একজন সুদেষ্ণার সঙ্গীত ও সমাজ সেবার গল্প

- আপডেট সময় : ০৭:২৭:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩ ২৮৩ বার পড়া হয়েছে

অনিরুদ্ধ
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। গবেষকদের মতে, সাঁওতাল উপজাতি প্রোটো-অস্ট্রোলয়েডের জাতিগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই বংশের লোকদের পূর্বপুরুষরা প্রায় দশ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে পাড়ি জমান।
সাঁওতালদের ত্বকের রং এবং চুল কালো, তাদের ঠোঁট বড় ও মোটা, বিস্তৃত নাক এবং তাদের উচ্চতা মাঝারি ধরনের। চলনে বলনে সহজ-সরল। তাদের হাতের কাজ নিপূন। রঙিন বস্ত্রের প্রতি তাদের দুর্বলতা।
এই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর তৈরি নানা ধরণের নান্দনিক ডিজাইনের পোষাক বাজারজাত করে আর্থসামাজিকভাবে জীবনমানের উন্নয়নে হাত বাড়িয়েছেন তিনি। সময় পেলেই তাদের কাছে ছুটে যান, একসঙ্গে গল্প-গান ও হৈ চৈ করে সময় পার করেন। এই সানিধ্যটুকু পিছিয়ে পড়া আদিজনগোষ্ঠীর প্রাণের স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, এটাই তাদের বিশাল পাওনা।ৎ

একারণেই তাদের হৃদমণ্ডিরে স্থান করে নিয়েছেন সুদেষ্ণা তথা প্রতিথযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও সমাজ চিন্তক সুদেষ্ণা স্যানাল রুদ্র।
শুধু যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রচেষ্টায় কাজ করছেন তা নয়। আমাদের সমাজে যারা অবহেলিত, আপনজন যাদের বাড়িঘরে চৌকাঠের বাইরে বের করে দিয়ে নিজেদের মুক্ত ভাবছেন, সেই বৃহন্নলাদের চলার পথে আলো ছড়িয়ে দিতেও কাজ করছেন এই রবীপ্রেমী।

