্রির অবসরে একটু শুধু ঘুমিয়েছে, তারা মরেনি, তারা আবার জাগবে….

উপরোল্লিখিত বাক্যগুলো এতক্ষণে আমাদেরকে একটু একটু করে স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, জগৎসংসারে যুক্ততার সূত্র অনুযায়ী কিছু জলজ প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের ইকোলজিকাল ছবি।

নেচার পত্রিকায় ‘আ সেফ অপারেটিং স্পেস ফর হিউম্যানিটি’ নামে একটি শিরোনামে বলা হয়েছে-আমাদের বাস্তুতন্ত্রের নানা সংগৃহীত উপাদানের মধ্যে প্রত্যেকটিরই ভারসাম্যের একটি সীমা আছে, যাকে বলা হয় প্ল্যানেটারি লিমিট। সেই সীমা অতিক্রম করলে বিপদ হবেই।

ফিরছি আবার ওই উপন্যাসে।

একটি আততায়ী বাঘকে মারতে ঔপন্যাসিক কয়েকটি শহুরে উদ্যোক্তাকে একত্রিত করেছেন। শহুরে কেনো? বাঘ তো কখনো শহুরে হয়না! সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল জানে কেবলই খিদে নামক যুদ্ধের মহানায়ক হতে। তা সে গরু, ছাগল, হরিণ এমনকি মানুষ পর্যন্তকে সে খিদে মেটাতে গলদঘরণ করে।

—— প্রকান্ড বাঘটা নিঃশব্দেই এসেছিলো। যে থাবার একঘায়ে গরু মহিষ, মানুষের ঘাড় ভেঙে দিতে পারে…..

এমনই একটি বাঘকে ঔপন্যাসিক বন ঘেষা লক্ষ্মণ নামক এক গৃহস্থের গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে গরুকে হত্যা করিয়ে দিলেন।
একটি হত্যার বদলে আরও একটি প্রাণীর হত্যাকান্ড সংঘটিত হোলো কতগুলো শহুরে হুজুগে মানুষ আর একজন মাত্র গ্রামীণ মানুষ ঈশ্বরের হাতে। এতগুলো মানুষের বন্দুকের নলের থেকে কার তাক্ বাঘকে ঘায়েল করলো, সে শুধু জানেন ঈশ্বর।

কেননা, বাঘটির মৃত্যুর পর তিন তিনটি পেট্রোম্যাক্স-এর আলোয় দেখা বহুরূপীর মতো বাঘটার পেছনে দাঁড়ানো ঈশ্বরকে ঔপন্যাসিক দায়ী করেছেন।

আসলে জলাজঙ্গল-এর এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে- এই ‘ঈশ্বর’ আসলে কোনো মানুষ নয়। নব্য শহরের কলকারখানা ঘেড়া চিমনির কালো রঙের ধোঁয়ায় ঢাকা গভীর অরণ্যের নিভৃতি ভঙ্গকারীদের জন্যে ‘ঈশ্বর’ আসলে প্রকৃতি। এই ঈশ্বরের হাতেই নির্বিচারে অরণ্যের হত্যালীলার পার্ষদেরা শেষ বিচার পায়!

প্রকৃতির জলবায়ু দ্রুতগতীতে পরিবর্তীত হচ্ছে। লাগামছাড়া শিল্পায়নের নামে অপরিকল্পিত ভাবনায় বলিদান করতে হচ্ছে অরণ্যকে। অথচ এই অরণ্যের ভিতরে থাকে অসংখ্য অরণ্যচারী, যারা স্থলচর, খেচর, উভচরও। মানুষ ও সেইসব প্রাণীদের সহাবস্থানে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা হয়। আতুরঘর হিসেবে পৃথিবীর তিনভাগ মাটিতে মানুষসহ অসংখ্য স্থলচর প্রাণীর বসবাস। অথচ শক্তিশালী প্রাণী হিসেবে মানুষ অবলীলায় উন্নয়নের নামে জঙ্গল সংলগ্ন মাটি কেটে সভ্যতার ইমারত গড়ছে।

