ঢাকা ০৮:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এক মসৃণ ক্যানভাসে আঁকা ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, মালদা (পশ্চিমবঙ্গ)
  • আপডেট সময় : ১০:৫৫:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুন ২০২১ ৩২৫ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ছবি সংগ্রহ

‘চৌদ্দ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছিল যে কারণেই তাকে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন’ ১ জুলাই তার জন্ম ও মৃত্যুদিন। এদিনটি সারা ভারতে ‘চিকিৎসক দিবস’ রূপে পালিত হয়ে থাকে। তাকে স্মরণ করে বিধান ক্যানভাসে লিখেছেন শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস’।

মহামারি, অতিমারি এসব ধ্বংসাত্মক গতি। এই গতির কবলে বিশ্বের সাথে ভারতও জর্জরিত। দেশের স্বাধীনতার ৭৪ বছর অতিক্রান্ত কালে ভারতীয়দের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকার যৎপরোনাস্তি চিন্তিত থাকলেও, যা চিন্তনেরও অসাধ্য, তা হলো ক্রমধারাবাহিকভাবে দেশের সংস্কৃতির হস্তান্তরিত উত্তর পুরুষ নির্মাণ করা।

পৃথিবী আজ বিধ্বস্ত। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রিয় ভাষা বাংলাতে কথা বলা, বাংলায় হাসা-কাঁদা ও বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধির অগ্নি মশালকে যে বাঙালি নিজের হাতে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেই উভয় বাংলার খনিজ সম্পদ হিসেবে, বরেণ্য চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়কে আজকের ডাক্তার দিবসের প্রাক্কালে বুঝি আরও একবার আলোচনা করে, বাঙালির নতুন যুগের সম্মানিত নাগরিকদের কাছে তুলে ধরবার প্রয়োজন বোধ করছি।

স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক যুগ ব্যাপী মনীষীদের জীবনীপাঠ বাধ্যতামূলক ছিলো। আজও, তা নাই বললে,অত্যুক্তিই হবে! কিন্তু, যা আছে, তা হলো চর্বিতচর্বণ কিছু হালকা বুনটের গু-গোলীয় গাঁথা কথামালা ও টেলিভিশন সেটের নানা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক যুক্তি-অযৌক্তিক কথার ফুলঝুরি। অথচ, তথ্যের বিপুলতার এই যুগে চাইলেই হাত বাড়ানো বন্ধুর মতো, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্টের পথচলতি মানুষ পারেন নিজের প্রয়োজনের তাগিদে তাদের দেশজ মনুষ্য সম্পদ হিসেবে বরণীয়দের কথা জেনে নিতে।

কিন্তু, দুঃখের বিষয় হলেও এটাই সত্যি যে, পুস্তক পাঠের অনীহায় আক্রান্ত নাগরিক তার যান্ত্রিক জীবনের স্বল্পতার কারনে স্বল্প পরিশ্রমের করতলগত স্মার্ট ফোনের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করতে ভালোবেসে ফেলেছে ।

জীবন যেভাবে জীবনকে দেখে, তা একরকমের জয়পরাজয়ের গল্পও বলা যেতে পারে। পৃথিবীতে বারংবার মহামারি এসেছে, গেছে। যারা চলে গেছে, তারা গেছে। কিন্তু, যারা বর্তমান এই কোভিড কালের চিকিৎসাবিজ্ঞান, ঔষধবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের অত্যন্ত প্রাদূর্ভাবের মধ্যেও স্বচ্ছ জলধারার মতো চির ভাস্বর, তাদেরই অন্যতম হলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।

১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ও আমৃত্যু যিনি একই পদে বহাল ছিলেন – তিনি ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। ওনার জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে(১লা জুলাই) বা, একই ব্যক্তি, যিনি একইসাথে ইংল্যান্ডের এমআরসিপি ও এফআরসিএস -একথা অনেকেই জানেন। কিন্তু যা জানাবোঝার বাইরের পৃথিবীতে বারংবার লঙ্ঘিত হচ্ছে , তা হলো মানবাধিকার, মানবতাবোধ এবং সর্বপরি মানবতাবাদ।

