আয়োডিনের ঘাটতি জনিত থায়রয়েডের সমস্যা

- আপডেট সময় : ০৩:১৪:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৪ ২৮৪ বার পড়া হয়েছে
সারা বিশ্বেই খাবারের মধ্যে আয়োডিনের সবচেয়ে বেশি উৎস সাদা মাছ এবং ডিম। খাবারের লবণেও আয়োডিন যুক্ত থাকে। অনেক দেশে মানুষ দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার থেকে সরাসরি আয়োডিন পেয়ে থাকে, কিন্তু শিল্পোন্নত দেশেও অনেক মানুষের মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা যায়।
ডা. শাহজাদা সেলিম
আয়োডিন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে সহায়তা করে। আমাদের শরীর নিজে আয়োডিন তৈরি করতে পারেনা। তাই আমাদেরকে খাবারের সাথে বাইরে থেকে এটা গ্রহন করতে হয়।
আয়োডিনেরউৎস
বেশির ভাগ আয়োডিন আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য ও পানীয় থেকে পাই। সাধারণত সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। তাই সামুদ্রিক উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার, যেমন সমুদ্রের মাছ, আয়োডিন সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। কিছু শাকসব্জিতে, যেমন পালংশাক,বীট আলু, টমেটো ও মরিচে ভাল মাত্রায় আয়োডিন থাকে যদি সেগুলো আয়োডিন সমৃদ্ধ মাটিতে জন্মে। আবার কিছু সব্জি আছে (যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম) যেগুলো শরীরে আয়োডিন শোষণে বাধা দেয়। ফলে, এসব সব্জি বেশি খেলে শরীরে আয়োডিনের মাত্রা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বাদু পানিতে আয়োডিন খুব বেশি থাকেনা। তাই স্বাদু পানির মাছেও আয়োডিন খুব বেশি থাকেনা।
আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা
আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আয়োডিন প্রয়োজন। থাইরয়েড হরমোনের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো আয়োডিন। থাইরোয়েড হরমোন আমাদের শরীরে বিপাক সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। থাইরোয়েড হরমোন প্রধানত মস্তিষ্ক, মাংসপেশী, হৃৎপিন্ড, বৃক্ক, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সমূহের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে অপরিহার্য।

আয়োডিনের ঘাটতি জনিত থায়রয়েডের সমস্যা
যখনআমাদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দেয় তখন প্রয়োজনীয় থাইরোয়েড হরমোন উৎপন্ন হয় না ত্রবং আমরা আয়োডিনের অভাবজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগি, যেগুলে কে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা বা ইংরেজিতে আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিজঅর্ডার (আইডিডি) বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর প্রায় দেশে আয়োডিনের ঘাটতি জনিত থায়রয়েডের সমস্যা বিরাজমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতো পৃথিবী ব্যাপী প্রায় ১৯৮৮.৭ মিলিয়ন মানুষ আয়োডিনের ঘাটতিজনিত থায়রয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত। অঞ্চলভিত্তিক এ সমস্যার প্রাবল্যে তারতম্য আছে। সে যা হোক, বাংলাদেশ এ সমস্যায় আক্রান্ত গভীরভাবে।
এসব সমস্যার কয়েকটি নিম্নরূপ:
হাইপো থাইরয়ডিজম
আয়োডিনের অভাবে যখন শরীরে পর্যাপ্ত থাইরোয়েড হরমোন তৈরি হয় না তখন তাকে হাইপো থাইরয়ডিজম বলা হয়। এর ফলে, আলসে মির ভাব, ঠান্ডাসহ্য করতে অক্ষমতা, অনিদ্রা, চামড়া শুস্ক হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। গলগন্ড আয়োডিনের ঘাটতির প্রাথমিক ও দৃশ্যমান লক্ষণ হলো গলগন্ড রোগ। আমাদের গলদেশে থোইরয়েড গ্রন্থি আছে, তা যখন আয়োডিনের অভাবে ফুলে যায় তখন তাকে গলগন্ড রোগ বলা হয়।
আগেই বলা হয়েছে, আয়োডিনের অভাবে আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না। এ-অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করার চেষ্টা করে। মুল উপাদান আয়োডিনের ঘাটতি থেকে যাওয়ার পরও যখন গ্রন্থিটি আয়োডিন তৈরির বৃথা চেষ্টা করে তখন তা আকারে বড় হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় এটি চোখে পড়ে না, কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়।

