ঢাকা ০৭:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘একাত্তোরের ক্যানভাসে’ বিধবা দিলমনির সঙ্গে ভিন্ন এক বর্ষবরণ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৩:৫৮:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ অগাস্ট ২০২০ ৫৩২ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ইয়াদিয়া জামান

রমনার বটমূলে বাংলানববর্ষে জমজমাট আয়োজন। বাঙালি তার স্বকীয়তা ভাস্বর জীবনভর। পুব আকাশে নবর্ষের হলুদাভাব সূর্যের নবকিরণে পৃথিবী ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে ওঠছে। কিন্তু ইটপাথরের রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের সকাল হয়েছে সূর্য ওঠার আগেই। আজ যে বাঙলা নববর্ষকে বরন করে নেবার দিন। তাই নানা সাজে নিজেকে রাঙিয়ে হাজারো মানুষের মিছিল। তাদের গন্তব্য ঐতিহাসিক রমনার বটমূল। মানুষের স্রোত যখন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঘিরে তখন আমার গন্তব্য শেরপুর। পথে বেশ কয়েকটি জায়গায় আনুষ্ঠানিকতার কারণে থামতে হবে। কিন্তু আমার দেহ যেন সোহাগপুর চলে গেছে। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে একটি অংশ ছিল। সাধারণ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তাবায়িত করতে ভোট দেয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরই শুরু হয় বিচারকার্য। এক পর্যায়ে এসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। একে একে ফাঁসি কার্যকর হয় যুদ্ধাপরাধীদের। তাদের একজন জামায়াত নেতা ও যুদ্ধকালীন সোহাগপুর এলাকাকে বিধবা পল্লী বানানোর অন্যতম কারিগর। সেই সোহাগপুর আমায় অনেক দিন থেকেই টানছিল। অবশেষে নববর্ষের দিন সেখানে যাব সেই সুযোগ হাতছাড়া করাটা বোকামি।

সকালের স্নিগদ্ধ আলোবাতাসে উদাসী মন। গাড়ি ছুটেছে শ’ কিলোমিটার গতিতে। আমায় যেতে হচ্ছে রাজধানী থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার উত্তরে। যার অবস্থান মেঘালয়ের পাঁজরের নীচে। প্রচন্ডভাবে টানছে সোহাগপুর। মনের অজান্তে হারিয়ে গেলাম ভাবনার জগতে। রাস্তার দু’পাশে গ্রামীণজনপদ। সোঁদামাটির গন্ধ। আহা, এটাইতো মেলে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে-আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। এমনটি ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিশাল ক্যানভাস। চারিদিকে নারীপুরুষের ছুটে চলা। কোথাও কোথাও জ¦লছে দাউ দাউ আগুন। দূরে কোথাও চোখে পড়ছে, কুন্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ওঠে কালো ধোঁয়া। মনে খুব কাছে থেকেই আসছে গুলির শব্দ, আর্তচিৎকার। নারী কণ্ঠের গোঙালির শব্দ। কিছুক্ষণ পর কয়েকটি গুলির শব্দ। সব কিছু স্তব্ধ। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। কিছুক্ষণ পরই ফের গুলির শব্দ। মানুষের ছটে চলে। স্বপ্নে সাজানো সংসারে জ¦লে পুড়ে ছাই হলে রক্ষায় এগিয়ে আসার কোন হাত মিলছে না। সবাই নিজেকে রক্ষায় ছুটে পালাচ্ছে। অনেকে সীমান্ত পারি দিয়ে মেঘালয়ে ঢুকে গেছে। গাছ তলা বসেও দীর্ঘ নিঃশ^াস ছেড়ে নিজেকে শান্তনা দেয় ‘যাক জানডারে নিয়াতো বাইচা আইতে পারছি’। বেচে থাকলে এবং দেশ স্বাধীন হলে সবই অইব। মাটির বুক চিরে ফসল ফলিয়ে যারা আমাদের আহার যোগায় সেই কৃষক দেবতার কথা ভাবতে ভাবতেই এক সময় সম্বিত ফিরে পাই। ফের ডুব দেই সোগাহপুরের ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশের সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একটি দৈনিকে লিখেছিলেন, তখন শ্রাবণ মাস। নিভৃত গ্রাম সোহাগপুরে আশপাশের অঞ্চল থেকে অনেকেই ধানকাটার কাজ করতে এসেছেন। সকাল থেকেই তারা মাঠে ধান কাঠছিলেন। ঠিক তখনই রাজাকার-আলবদর বাহিনীকে নিয়ে হামলে পড়ে পাকসেনারা। নির্বিচারে গুলি চালায়। তাতে ১৮৭জন শহীন হন। তাদের মরদেহ পড়েছিলো কয়েক দিন। পরে সুযোগ বুঝে এলাকার তাদের মাটি চাপা দেয়। সেটি এখন বদ্ধভূমি। আর ভাবা যাচ্ছে না। যতই ভাবছি, ততই নারকীয় সব ঘটনা ভেসে ওঠছে ‘একাত্তোরের ক্যানভাসে’।