অধুনা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা উপজেলার দেবহাটার শ্রীপুর গ্রামের নিবাসী, পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ও মাতা অঘোর কামিনী দেবীর ছয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান বিধান রায় বিহার রাজ্যের পাটনা শহরের বাঁকিপুরে জন্ম গ্রহণ করেন।

অত্যন্ত দরিদ্র ঘরে জন্মে তিনি যেভাবে চিকিৎসা পরিষেবাকে সাধারণ্য থেকে অসাধারণ্যের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, আজ তা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। সমগ্র বিশ্বের সাথে আজ, ভারতের পশ্চিমবাংলা এবং ডাক্তার রায়-এর পূর্বাশ্রম বাংলাদেশ কোভিড মহামারীর প্রকোপে আক্রান্ত।

ঠিক এই সময়েই স্মরণীয় ডাক্তার রায়, যিনি বর্তমান নীলরতন সরকার হাসপাতালের চিকিৎসক ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মভার গ্রহণ করেছিলেন। এর পরেরটা হচ্ছে খ্যাতির চূড়ান্তে একজন চিকিৎসকের পৌঁছে যাওয়ার অদম্য মনোবলের গল্প।

বর্তমানের বাস্তবতা হচ্ছে মহামারি ও চিকিৎসা পরিষেবা এবং চিকিৎসকের এক উজ্জ্বল ভূমিকা প্রতিষ্ঠার উল্লেখযোগ্য কাল। একথা ঠিক, গত প্রায় দেড় বছর যাবৎ কোভিড আক্রান্ত হয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বহু চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী নিজেদের মহামূল্যবান জীবনকে বলিদান করেছেন।

কোভিড-এর দ্বিতীয় তরঙ্গের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বহু মান্যবর চিকিৎসক তাদের অমূল্য জীবনের সময়কে সেবার অনন্য নজীরের উত্তুঙ্গতায় নিয়ে গেছেন। এমনকি, আগমনী তৃতীয় তরঙ্গটির জন্যও চিকিৎসা পরিষেবাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন চিকিৎসক মহল।

তবুও আচমকা মহামারি পরিস্থিতিতে যতটা সামলানোর কথা ছিলো, হয়তো ততটা আশাব্যাঞ্জক হয়ে ওঠেনি পরিসেবা। প্রশ্ন এখানেই যে, কোথাও কি ডাক্তার বিধান রায়-এর মতো মুখ দেখে, বা চলন দেখে অথবা কাশির শব্দ শুনে, বিনা পরিক্ষায় রোগটা কি, একথা বলে দেওয়ার মত ডাক্তারের অভাব বোধ করেনি দরিদ্র নারায়ণের দেশের নাগরিকবৃন্দ?

কথিত আছে যে, একবার রায়টার্স বিল্ডিং এ বিকেলের ছুটির সময়ে কর্মরত এক ঝাড়ুদারের কাশির শব্দ শুনে নিজের চেম্বারের কর্তব্যরত সহকর্মীকে দিয়ে তাকে যাদবপুরের টিবি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। কারণ, তিনি স্থির প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, এই ধরনের কাশি টিবি রোগের অন্যতম লক্ষ্মণ।

আর সত্যিই, কফ্ থুতু পরিক্ষায় সেই ঝাড়ুদারের টিবি রোগই সনাক্ত হয়েছিলো। পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর শরীর খুব খারাপ। ডাক্তার রায়কে ডেকে পাঠালেন তারই সুযোগ্যা তনয়া শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।

দিল্লিতে পৌঁছে নেহেরুর অবস্থা দেখে বিচলিত ডাক্তার রায় নেহেরুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার সেনকে খুব ধমকে দিলেন। বললেন গরম জল ও সাবান আনতে। এরপরে নেহেরুজীকে পাজামা খুলতে বলতেই নেহেরু লজ্জিত হয়ে ধমকে উঠলেন ডাক্তার রায়কে।

কিন্তু ডাক্তার রায় বললেন-এখন আমি ডাক্তার, আর তুমি রোগী। এরপরেই ডুশ দিয়ে নেহেরুর পেট পরিষ্কার করে দিতেই পন্ডিত নেহেরু সুস্থ বোধ করতে লাগলেন। সমগ্র বিষয়টিই নিজের হাতে সম্পাদন করেছিলেন ডাক্তার রায়।