প্রজনন সমস্যা
গর্ভকালীনসময়ে থাইরোয়েড হরমোন শতকরা ৫০ ভাগ বেশি উৎপন্ন হয়। এই অতিরিক্ত থাইরোয়েড হরমোনের জন্য বেশি মাত্রার আয়োডিনের প্রয়োজন পড়ে। গর্ভধারণের ১১ সপ্তাহ থেকে ভ্রুণের থাইরোয়েড গ্রন্থি কাজ শুরু করে। ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহপূর্ণ হলে ভ্রুণ তার নিজস্ব থাইরোয়েড হরমোন উৎপাদন শুরু করে। সেই সময় থেকে শিশুর ৩ বছর বয়স পর্যন্ত সঠিক মাত্রার আয়োডিন গ্রহণ মা ও শিশু উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রুণের বৃদ্ধি ও সময় মস্তিষ্ক এবং অন্ত্র খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
এ সময় আয়োডিনের অভাব হলে বা পর্যাপ্ত আয়োডিন না পেলে মস্তিষ্কেও স্থায়ী ক্ষতিসহ আয়োডিন ঘাটতি জনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিনের খুব বেশি অভাব দেখা দিলে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অপরিণত শিশুর জন্ম হতেপারে। এই সন্তান বেঁচে থাকলেও জন্মগত নানা সমস্যায় ভোগে। এর ফলে সন্তান হাবাগোবা হয়, ভালোভাবে কথা বলতে পারেনা কিংবা একেবারে বোবা হয়, কানে কম শোনে এবং শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় বামন আকৃতির থেকে যায়।
শিশুমৃত্যু
আয়োডিনের অভাবগ্রস্ত শিশুরা অন্যান্য শিশুর চাইতে বেশি মাত্রায় অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে এবং তাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে। ফলে, তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি থাকে। আয়োডিন গ্রহণের সঠিক মাত্র নির্নয়
আমরা সঠিক মাত্রায় আয়োডিন খাচ্ছি কিনা তা পরিমাপ করা যায় প্রসাবের সঙ্গে নির্গত আয়োডিনের পরিমাণ থেকে। নানা রকম খাবারের মাধ্যমে আমরা যে আয়োডিন খাই তার শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি প্রসাবের সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তাই প্রসাবে আয়োডিনের মাত্রা জানার মাধ্যমে বুঝতে আমরা সঠিক পরিমাণে আয়োডিন খাচ্ছি কিনা।
একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্টির মানুষের শরীরে আয়োডিনের অবস্থা পরিমাপ করার জন্য তাদের প্রসাবে আয়োডিনের মাত্রা একটি ভালো সূচক হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রতিলিটার প্রস্রাবে গড়ে আয়োডিনের মাত্রা যখন ১০০-২০০ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায় তখন বুঝতে হবে শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি নেই।
প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গতআয়োডিনের সাথে আয়োডিনগ্রহনেরসর্ম্পক বোঝাবার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও অন্য কয়েকটিসংস্থা নিচের সারণি ব্যবহার করে থাকে:
প্রস্রাবে আয়োডিনের গড় মাত্রা
(মাইক্রোগ্রাম/লিটার) গড় আয়োডিন সেবন
(মাইক্রোগ্রাম/লিটার) শরীরে আয়োডিনের পুষ্টিগতঅবস্থা
<২০ <৩০ আয়োডিনের চরম ঘাটতি
২০-৪৯ ৩০-৭৪ মাঝারিপর্যায়েরঘাটতি
৫০-৯৯ ৭৫-১৪৯ স্বল্প মাত্রার ঘাটতি
১০০-১৯৯ ১৫০-২৯৯ আদর্শ (সঠিক) মাত্রায় আছে
২০০-২৯৯ ৩০০-৪৪৯ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আছে