এবারে ম্যাপটা খুলে ধরতেই আমার গন্তব্য সোহাগপুরের অবস্থান দেখতে পেলাম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মেঘালয়ের কোলঘেঁষে। এটা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়। ছোট্ট এই গ্রামটিতে কয়েক হাজার লোকের বসবাস। অধিকাংশই কৃষক। সংবাদমাধ্যম থেকে যতদূর জেনেছি তাহলো সোহাগপুর গ্রামের অধিকাংশ নারী বিধবা হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। কিছু সংখ্যক পুরুষ নিজের জীবন নিয়ে পালানো সম্ভব হলেও অধিকাংশ মানুষকে আটকা পরে। মাবোনদের বেলায়তো কথাই নেই। আর তাদেরই মহাসম্পদের মতো লুট করে পাক হায়ানার দল! হায়নাদের অন্যতম সহযোগী ছিলো জামায়াত ও শান্তিবাহিনীর কুখ্যাত দালাল কামারুজ্জামান। যাত্রাপথে আমার সঙ্গে যুক্ত হলেন শেরপুর জেলার জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান শামসুন্নাহার আপা ও তার সঙ্গী কয়েকজন। ছোট ছোট যাত্রা বিরতি। কিন্তু আমার সকল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল সোহাগপুর। যাত্রাপথে শামসুন্নাহার আপার জানালেন আরও অনেক তথ্য। r

সোহাগপুর!

শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নে সোহাগপুর গ্রাম। শান্ত এই গ্রামটিতে বাস করতেন নিরিহ সাধারণ মানুষ। সেই নিভৃত গ্রামবাসী ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই (তথ্য বাংলা পিডিয়া) ভয়ংকর বিভীষিকার মুখমুখি হন। বজ্রপাতের মতোই পাক হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তারপর প্রায় ঘন্টা আটেক ধরে চালানো হয়, নির্মম হত্যাযজ্ঞ। নির্বিচারে গুলি-বেয়নট চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৮৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। বিধবা হন গ্রামের ৬২ জন নারী। এরপর অনেক মা-বোনের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। কামারুজ্জামানের মতো বাঙালি রাজাকার-আলবরদের সহায়তা এবং দেখানো পথে হানাদার পাকিস্তানী সেনারা সোগাপুর’কে বিরানভূমিতে পরিণত করে! সেই সোহাগপুরের মাটিতে পা রেখে চারিদিকটা দেখে নিলাম। ৭১’র সোহাগপুর এখন আর নেই। সময়ের পিঠ বেয়ে এসেছে অনেক পরিবর্তন। সোহাগপুর আজ ইতিহাসের অংশ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। স্থানীয় জামায়াতের আমির ও প্রভাবশালী নেতা কামারুজ্জামান যুদ্ধ অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয় এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে তার ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। এই আদেশের কয়েকদিন পরেই আমার সোহাগপুর গ্রামে যাওয়ার সুযোগ আসলে আমি লুফে নেই। সোহাগপুর গ্রামে যখন পৌঁছি তখন দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছে। এলাকাবাসী আমাদের আগমন উপলক্ষে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করে রেখেছিলেন, মাছ ভাজা, আলু ভর্তার সঙ্গে বাঙালির ডাল ভাত। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই অভ্যর্থনাকারীরা তাগাদা দিলেন প্রথমে খেয়ে নিন। দুপুরের খাবার শেষে শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা। যার মধ্যে ছিল বঞ্চনার কথা, একইসঙ্গে আশাবাদ ও স্বপ্ন বোনার চেষ্টা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই দিলমনির পরিচয় পেয়ে আমি আর তাকে হাতছাড়া করিনি।