বর্তমানকালের কোভিড মহামারির অন্যতম লক্ষ্মণ কাশি, যা শুনলে চিকিৎসক অবশ্যই আরটিপিসিআর কিম্বা অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে বলবেন এবং যা সত্যিই এই সময়কালে এক উদ্দেকজনক ও ব্যায়বহুল বিষয়ও বটে! শুরুতে বাঙালির যে উত্তরসুরী দিয়ে এই আলোচনা প্রারম্ভলাভ করেছিলো, কোথায় যেনো সেই ঢেউ এক ধাক্কায় আজকের বাংলার পটভূমিতে ভাঙন ধরালো।

সংস্কৃতিচেতনার এক অনন্য আকর বিধান রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একে একে লবনহৃদ, কল্যাণী, অশোকনগর, হাবরা প্রভৃতি নগরী। দেশভাগের সময় ওপার বাংলার শরনার্থীদের এপারে বাসস্থান ও পুর্নবাসনের জন্য সেদিনের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়-এর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিলো তৎকালিন কলোনিয়াল সোসাইটি তৈরির মধ্য দিয়ে।

ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়-এর রোগীর তালিকায় বিখ্যাতদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাস, জহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধী, বল্লভভাই প্যাটেল এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিও ছিলেন।

ডাক্তার রায়-এর ব্যাক্তিগত জীবনে প্রেম ছিলো নীরব, যা কল্যাণময়ী নারীর মতো। তাই তো তার নিজের হাতে গড়া বর্তমান স্মার্ট নগরী কল্পনার কল্যাণী শহর, সল্টলেক আজ বিশ্ব সমাদৃত। যদিও চিরকুমার ডাক্তার রায়-এর প্রেমিকা কল্যাণী নামের একটি মেয়ের সম্পর্কে জীবনীকার কে পি টমাস বলেছেন, এবিষয়ে তার কোনোদিনই বিধান রায়-এর সাথে কোনো কথা হয়নি।

একদিকে মুখ্যমন্ত্রীত্ব, অপরদিকে ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে ব্রম্মস্তোত্র ও গীতাপাঠ করে ১৬ জন রোগীকে নিঃখরচায় দেখে, সারা দেশের বিশেষ বিশেষ মহান নাগরিকেরা, যে যেখানেই অসুস্থ হয়েছেন, চিকিৎসা দিতে ছুটে গিয়েছেন বিধান রায়। মহাত্মা গান্ধীকে তিনি যে কতবার চিকিৎসা করেছেন, সেইসব ঘটনাবলী লিখতে বসলে আস্ত একটি বই হয়ে যাওয়া সম্ভব।

ডাক্তার রায়-এর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণার একটি গল্প রয়েছে। এক ইন্সিওরেন্স কোম্পানির মিটিংয়ে তিনি কৌতুক করে বলেছিলেন, এক রোগী একটি ছুরি গিলে ফেলেছেন। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ তাকে ওষুধের একটি মাত্রা দিলেন। ওমনি পেটের ছুরির ধার ভোতা হয়ে গেলো। ২য় ডোজে ছুরিটির ফলাটা কাঠের হাতলের ভাজে ঢুকে গেলো। সর্বশেষ ডোজে ছুরিটি রোগীর গলা দিয়ে সরসর করে বেরিয়ে গেলো রোগীর কোনো ক্ষতি না করে।

নিজের পেশার ডাক্তারদের নিয়েও তার সরেস রসিকতার নানা প্রমাণ আছে। একবার হাইদ্রাবাদের এক সভায় তিনি ভাষণ শেষ করেছিলেন এই গল্পটি বলে।

লন্ডনের উপকন্ঠে একদল গুন্ডা পিস্তল দেখিয়ে একটি বাস থামিয়ে প্যাসেঞ্জারদের সকলের কাছ থেকে টাকাকড়ি ছিনতাই করে অবশেষে শেষ যাত্রী এক বৃদ্ধের কাছে আসতেই, বৃদ্ধ বললেন-আমি পেশায় একজন চিকিৎসক। আমরা টাকা ও জীবন-দুই-ই নিয়ে থাকি।

