‘কেন আমি রাজনীতিতে এলাম’ : গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার এমপি (পর্ব-১)
- আপডেট সময় : ০১:৪৭:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ জুন ২০২৩ ৭৫৪ বার পড়া হয়েছে
‘হিমালয়ের মতো মাথা উচু করা দিকপালের সামনে বসে আছেন তিনি। মুখে স্মিত হাসি। বাম পাশে জাতিকে সাহস জাগানিয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ডান পাশে দৃঢ় প্রত্যয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাবা এবং মেয়ে দু’জনই বাঙালি জাতির মূর্ত প্রতীক। গণনায়ক থেকে শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের উন্নয়ন পটভূমিকে সামনে রেখে ‘কেন আমি রাজনীতিতে এলাম’ গ্রন্থের লেখক শহীদ পরিবারের সন্তান প্রতিথযষা আইনজীবী এবং সংসদ সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণ সরকার। এ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ভয়েস একাত্তরের সঙ্গে। লেখাটি ধারাবাহিক প্রকাশ করা হচ্ছে, আজ পাঠকের জন্য প্রথম কিস্তি প্রকাশ করা হলো’
মানুষের অনুভুতির অন্যতম হচ্ছে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা। আমার বাবা সুশান্ত সরকার শানু শিকারি বলতেন, মায়ের অস্তিত্ব রক্ষায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছি, কোন কিছু পাওয়ার জন্য নয়। দাদিমা নীলিমা শিকারী নীলু বাবাকে সেই মন্ত্রেই দীক্ষা দিয়েছিলেন। আমাদের বাগান বাড়িতে দাদিমার নেতৃত্বে এলাকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তৈরি করে তোলতেন। বাবা এলাকার মানুষদের নৌকা করে রাতের আঁধারে সুন্দরবন হয়ে ভারতে পৌছে দিতেন। এই কাজ করতে গিয়ে একাধিকবার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। প্রতিবারই বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মুক্ত হয়ে আসতে সক্ষম হন। এ বিষয়ে বাবা বলতেন, দেশমাতৃকার জন্য ভালোবাসার শক্তিই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে তাকে রক্ষা করেছে।
তখন দেশের প্রতিটি স্থানে পাকিস্থানী বাহিনী পৌছে গিয়ে যথারীতি নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটে মেতে ওঠে। বাংলার নিরীহ মানুষদের পাখির মতো গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তাদের দোসর হিসাবে যোগ এদেশের কুলাঙ্গার রাজাকার, আল-বদর ও আল-সামস। তারা সুন্দরী মেয়ে, কারো স্ত্রী, কারো বোনকে ধরে এনে পাকবাহিনী ক্যাম্পে পৌছে দিতো। মুক্তিবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধের সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যক্তিদের খোঁজখবর নিয়ে পাকিস্থানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হামলা চালানো এবং সেইসব মানুষদের নির্বাচারে হত্যা করতো।
আমার দাদিমার খবরও পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে পৌছে দেয় রাজাকাররা। একদিন রাতে বাগান বাড়ি ঘেরাও করে দাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। দাদি ছিলেন খুই সাহসী। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাশের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও তার শেষ রক্ষা হয়নি। ভোরবেলা রাজাকাররা তার অবস্থানের খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে আহত দাদিমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং পশুর নদীর তীরে গুলিতে করে হত্যা করে। তারপরও মরদেহ টুকরো টুকরো করে পশুর নদীতে ফেলে দেয়।
এ পর্যন্ত বলে থামলেন সংসদ সদস্য এডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার। নিশ্বাস নিলেন ধীর লয়ে। চোখে মুখে তার সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে হাল্কা মনে করেন। এরপর খুলে দিলেন স্মৃতির জানালা।