বিধবা দিলমনি সঙ্গে বর্ষবরণ

তার সামনে একাত্তোরের কথা কেউ উচ্চারণ করলেই কেমন জানি হয়ে ওঠেন দিলমনি বেওয়া। কেন, কি হয়েছে তার ? একাত্তোর তো স্বাধীনতা এনেদিয়েছে। এইতো ২০২১ সালেই আমরা পালন করতে যাচ্ছি স্বাধীনতা রজতজয়ন্তী। তা হলে দিলমনি বেওয়া কেন এই বয়সেও নড়েচড়ে বসেন? তবে হ্যা, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের কথা যেদিন শুনতে পেয়েছিলেন দিলমনিরা, সেদিন তার পাথরচাপা বুকটা অনেকটা হাল্কা হয়ে যযায়। এখন বুক ভরে নিঃশ^াস নিতে কষ্ট হয় দিলমনির। সেই দিলমনির সঙ্গে একটি বাংলানববর্ষ কাটানো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়ানা। এমন দিলমনি বেওয়াদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজকের লাল-সবুজে খচিত পতাকা বিশ^ দরবারে পতপত করে উড়ছে। বঙ্গবন্ধুর হাত যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। পরবর্তীতে তাঁই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে পেয়েছি এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

সালাম বীরকন্যা’

বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় জাতির দিনবদল হয়েছে। নালিতা বাড়ির সোহাগপুর বিধবা পল্লীর নাম পাল্টিয়ে নামকরণ করা হয় ‘বীরকন্য’। প্রাথমিক পর্যায়ে ১২ জনকে সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারা হচ্ছেন, সালমা বেওয়া, হাফিজা বেওয়া, জাবেদা বেওয়া, আছিরন বেওয়া, জবেদা-২ বেওয়া, হাসেন বানু, মহিরন বেওয়া, আছিরন নেছা, জরিতন বেওয়া, হাসনে আরা, হাজেরা বেগম-১, এবং হাজেরা বেগম-২। কৃতজ্ঞ জাতি মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে বদ্ধপরিকর। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সুযোগ সুবিধা অনেক গুণে বাড়িয়েছে। সোহাগপুরের সে বিধবা পল্লীকে “বীর কন্যা” পল্লী নামকরণের পর সাড়ে ৯লাখ টাকা করে মোট ৩০টি আধাপাকা ঘর করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী কামরুজ্জামান যতবার জন্মায় তার চাইতেও অসংখ্যবার জন্মায় মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হাসানরা। সোহাগপুর বিধবা পল্লীর বর্তমান নাম বীরকন্যা, বীরের এই বঙ্গভূমিতে যথার্থ নাম বীরকন্যা। দিলমনিরা আমাদের ইতিহাসের উজ্জ্বল তারকা হয়ে থাকবেন। সেই প্রত্যাশা ধারণ করে ঢাকার পথে পা বাড়ালাম। দিলমনি বেওয়ার সাথে কাটানো সময় গুলো আমার জীবনের অন্যতম অর্জন।

সূত্র : বাংলা পিডিয়া, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সোহাগপুর বিধবাপল্লী এবং ক্যাপ্টেন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম লেখা।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