এ হেনো স্বনামধন্য চিকিৎসক সম্পর্কে নানা কথার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিলো তার নিজের চিকিৎসা। এই বিষয়েই ডাক্তার রায়কে তারই সহকর্মী নলিনীরঞ্জন সরকার প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো সকলের চিকিৎসা করেন। তো, আপনার চিকিৎসা কে করেন? শুনে ডাক্তার বিধান রায় ওমনি একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে নিজের প্রতিকৃতিকে দেখিয়ে বলেছিলেন- কেনো, ডাক্তার বি সি রায়!

কোভিডে মানুষ পোকামাকড়ের মতো মারা যাচ্ছে। যারা জীবিত, তারাও মনোরোগে মৃত প্রায়। আর এই রোগ আজ রাজ দরবার থেকে আঙিনায়। বিধান রায় বেঁচে থাকলে হয়তো তার রসিকতার কথোপকথনে মৃতপ্রায় মানুষের মনের ব্যাধিতে প্রলেপ পড়তো। কিন্তু মানুষই মরনশীল। তাই এহেনো চিকিৎসককেও বিধির নোটিশে চলে যেতে হয়েছিলো।

তবে যাওয়াটাও ছিলো আশ্চর্যের জন্মদিনেই যাওয়া। আগেই সহায়ককে বলে রেখেছিলেন, অন্তিম ইচ্ছের কথা। যথারীতি, সকালের স্নান, পূজাপাঠ ও ফলের রস গ্রহণ। আর ১লা জুলাই-এর ১৯৬২-তে অল ইন্ডিয়া রেডিও ঘোষণা করলো, ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় বেলা এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে পরপারে চলে গেলেন।

কোভিডএর মতো মহামারি হয়তো শতাব্দীতে একবার আসে। আবার চলেও যায়। কিন্তু মারণরোগ ও তার নিরাময়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসকেরা ও চিকিৎসা-বিজ্ঞান থেকে যায় মানুষের মননে, যেমন রয়ে গেছেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

এক মসৃণ ক্যানভাসে আঁকা ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়

আপডেট সময় : ১০:৫৫:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুন ২০২১

ছবি সংগ্রহ

‘চৌদ্দ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছিল যে কারণেই তাকে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন’ ১ জুলাই তার জন্ম ও মৃত্যুদিন। এদিনটি সারা ভারতে ‘চিকিৎসক দিবস’ রূপে পালিত হয়ে থাকে। তাকে স্মরণ করে বিধান ক্যানভাসে লিখেছেন শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস’।

মহামারি, অতিমারি এসব ধ্বংসাত্মক গতি। এই গতির কবলে বিশ্বের সাথে ভারতও জর্জরিত। দেশের স্বাধীনতার ৭৪ বছর অতিক্রান্ত কালে ভারতীয়দের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকার যৎপরোনাস্তি চিন্তিত থাকলেও, যা চিন্তনেরও অসাধ্য, তা হলো ক্রমধারাবাহিকভাবে দেশের সংস্কৃতির হস্তান্তরিত উত্তর পুরুষ নির্মাণ করা।

পৃথিবী আজ বিধ্বস্ত। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রিয় ভাষা বাংলাতে কথা বলা, বাংলায় হাসা-কাঁদা ও বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধির অগ্নি মশালকে যে বাঙালি নিজের হাতে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেই উভয় বাংলার খনিজ সম্পদ হিসেবে, বরেণ্য চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়কে আজকের ডাক্তার দিবসের প্রাক্কালে বুঝি আরও একবার আলোচনা করে, বাঙালির নতুন যুগের সম্মানিত নাগরিকদের কাছে তুলে ধরবার প্রয়োজন বোধ করছি।