বাংলাদেশের মাটি, ফসল ও মানুষের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি জনিত সমস্যা সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমানে যে আয়োডিন আছে তা সমুদ্র থেকে বাষ্পহয়ে মেঘের সাথে আকাশে উঠে যায়। বৃষ্টির মাধ্যমে তা মাটিতে এসে পড়ে। গাছপালামাটি থেকে এই আয়োডিন শোষণকরে। কিন্ত বাংলাদেশে অতিবৃষ্টি, বন্যা, ইত্যাদির কারণে মাটির এই আয়োডিন ধুয়ে আবার সমুদ্রে চলে যায়।
এসব কারণে আমাদের দেশের মাটিতে ও ফসলে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে, এখানকার মানুষের মধ্যে আয়োডিন ঘাটতির ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে বিস্তীর্ণ নদীর অববাহিকায় বসবাসরত জনগোষ্টির মধ্যে এই সমস্যা প্রকট, কারণ প্রায় প্রতিবছর বন্যার সময় এসব এলাকার ফসল উৎপাদনকারী জমিজমা পানিতে তলিয়ে যায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় মাটি থেকে আয়োডিন ধুয়ে চলে যায়।
২০০৪-২০০৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে: শিশুদেরশতকরা ৬.২ ভাগএবং মহিলাদের ১১.৭ ভাগ গলগন্ড রোগে আক্রান্ত। ১৯৯৩ সালে এই হার ছিলো যথাক্রমে শতকরা ৪৯.৯ ভাগ ও ৫৫.৬ ভাগ। ২০০৪-২০০৫ সালের সমীক্ষায় শিশুদের প্রস্রাবে আয়োডিন পাওয়া গেছে প্রতিলিটারে ১৬২ মাইক্রোগ্রাম এবং মহিলাদের প্রস্রাবে ১৪০ মাইক্রোগ্রাম। ১৯৯৯ সালে এই মাত্রাছিল যথাক্রমে ৫৪ মাইক্রোগ্রাম ও ৪৭মাইক্রোগ্রাম। ১৯৯৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী আয়োডিনের অভাবছিল বাচ্চাদের মধ্যে শতকরা ৭১ ভাগ এবং মহিলাদের মধ্যে ছিল ৭০.২ ভাগ। ২০০৫ সালে এই হার নেমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩৩.৮ ভাগ ও ৩৮.৬ ভাগে।

উপরোক্ত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এদেশে আয়োডিনের ঘাটতি লাঘবে গৃহীত জাতীয় প্রচেষ্টায় যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও এখনও আমাদের দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক আয়োডিনের ঘাটতিজনিত নানা সমস্যায় ভুগছে। ২০০৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪.০ ভাগ এবং মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৪.৫ ভাগ আয়োডিনের চরম স্বল্পতায় ভুগছে। তাই আয়োডিনের এই ঘাটতি লাঘবে আমাদেরকে আরো বেশি সচেষ্ট হতে হবে।
প্রতিরোধেরউপায়
আয়োডিনের এই ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করতে আমাদেরকে অবশ্যই খাদ্যের সাথে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। এর সবচেয়ে ভালো এবং সহজ উপায় হলো আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া। আমাদের দেহে বেশি আয়োডিন জমা থাকেনা, তাই নিয়মিত অল্প পরিমাণে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। আয়োডিনযুক্ত লবণ শুষ্ক স্থানে, সূর্যের আলো থেকে দূরে এবং আবদ্ধ পাত্রে রাখতে হবে। নতুবা লবণে আয়োডিনের পরিমাণ কমে যাবে।
ডা. শাহজাদা সেলিম : সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়