‘একাত্তোরের ক্যানভাসে’ বিধবা দিলমনির সঙ্গে ভিন্ন এক বর্ষবরণ

আপডেট সময় : ০৩:৫৮:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ অগাস্ট ২০২০

ইয়াদিয়া জামান

রমনার বটমূলে বাংলানববর্ষে জমজমাট আয়োজন। বাঙালি তার স্বকীয়তা ভাস্বর জীবনভর। পুব আকাশে নবর্ষের হলুদাভাব সূর্যের নবকিরণে পৃথিবী ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে ওঠছে। কিন্তু ইটপাথরের রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের সকাল হয়েছে সূর্য ওঠার আগেই। আজ যে বাঙলা নববর্ষকে বরন করে নেবার দিন। তাই নানা সাজে নিজেকে রাঙিয়ে হাজারো মানুষের মিছিল। তাদের গন্তব্য ঐতিহাসিক রমনার বটমূল। মানুষের স্রোত যখন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঘিরে তখন আমার গন্তব্য শেরপুর। পথে বেশ কয়েকটি জায়গায় আনুষ্ঠানিকতার কারণে থামতে হবে। কিন্তু আমার দেহ যেন সোহাগপুর চলে গেছে। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে একটি অংশ ছিল। সাধারণ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তাবায়িত করতে ভোট দেয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরই শুরু হয় বিচারকার্য। এক পর্যায়ে এসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। একে একে ফাঁসি কার্যকর হয় যুদ্ধাপরাধীদের। তাদের একজন জামায়াত নেতা ও যুদ্ধকালীন সোহাগপুর এলাকাকে বিধবা পল্লী বানানোর অন্যতম কারিগর। সেই সোহাগপুর আমায় অনেক দিন থেকেই টানছিল। অবশেষে নববর্ষের দিন সেখানে যাব সেই সুযোগ হাতছাড়া করাটা বোকামি।

সকালের স্নিগদ্ধ আলোবাতাসে উদাসী মন। গাড়ি ছুটেছে শ’ কিলোমিটার গতিতে। আমায় যেতে হচ্ছে রাজধানী থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার উত্তরে। যার অবস্থান মেঘালয়ের পাঁজরের নীচে। প্রচন্ডভাবে টানছে সোহাগপুর। মনের অজান্তে হারিয়ে গেলাম ভাবনার জগতে। রাস্তার দু’পাশে গ্রামীণজনপদ। সোঁদামাটির গন্ধ। আহা, এটাইতো মেলে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে-আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। এমনটি ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিশাল ক্যানভাস। চারিদিকে নারীপুরুষের ছুটে চলা। কোথাও কোথাও জ¦লছে দাউ দাউ আগুন। দূরে কোথাও চোখে পড়ছে, কুন্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ওঠে কালো ধোঁয়া। মনে খুব কাছে থেকেই আসছে গুলির শব্দ, আর্তচিৎকার। নারী কণ্ঠের গোঙালির শব্দ। কিছুক্ষণ পর কয়েকটি গুলির শব্দ। সব কিছু স্তব্ধ। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। কিছুক্ষণ পরই ফের গুলির শব্দ। মানুষের ছটে চলে। স্বপ্নে সাজানো সংসারে জ¦লে পুড়ে ছাই হলে রক্ষায় এগিয়ে আসার কোন হাত মিলছে না। সবাই নিজেকে রক্ষায় ছুটে পালাচ্ছে। অনেকে সীমান্ত পারি দিয়ে মেঘালয়ে ঢুকে গেছে। গাছ তলা বসেও দীর্ঘ নিঃশ^াস ছেড়ে নিজেকে শান্তনা দেয় ‘যাক জানডারে নিয়াতো বাইচা আইতে পারছি’। বেচে থাকলে এবং দেশ স্বাধীন হলে সবই অইব। মাটির বুক চিরে ফসল ফলিয়ে যারা আমাদের আহার যোগায় সেই কৃষক দেবতার কথা ভাবতে ভাবতেই এক সময় সম্বিত ফিরে পাই। ফের ডুব দেই সোগাহপুরের ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশের সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একটি দৈনিকে লিখেছিলেন, তখন শ্রাবণ মাস। নিভৃত গ্রাম সোহাগপুরে আশপাশের অঞ্চল থেকে অনেকেই ধানকাটার কাজ করতে এসেছেন। সকাল থেকেই তারা মাঠে ধান কাঠছিলেন। ঠিক তখনই রাজাকার-আলবদর বাহিনীকে নিয়ে হামলে পড়ে পাকসেনারা। নির্বিচারে গুলি চালায়। তাতে ১৮৭জন শহীন হন। তাদের মরদেহ পড়েছিলো কয়েক দিন। পরে সুযোগ বুঝে এলাকার তাদের মাটি চাপা দেয়। সেটি এখন বদ্ধভূমি। আর ভাবা যাচ্ছে না। যতই ভাবছি, ততই নারকীয় সব ঘটনা ভেসে ওঠছে ‘একাত্তোরের ক্যানভাসে’।