ওই যে ‘হলুদ নদী আর সবুজ বন’ এর মরা বাঘটার আততায়ী হিসেবে অহং প্রদর্শন করা ক্লাবকালচারে অভ্যস্ত রবার্টসন, প্রভাস! এরা লেখকের পরিভাষায় এক-একজন আধুনিক বিশ্বের বন ধ্বংসকারী। হ্যাঁ, প্রশ্ন করতে হয়- একটি বাঘ কখন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে? যখন লোকালয় নামক একদা অরণ্যকে মানুষ নির্বিচারে ধ্বংস করে, তখনই ফুরিয়ে যাওয়া একদা বনচারী জঙ্গলরাজ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সেই তথাকথিত মানুষের সাম্রাজ্যে এসে হামলা করে।

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি শ্রী কল্যাণ রুদ্র তার লেখা পৃথিবীর ক্রমহ্রাসমান জীববৈচিত্র্যে বলেছেন, মানুষ বাস্তুতন্ত্র থেকে নানা উপাদান নিয়ে বেঁচে থাকেন। একজন মানুষ বাস্তুতন্ত্রকে যতটা প্রভাবিত করেন, তা হিসেব করা হয় তার ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট থেকে। পরিমাপ করার একক হোলো গ্লোবাল হেক্টর।

কোনও দেশের জনসংখ্যা, ভোগ্যদ্রব্যের উৎপাদন, অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি, বর্জ্যের পরিমাণ ইত্যাদির নিরিখে ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট পরিমাপ করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন-একজন মানুষের ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট ১.৭ গ্লোবাল হেক্টর এর মধ্যে থাকলে পৃথিবী তার ভারসাম্যকে সামলে নিতে পারে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ভারতে তা ১.৬ গ্লোবাল হেক্টর থাকলেও উত্তর আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়াসহ উত্তর এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট ৫ গ্লোবাল হেক্টর অতিক্রম করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে জন প্রতি ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট ২.৮ গ্লোবাল হেক্টর। অর্থাৎ আমরা বায়ো ক্যাপাসিটি অতিক্রম করে বায়ো ডাইভার্সিটিতে আছি।

এই যে একের পর এক বিধ্বংশী ঝড়সহ সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়া, এবং সভ্যতার চরম অস্থিরতাকে আবাহন করা! এও তো একরকমের যে গাছের ডালে বসবাস, তারই শির উচ্ছেদ করা! বেঁচে থাকার জন্য সুমিষ্ট জলভান্ডার থেকে অধিক পরিমাণে জলত্তোলনসহ একের পর এক অরণ্য হত্যা, পাহাড় ফাটিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্বরান্বিতকরণ প্রক্রিয়ার ফলেই আজ কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণকালে আমরা সিলিন্ডারে ভরা অক্সিজেনের শরনার্থী!

তবুও আশা-নিরাশার দোলাচলে দোদুল্যমান মানুষ আবারও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘হলুদ নদী আর সবুজ বন’ এর শেষ পর্যায়ে পৌঁছে শুনতে পান–সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের কালে জলাজঙ্গলের আদি মনুষ্যি লখার মা গলা চড়িয়ে বলেন, বড্ড তুই নরম মানুষ, নইলে এ দশা হয়? চালাটা পরে গিয়েছে, উপায় কি, পায়ের নীচের মাটিতো সরে যায়নি! আয় সবাই মিলে মানুষটাকে ধরাধরি করে নৌকায় তুলি…

হ্যাঁ, আজ এটাই সত্যি আর এটাই প্রতিজ্ঞাবাক্য যে, ধ্বংসকারী মানুষই তার সৃজনী দিয়ে বরাভয়ী প্রকৃতির নৌকোতে ভরাডুবী মানুষকে তুলবে—-আমরা আশাবাদী।