উদাস দৃষ্টি মেলে মোলায়েম অথচ নিচু গলায় বলেন, একটিবার চিন্তা করো এই মানুষগুলোর কথা। সবার আগে এরা মানুষ, তারপর অন্য কিছু। আমার ভাবনার বাইরে তাদের রাখতে পারি না।
বৃহন্নলাদের নিয়েও কাজ করে চলেছেন সুদেষ্ণা। সমাজের এই অবহেলিত মানুষগুলোর জন্য তার সাধ্যানুযায়ী হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এই শিল্পী
শিল্পী জানালেন, জানো সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। অথচ তারা অবহেলিত। তাদের তৈরি পোষাক বাজারজাত করে বিশেষ করে সাঁওতাল নারীদের যতটুকু সম্ভব সামলম্বি করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
রবিচ্ছায়ার পরিচিত মুখ হয়ে ওঠার গল্পটা কি?
চমৎকার। এই রবীচ্ছায়ার রোপণটা যাঁর হাতে তিনি বুদ্ধদেব রুদ্র মোহাশয়। ছিলেন শান্তিনিকেতনে। আগাগোড়া সাংস্কৃতির পূজারী। তাঁর চিন্ত-ভাবনা চেতনায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রবিচ্ছায়ার একজন হয়ে কাজ করছি। মূলত কাজ করছি বললে ভুল হবে, এটা আমার দায়িত্ব।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর তৈরি নানা ডিজাইনের পোষাকের কালেকশান রয়েছে শিল্পীর । তিনি তা বাজারজাত করে সাঁওতালদের সাবলম্বি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কারণ?
বুদ্ধদেব রুদ্র মোহাশয় আমার শ্বশুর। অতএব আমাকেই তাঁর আর্শিবাদের তৈরীটি বাইতে হবে।
সুদেষ্ণা শান্তিনিকেতনের আশ্রম কন্যা। মূলত নাচে ডুবে গেলেও রবীন্দ্র সুরের জালে বন্দী হয়েছেন রবীন্দ্র প্রেম থেকেই। গান শিখেছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। নাচ এবং গান এই দুয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন সুদেষ্ণা। অবশেষে মাথা তুলে দাড়ালেন। সংস্কৃতির সেবায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেছে শিল্পী।
সুদেষ্ণা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাসিন্দা। নিজেদের এবং শ্বশুরবাড়িতে সাংস্কৃতিক ”র্চ্চা মধ্যেই জীবন এগিয়ে চলছে। তার স্বামী বিশ্বরূপ রুদ্র একজন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও উপস্থাপক। তারা টিভির ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ অনুষ্ঠানে একটা লম্বা সময় ধরে উপস্থাপনা করেছেন।
রুদ-সুদেষ্ণার একমাত্র সন্তান তটিনী মাঝে মাঝেই নাচ আর সুরের স্রোতস্বীনিতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়।
সঙ্গীত এবং সমাজ সেবা এই দুয়ে এগিয়ে চলেছেন সুদেষ্ণা। সমাজের পিছিয়ে মানুষের জন্য কিছু করার আগ্রহটা তাকে সামনে এগিয়ে যাবার শক্তি যোগায়। তিনি সমাজের অবহেলিত মানুষের জীবনে আলো ছড়াতে চান। তার এই মহৎ কাজের জন্যই তিনি আমাদের সমাজের শুভবোধের সারথী।
ঢাকায় তার আগমণ ঘটে নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষে। বিশেষ রবীন্দ্র জন্মোৎসব ঘিরে জাতীয় রবীন্দসংগীত শিল্পী সংস্থার আমন্ত্রণে বার কুড়িতো ঢাকায় এসে অনুষ্ঠান করা হয়ে গেছে। এখানের মানুষগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সুদেষ্ণা। সংস্থার সভাপতি তপন মাহমুদের আমন্ত্রণে এবারের দু’দিনের জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত উৎসবে অংশ নিতে ঢাকায় আসা।
ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে দুদিনের উৎসব ছিল প্রাণবন্ত।
এবারে নতুন এক বিষয়ে জানান দিল সুদেষ্ণা। তার ভাষায়, বৈদিক সাহিত্য থেকে মন্ত্র আহরণ করে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ঐহিক ক্রিয়া কর্মের যে রীতি বহু সহস্র বছর ধরে প্রচলিত ছিল, তাকে পুনরুজ্জীবন দেবার প্রচেষ্টার কেন্দ্র যেটি শুভমস্তু নামে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পেয়েছে।আমি তার সাথে সৌভাগ্য বশত যুক্ত হতে পেরেছি। এই উদ্যোগটির প্রাণ কেন্দ্র হলো আমাদের ডক্টর নন্দিনী ভৌমিক।
শুভমস্তুর তরফে বিবাহ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মহিলা পুরোহিতদের দিয়ে যে শুভ কাজ সম্পন্ন করা হয় এবং বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করা হয় সে এক অভিনব প্রয়াস । কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি বর এবং কনে পক্ষের দুই পরিবার ই অবাঙালি। তারা শুভমস্তুকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছেন।
এই ক্ষেত্রে যে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়ে থাকে তা কখনো হিন্দী, কখনো ইংরেজি এবং কখনো বাংলাতেও পাঠ করা হয়। সর্ব ক্ষেত্রেই আমরা অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছি। এছাড়াও শুভমস্তু অন্নপ্রাশন, গৃহ প্রবেশ, দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, কালি পূজা, লক্ষ্মী পূজা, পরলৌকিক ইত্যাদি সব ধরনের অনুষ্ঠানই খুব নিষ্ঠার সাথে সুসম্পন্ন করে থাকে।