এবারে ম্যাপটা খুলে ধরতেই আমার গন্তব্য সোহাগপুরের অবস্থান দেখতে পেলাম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মেঘালয়ের কোলঘেঁষে। এটা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়। ছোট্ট এই গ্রামটিতে কয়েক হাজার লোকের বসবাস। অধিকাংশই কৃষক। সংবাদমাধ্যম থেকে যতদূর জেনেছি তাহলো সোহাগপুর গ্রামের অধিকাংশ নারী বিধবা হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। কিছু সংখ্যক পুরুষ নিজের জীবন নিয়ে পালানো সম্ভব হলেও অধিকাংশ মানুষকে আটকা পরে। মাবোনদের বেলায়তো কথাই নেই। আর তাদেরই মহাসম্পদের মতো লুট করে পাক হায়ানার দল! হায়নাদের অন্যতম সহযোগী ছিলো জামায়াত ও শান্তিবাহিনীর কুখ্যাত দালাল কামারুজ্জামান। যাত্রাপথে আমার সঙ্গে যুক্ত হলেন শেরপুর জেলার জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান শামসুন্নাহার আপা ও তার সঙ্গী কয়েকজন। ছোট ছোট যাত্রা বিরতি। কিন্তু আমার সকল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল সোহাগপুর। যাত্রাপথে শামসুন্নাহার আপার জানালেন আরও অনেক তথ্য। r

সোহাগপুর!

শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নে সোহাগপুর গ্রাম। শান্ত এই গ্রামটিতে বাস করতেন নিরিহ সাধারণ মানুষ। সেই নিভৃত গ্রামবাসী ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই (তথ্য বাংলা পিডিয়া) ভয়ংকর বিভীষিকার মুখমুখি হন। বজ্রপাতের মতোই পাক হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তারপর প্রায় ঘন্টা আটেক ধরে চালানো হয়, নির্মম হত্যাযজ্ঞ। নির্বিচারে গুলি-বেয়নট চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৮৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। বিধবা হন গ্রামের ৬২ জন নারী। এরপর অনেক মা-বোনের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। কামারুজ্জামানের মতো বাঙালি রাজাকার-আলবরদের সহায়তা এবং দেখানো পথে হানাদার পাকিস্তানী সেনারা সোগাপুর’কে বিরানভূমিতে পরিণত করে! সেই সোহাগপুরের মাটিতে পা রেখে চারিদিকটা দেখে নিলাম। ৭১’র সোহাগপুর এখন আর নেই। সময়ের পিঠ বেয়ে এসেছে অনেক পরিবর্তন। সোহাগপুর আজ ইতিহাসের অংশ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। স্থানীয় জামায়াতের আমির ও প্রভাবশালী নেতা কামারুজ্জামান যুদ্ধ অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয় এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে তার ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। এই আদেশের কয়েকদিন পরেই আমার সোহাগপুর গ্রামে যাওয়ার সুযোগ আসলে আমি লুফে নেই। সোহাগপুর গ্রামে যখন পৌঁছি তখন দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছে। এলাকাবাসী আমাদের আগমন উপলক্ষে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করে রেখেছিলেন, মাছ ভাজা, আলু ভর্তার সঙ্গে বাঙালির ডাল ভাত। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই অভ্যর্থনাকারীরা তাগাদা দিলেন প্রথমে খেয়ে নিন। দুপুরের খাবার শেষে শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা। যার মধ্যে ছিল বঞ্চনার কথা, একইসঙ্গে আশাবাদ ও স্বপ্ন বোনার চেষ্টা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই দিলমনির পরিচয় পেয়ে আমি আর তাকে হাতছাড়া করিনি।