বাবার মুখে দাদিমার আত্মত্যাগের কথা শুনে শৈশব থেকেই দাদিমার পথ অনুসরণের সংকল্প নিয়েছিলাম। বাবা-দাদিমা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ও নিজেকে গড়ে তোলার মন্ত্র। স্কুলে পড়াকালীন অবস্থায় রাজনৈতিক অঙ্গণে পা রাখা। কলেজ জীবনে পুরোপুরি রাজনৈতিক অঙ্গনের বাসিন্দা। যশোর মহিলা কলেজে পড়া অবস্থায় কলেজ ছাত্রলীগের সহসম্পদক হিসাবে দায়িত্ব পালন । উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তেজগাঁও কলেজে পড়া অবস্থায় পুরোপুরি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত । আইন শাস্ত্রে লেখাপড়া শেষ করে পেশাগত জীবনে কাজ করার সুযোগে রাজনীতির অঙ্গনে পদচারণা নিয়মে পরিণত হয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
মানুষের ভালোবাসা
কেন আমি রাজনীতে এলাম
দেশমাতৃকার জন্য দাদিমা ও বাবা সুশান্ত সরকার শানু শিকারির আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাসকে সঙ্গী করে আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে যুক্ত হলাম। দাদিমার আত্মত্যাগ এবং জাতির পিতার আদর্শকে সামনে রেখে রাজনীতিতে পথ চলা শুরু। বঙ্গবন্ধু আমার বিচারে এক মানবদেবতা। বাংলার অবিংসবাদীত নেতার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কারাগারে। মানুষের ভাগ্যপরিবর্তনের রাজনীতি করতে গিয়ে জেল-জুলুমকে গায়ে মাখেননি।
বঙ্গবন্ধুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ‘লাঙ্গল-জোয়াল থেকে মহাকাশ জয়’। তাঁর এই দূরদর্শিতা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই শেখ হাসিনা যেন আরও জ্বলে ওঠছেন। একজন সফল ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে পিতার মতো তিনি মানুষের কথা। তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন। মহান নেতার পর শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা আমাকে চুম্বকের মতো টানে।
আজকের যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, তার কৃতিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ। কারণ, পাকিস্তান নাম রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল অবহেলিত। এখানের মানুষ ছিল সহজ-সরল। তারা কৃষি কাজ ছাড়াও কলেকারখনায় কাজ করতেন। এখানের মানুষ শিক্ষায় পিছিয়ে ছিল। এক দেশের নাগরিক হয়েও পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। তাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালানো হতো। একদেশের হয়েও পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোন উদ্যোগ নেওয়া হতো না।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস‘ বইতে লিখেছেন পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই “পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসাবে দেখা হতো।
পাকিস্তান শাসকদের এই দ্বিমুখো আচরণ মেনে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। ফুঁসে ওঠলেন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অগ্রসেনানী বঙ্গবন্ধু। তাঁর ভূমিকায় খুশি হতে পারেনি শাসক গোষ্ঠী।
১৯৭১ সাল। ২৫ শে মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে বাংলার নিরীহ মানুষের ওপর। তারা নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগম লুটপাট ইত্যাদিতে মেতে ওঠে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান করে নেয় লালসবুজে খচিত পতাকা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু বলেন, এবার তোমাদের আর কেউ শোষণ অত্যাচার করতে পারবে না। সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। যেখানে প্রতিটি মানুষ মিলেমিশে বসবাস করবে।
বঙ্গবন্ধু হাত লাগালেন যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্রীজ কালভার্ট সংস্কার ইত্যাদিতে। নবগত বাংলাদেশের জ্বালানি শক্তি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধু বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেল থেকে খুব কমমূল্যে তিতাসের পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র কিস্তিতে কিনে নিলেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ নিজস্ব জ্বালানি শক্তির দেশের খাতায় নাম লেখাল। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপদগামী সদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, জাতীয় চার নেতাকেও কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