স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক যুগ ব্যাপী মনীষীদের জীবনীপাঠ বাধ্যতামূলক ছিলো। আজও, তা নাই বললে,অত্যুক্তিই হবে! কিন্তু, যা আছে, তা হলো চর্বিতচর্বণ কিছু হালকা বুনটের গু-গোলীয় গাঁথা কথামালা ও টেলিভিশন সেটের নানা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক যুক্তি-অযৌক্তিক কথার ফুলঝুরি। অথচ, তথ্যের বিপুলতার এই যুগে চাইলেই হাত বাড়ানো বন্ধুর মতো, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্টের পথচলতি মানুষ পারেন নিজের প্রয়োজনের তাগিদে তাদের দেশজ মনুষ্য সম্পদ হিসেবে বরণীয়দের কথা জেনে নিতে।

কিন্তু, দুঃখের বিষয় হলেও এটাই সত্যি যে, পুস্তক পাঠের অনীহায় আক্রান্ত নাগরিক তার যান্ত্রিক জীবনের স্বল্পতার কারনে স্বল্প পরিশ্রমের করতলগত স্মার্ট ফোনের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করতে ভালোবেসে ফেলেছে ।

জীবন যেভাবে জীবনকে দেখে, তা একরকমের জয়পরাজয়ের গল্পও বলা যেতে পারে। পৃথিবীতে বারংবার মহামারি এসেছে, গেছে। যারা চলে গেছে, তারা গেছে। কিন্তু, যারা বর্তমান এই কোভিড কালের চিকিৎসাবিজ্ঞান, ঔষধবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের অত্যন্ত প্রাদূর্ভাবের মধ্যেও স্বচ্ছ জলধারার মতো চির ভাস্বর, তাদেরই অন্যতম হলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।

১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিম বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ও আমৃত্যু যিনি একই পদে বহাল ছিলেন – তিনি ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। ওনার জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে(১লা জুলাই) বা, একই ব্যক্তি, যিনি একইসাথে ইংল্যান্ডের এমআরসিপি ও এফআরসিএস -একথা অনেকেই জানেন। কিন্তু যা জানাবোঝার বাইরের পৃথিবীতে বারংবার লঙ্ঘিত হচ্ছে , তা হলো মানবাধিকার, মানবতাবোধ এবং সর্বপরি মানবতাবাদ।

অধুনা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা উপজেলার দেবহাটার শ্রীপুর গ্রামের নিবাসী, পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ও মাতা অঘোর কামিনী দেবীর ছয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান বিধান রায় বিহার রাজ্যের পাটনা শহরের বাঁকিপুরে জন্ম গ্রহণ করেন।

অত্যন্ত দরিদ্র ঘরে জন্মে তিনি যেভাবে চিকিৎসা পরিষেবাকে সাধারণ্য থেকে অসাধারণ্যের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, আজ তা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। সমগ্র বিশ্বের সাথে আজ, ভারতের পশ্চিমবাংলা এবং ডাক্তার রায়-এর পূর্বাশ্রম বাংলাদেশ কোভিড মহামারীর প্রকোপে আক্রান্ত।

ঠিক এই সময়েই স্মরণীয় ডাক্তার রায়, যিনি বর্তমান নীলরতন সরকার হাসপাতালের চিকিৎসক ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মভার গ্রহণ করেছিলেন। এর পরেরটা হচ্ছে খ্যাতির চূড়ান্তে একজন চিকিৎসকের পৌঁছে যাওয়ার অদম্য মনোবলের গল্প।

বর্তমানের বাস্তবতা হচ্ছে মহামারি ও চিকিৎসা পরিষেবা এবং চিকিৎসকের এক উজ্জ্বল ভূমিকা প্রতিষ্ঠার উল্লেখযোগ্য কাল। একথা ঠিক, গত প্রায় দেড় বছর যাবৎ কোভিড আক্রান্ত হয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বহু চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী নিজেদের মহামূল্যবান জীবনকে বলিদান করেছেন।

কোভিড-এর দ্বিতীয় তরঙ্গের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বহু মান্যবর চিকিৎসক তাদের অমূল্য জীবনের সময়কে সেবার অনন্য নজীরের উত্তুঙ্গতায় নিয়ে গেছেন। এমনকি, আগমনী তৃতীয় তরঙ্গটির জন্যও চিকিৎসা পরিষেবাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন চিকিৎসক মহল।

তবুও আচমকা মহামারি পরিস্থিতিতে যতটা সামলানোর কথা ছিলো, হয়তো ততটা আশাব্যাঞ্জক হয়ে ওঠেনি পরিসেবা। প্রশ্ন এখানেই যে, কোথাও কি ডাক্তার বিধান রায়-এর মতো মুখ দেখে, বা চলন দেখে অথবা কাশির শব্দ শুনে, বিনা পরিক্ষায় রোগটা কি, একথা বলে দেওয়ার মত ডাক্তারের অভাব বোধ করেনি দরিদ্র নারায়ণের দেশের নাগরিকবৃন্দ?