বিধবা দিলমনি সঙ্গে বর্ষবরণ

তার সামনে একাত্তোরের কথা কেউ উচ্চারণ করলেই কেমন জানি হয়ে ওঠেন দিলমনি বেওয়া। কেন, কি হয়েছে তার ? একাত্তোর তো স্বাধীনতা এনেদিয়েছে। এইতো ২০২১ সালেই আমরা পালন করতে যাচ্ছি স্বাধীনতা রজতজয়ন্তী। তা হলে দিলমনি বেওয়া কেন এই বয়সেও নড়েচড়ে বসেন? তবে হ্যা, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের কথা যেদিন শুনতে পেয়েছিলেন দিলমনিরা, সেদিন তার পাথরচাপা বুকটা অনেকটা হাল্কা হয়ে যযায়। এখন বুক ভরে নিঃশ^াস নিতে কষ্ট হয় দিলমনির। সেই দিলমনির সঙ্গে একটি বাংলানববর্ষ কাটানো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়ানা। এমন দিলমনি বেওয়াদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজকের লাল-সবুজে খচিত পতাকা বিশ^ দরবারে পতপত করে উড়ছে। বঙ্গবন্ধুর হাত যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। পরবর্তীতে তাঁই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে পেয়েছি এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

সালাম বীরকন্যা’

বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় জাতির দিনবদল হয়েছে। নালিতা বাড়ির সোহাগপুর বিধবা পল্লীর নাম পাল্টিয়ে নামকরণ করা হয় ‘বীরকন্য’। প্রাথমিক পর্যায়ে ১২ জনকে সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারা হচ্ছেন, সালমা বেওয়া, হাফিজা বেওয়া, জাবেদা বেওয়া, আছিরন বেওয়া, জবেদা-২ বেওয়া, হাসেন বানু, মহিরন বেওয়া, আছিরন নেছা, জরিতন বেওয়া, হাসনে আরা, হাজেরা বেগম-১, এবং হাজেরা বেগম-২। কৃতজ্ঞ জাতি মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে বদ্ধপরিকর। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সুযোগ সুবিধা অনেক গুণে বাড়িয়েছে। সোহাগপুরের সে বিধবা পল্লীকে “বীর কন্যা” পল্লী নামকরণের পর সাড়ে ৯লাখ টাকা করে মোট ৩০টি আধাপাকা ঘর করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী কামরুজ্জামান যতবার জন্মায় তার চাইতেও অসংখ্যবার জন্মায় মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হাসানরা। সোহাগপুর বিধবা পল্লীর বর্তমান নাম বীরকন্যা, বীরের এই বঙ্গভূমিতে যথার্থ নাম বীরকন্যা। দিলমনিরা আমাদের ইতিহাসের উজ্জ্বল তারকা হয়ে থাকবেন। সেই প্রত্যাশা ধারণ করে ঢাকার পথে পা বাড়ালাম। দিলমনি বেওয়ার সাথে কাটানো সময় গুলো আমার জীবনের অন্যতম অর্জন।

সূত্র : বাংলা পিডিয়া, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সোহাগপুর বিধবাপল্লী এবং ক্যাপ্টেন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম লেখা।