এরপর ফের আন্ধকারাচ্ছন্ন বাংলাদেশ। বেহুলা বাংলায় পরিণত হয় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ। কেটে যায় ২১ বছর। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। বাংলার আকাশে উদীত হয় নবসূর্য। ২১ বছর পর পিতার পর মেয়ে দেশ শাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, শুরু হল অগ্রযাত্রা। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব দিকে অগোছালো পরিস্থিতি। দীর্ঘ একুশ বছরের নানা অনিয়ম মাথা তুলে দাঁড়ায়। এসব সামাল দিয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিরামহীন কাজ করেছে চলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ২০০১ সালে ফের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ক্ষমতার মসনদে।
এবারে আবারও থেমে যায় বাংলার উন্নয়ন। লোডশেডিং, কলেকারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়া, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যা চারিদিক ঘিরে ফেলে। এমন এক পরিস্থিতিতে বাবার মতো তিনিও মানুষের দুঃসময়ে বসেন থাকতে পারেননি। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আবারও রাজ পথে নামেন শেখ হাসিনা।
শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য নানা রকমের ফন্দিফিকিরের আশ্রয় নেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ২০০৮ সালে নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। ২০০৯ সালে ৮ জানুয়ারী জাতির পিতার সুযোগ কন্যা বাংলার উন্নয়নের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
টানা ১৪ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল
একটা সময় ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে যারা তাচ্ছিল্য করতো, আজ তারাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার কল্যাণে। বাংলাদেশে নতুন জাগরণের সৃষ্টি হলো শেখ হাসিনার নেতৃতে। সমালোচকদের মুখে ছাই ঢেলে অর্থ-সামজিক অবস্থার উন্নয়ন সড়কে গতিশীল বাংলা। কমে গেলো লোডশেডিং, কলেকারখানায় উৎপাদনে গতি পেল, বাড়তে থাকলো রপ্তানি। একদিন যেখানে উন্নয়ন কাজের সিংহ ভাগ হতো ঋণের টাকায়, আজ সেখানে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে পৃথিবীকে বজ্র কণ্ঠের ধ্বনি শুনিয়ে দেওয়া হলো ‘তোমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না’। কড়ায় গন্ডায় শেখ হাসিনা জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যার যোগ্যতার প্রমাণ রেখে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন। শেখ হাসিনার হাত ধরে অঙ্কুরোদগম হল ডিজিটাল বাংলাদেশের। আর বর্তমানে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘কোয়ান্টিটি নয় শেখ হাসিনা জোর দিলেন কোয়ালিটির ওপর’।
আজ যখন নির্বাচনী এলাকায় যাই, তখন অবাক তাকিয়ে থাকি। বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের মতো বিশাল মহাসড়ক ধরে শতমাইল গতিতে ছুটে চলে গাড়ি। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এই সোনার বাংলাইতো গড়তে চেয়েছিলেন মানবদেবতা। তিনি সময় না পেলেও তার কন্যা আজ তারই স্বপ্নে সোনার বাংলার বাস্তব রূপদানে দিনরাত কাজ করে চলেছেন।
রাস্তার পাশে চায়ের দোকানীকে যখন স্মার্ট ফোনে কথা বলতে দেখি, তখন অবাক তাকিয়ে থাকি। স্কুল ড্রেস পড়া শিক্ষার্থীদের স্মার্টনেন্স দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। আমার ছেলেবেলা তো এমন ছিল না।
একটা পিছিয়ে পড়া দেশকে নিজের প্রচেষ্টায় বর্তমান জায়গান এনে দাড় করালেন শেখ হাসিনা। প্রতি মুহূর্তো প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। আমরা কি এর থেকে কিছু শিখছি? নাকি ইতিহাস আর আত্মগরিমায় আজও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেই যাচ্ছি? সমালোনা নয়, আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। বাংলাদেশের উন্নয়নের ছবিগুলো নিয়ে একবার ভাবুনতো। নাকি একটুও ভাবায় না! বাঙালির এই জড়ত্ব কি ঘুচবে না! চলবে