কথিত আছে যে, একবার রায়টার্স বিল্ডিং এ বিকেলের ছুটির সময়ে কর্মরত এক ঝাড়ুদারের কাশির শব্দ শুনে নিজের চেম্বারের কর্তব্যরত সহকর্মীকে দিয়ে তাকে যাদবপুরের টিবি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। কারণ, তিনি স্থির প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, এই ধরনের কাশি টিবি রোগের অন্যতম লক্ষ্মণ।

আর সত্যিই, কফ্ থুতু পরিক্ষায় সেই ঝাড়ুদারের টিবি রোগই সনাক্ত হয়েছিলো। পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর শরীর খুব খারাপ। ডাক্তার রায়কে ডেকে পাঠালেন তারই সুযোগ্যা তনয়া শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।

দিল্লিতে পৌঁছে নেহেরুর অবস্থা দেখে বিচলিত ডাক্তার রায় নেহেরুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার সেনকে খুব ধমকে দিলেন। বললেন গরম জল ও সাবান আনতে। এরপরে নেহেরুজীকে পাজামা খুলতে বলতেই নেহেরু লজ্জিত হয়ে ধমকে উঠলেন ডাক্তার রায়কে।

কিন্তু ডাক্তার রায় বললেন-এখন আমি ডাক্তার, আর তুমি রোগী। এরপরেই ডুশ দিয়ে নেহেরুর পেট পরিষ্কার করে দিতেই পন্ডিত নেহেরু সুস্থ বোধ করতে লাগলেন। সমগ্র বিষয়টিই নিজের হাতে সম্পাদন করেছিলেন ডাক্তার রায়।

বর্তমানকালের কোভিড মহামারির অন্যতম লক্ষ্মণ কাশি, যা শুনলে চিকিৎসক অবশ্যই আরটিপিসিআর কিম্বা অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে বলবেন এবং যা সত্যিই এই সময়কালে এক উদ্দেকজনক ও ব্যায়বহুল বিষয়ও বটে! শুরুতে বাঙালির যে উত্তরসুরী দিয়ে এই আলোচনা প্রারম্ভলাভ করেছিলো, কোথায় যেনো সেই ঢেউ এক ধাক্কায় আজকের বাংলার পটভূমিতে ভাঙন ধরালো।

সংস্কৃতিচেতনার এক অনন্য আকর বিধান রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একে একে লবনহৃদ, কল্যাণী, অশোকনগর, হাবরা প্রভৃতি নগরী। দেশভাগের সময় ওপার বাংলার শরনার্থীদের এপারে বাসস্থান ও পুর্নবাসনের জন্য সেদিনের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়-এর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিলো তৎকালিন কলোনিয়াল সোসাইটি তৈরির মধ্য দিয়ে।

ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়-এর রোগীর তালিকায় বিখ্যাতদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাস, জহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধী, বল্লভভাই প্যাটেল এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিও ছিলেন।

ডাক্তার রায়-এর ব্যাক্তিগত জীবনে প্রেম ছিলো নীরব, যা কল্যাণময়ী নারীর মতো। তাই তো তার নিজের হাতে গড়া বর্তমান স্মার্ট নগরী কল্পনার কল্যাণী শহর, সল্টলেক আজ বিশ্ব সমাদৃত। যদিও চিরকুমার ডাক্তার রায়-এর প্রেমিকা কল্যাণী নামের একটি মেয়ের সম্পর্কে জীবনীকার কে পি টমাস বলেছেন, এবিষয়ে তার কোনোদিনই বিধান রায়-এর সাথে কোনো কথা হয়নি।

একদিকে মুখ্যমন্ত্রীত্ব, অপরদিকে ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে ব্রম্মস্তোত্র ও গীতাপাঠ করে ১৬ জন রোগীকে নিঃখরচায় দেখে, সারা দেশের বিশেষ বিশেষ মহান নাগরিকেরা, যে যেখানেই অসুস্থ হয়েছেন, চিকিৎসা দিতে ছুটে গিয়েছেন বিধান রায়। মহাত্মা গান্ধীকে তিনি যে কতবার চিকিৎসা করেছেন, সেইসব ঘটনাবলী লিখতে বসলে আস্ত একটি বই হয়ে যাওয়া সম্ভব।

ডাক্তার রায়-এর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণার একটি গল্প রয়েছে। এক ইন্সিওরেন্স কোম্পানির মিটিংয়ে তিনি কৌতুক করে বলেছিলেন, এক রোগী একটি ছুরি গিলে ফেলেছেন। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ তাকে ওষুধের একটি মাত্রা দিলেন। ওমনি পেটের ছুরির ধার ভোতা হয়ে গেলো। ২য় ডোজে ছুরিটির ফলাটা কাঠের হাতলের ভাজে ঢুকে গেলো। সর্বশেষ ডোজে ছুরিটি রোগীর গলা দিয়ে সরসর করে বেরিয়ে গেলো রোগীর কোনো ক্ষতি না করে।

নিজের পেশার ডাক্তারদের নিয়েও তার সরেস রসিকতার নানা প্রমাণ আছে। একবার হাইদ্রাবাদের এক সভায় তিনি ভাষণ শেষ করেছিলেন এই গল্পটি বলে।

লন্ডনের উপকন্ঠে একদল গুন্ডা পিস্তল দেখিয়ে একটি বাস থামিয়ে প্যাসেঞ্জারদের সকলের কাছ থেকে টাকাকড়ি ছিনতাই করে অবশেষে শেষ যাত্রী এক বৃদ্ধের কাছে আসতেই, বৃদ্ধ বললেন-আমি পেশায় একজন চিকিৎসক। আমরা টাকা ও জীবন-দুই-ই নিয়ে থাকি।

এ হেনো স্বনামধন্য চিকিৎসক সম্পর্কে নানা কথার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিলো তার নিজের চিকিৎসা। এই বিষয়েই ডাক্তার রায়কে তারই সহকর্মী নলিনীরঞ্জন সরকার প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো সকলের চিকিৎসা করেন। তো, আপনার চিকিৎসা কে করেন? শুনে ডাক্তার বিধান রায় ওমনি একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে নিজের প্রতিকৃতিকে দেখিয়ে বলেছিলেন- কেনো, ডাক্তার বি সি রায়!

কোভিডে মানুষ পোকামাকড়ের মতো মারা যাচ্ছে। যারা জীবিত, তারাও মনোরোগে মৃত প্রায়। আর এই রোগ আজ রাজ দরবার থেকে আঙিনায়। বিধান রায় বেঁচে থাকলে হয়তো তার রসিকতার কথোপকথনে মৃতপ্রায় মানুষের মনের ব্যাধিতে প্রলেপ পড়তো। কিন্তু মানুষই মরনশীল। তাই এহেনো চিকিৎসককেও বিধির নোটিশে চলে যেতে হয়েছিলো।

তবে যাওয়াটাও ছিলো আশ্চর্যের জন্মদিনেই যাওয়া। আগেই সহায়ককে বলে রেখেছিলেন, অন্তিম ইচ্ছের কথা। যথারীতি, সকালের স্নান, পূজাপাঠ ও ফলের রস গ্রহণ। আর ১লা জুলাই-এর ১৯৬২-তে অল ইন্ডিয়া রেডিও ঘোষণা করলো, ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় বেলা এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে পরপারে চলে গেলেন।

কোভিডএর মতো মহামারি হয়তো শতাব্দীতে একবার আসে। আবার চলেও যায়। কিন্তু মারণরোগ ও তার নিরাময়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসকেরা ও চিকিৎসা-বিজ্ঞান থেকে যায় মানুষের মননে, যেমন রয়ে গেছেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।