বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দেশ প্রস্তুতির তাগিদ ভূতাত্ত্বিক সমিতির
- আপডেট সময় : ০৫:০৬:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ৩৮ বার পড়া হয়েছে
আমিনুল হক ভূইয়া
বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখে রয়েছে, এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন দেশের শীর্ষ ভূতাত্ত্বিক ও দুর্যোগ গবেষকরা। তাদের মতে, রাজধানী ঢাকার আশপাশের মাটির গঠন অত্যন্ত দুর্বল। দূরবর্তী উৎসের কম্পনও এই দুর্বল অঞ্চলে তীব্র আঘাত হানতে পারে। ফলে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন-এই দুর্বল মাটিতে নির্মিত অবকাঠামোগুলো কতটা নিয়ম মেনে তৈরি হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. রেশাত মো. একরাম আলী জানান, ঢাকার আশপাশের ৩০ ফুট মাটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। এসব এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে আন্তর্জাতিক মানের নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে অনুসরণ করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, ভুল তথ্য ও গুজব জনমনে আতঙ্ক বাড়ায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান বলেন, নরসিংদীর মাধবদীতে ২১ নভেম্বরের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি মাটির প্রায় ২৫ মাইল গভীরে সৃষ্টি হয়েছিল। ভূমিকম্প সম্পূর্ণ ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বিষয়, এখানে অবিশেষজ্ঞদের মন্তব্য বিভ্রান্তি বাড়ায়। ৬ ডিসেম্বর বড় ভূমিকম্প হবে ধরনের গুজবেরও বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো ভিত্তি নেই বলে তিনি স্পষ্ট করেন। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১০ শহরের একটিতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে সামান্য দুর্যোগও ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন-কড়া নিয়ম মেনে অবকাঠামো নির্মাণ এবং ভুল তথ্যের প্রসার বন্ধ করা। জনসচেতনতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যই হতে পারে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রথম প্রতিরক্ষা।

ভূমিকম্প বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয় এমন ব্যক্তিদের অনিয়ন্ত্রিত মন্তব্য থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি। সংগঠনটির দাবি, অনভিজ্ঞদের মন্তব্য বা ভুল ব্যাখ্যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং বাস্তব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা এবং করণীয় শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ আহ্বান জানান। এসময় জানানো হয়, গত ১৯ নভেম্বর হওয়া ভূমিকম্পের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং দেশের মূলধারার কিছু গণমাধ্যমেও বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। এতে জনগণের মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ বাড়ে। ভূমিকম্প একটি বৈজ্ঞানিক ও অত্যন্ত বিশেষজ্ঞভিত্তিক বিষয় হওয়ায় যারা প্রযুক্তিগত জ্ঞান রাখেন না, তাদের মন্তব্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলে-বলেন বক্তারা।
সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. বদরুল ইমামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আনোয়ার জাহিদ। এছাড়া প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. রেশাত মো. একরাম আলী, অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান ও উপদেষ্টা অলিউল ইসলামসহ অন্যান্য গবেষকরা। সংবাদ সম্মেলনে ভূমিকম্প মোকাবিলা ও ঝুঁকি হ্রাসে একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরে ভূতাত্ত্বিক সমিতি। তাদের মতে, প্রথমেই প্রয়োজন দেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ভূকম্পন প্রবণতা নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা। বাংলাদেশের উপরিভাগ, অভ্যন্তরীণ ভূগঠন এবং টেকটোনিক প্লেটের গতিপ্রকৃতি বোঝা জরুরি। বক্তারা বলেন, বিশেষ করে মধুপুর ও ডাউকি ফল্টসহ দেশের বিভিন্ন জানা-অজানা ফল্ট লাইনের অবস্থান, বিস্তৃতি ও প্রকৃতি নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ এগুলোই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করে।

এছাড়া, ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিকে মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে শক্তিশালী করতে হবে বলে সংগঠনটির নেতারা জানান। পর্যাপ্ত জনবল, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও গবেষণা সুবিধা দেওয়া হলে ভূমিকম্প প্রসঙ্গে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা সহজ হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ প্রতিষ্ঠানের একজন দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞকে মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করেন তারা। এতে যাচাইবাছাই ছাড়া ভুল তথ্য প্রচারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়াবে না। বক্তারা আরও বলেন, ভূমিকম্প মোকাবিলা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, জরুরি উদ্ধারকর্মী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং ভূতাত্ত্বিক-সব সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের সমন্বিতভাবে কাজ করলেই প্রকৃত প্রস্তুতি গড়ে তোলা সম্ভব। ভূমিকম্প-পরবর্তী নিরাপত্তা, ভবনের স্থায়িত্ব, নগর পরিকল্পনা এবং দুর্যোগ প্রশমন কৌশল একসঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
সভায় বক্তারা সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত কোনো তথ্য যাচাই না করে শেয়ার করা উচিত নয়। যে কোনো ধরনের ভূমিকম্পসংক্রান্ত সঠিক তথ্য ও নির্দেশনা পাওয়ার জন্য সরকার অনুমোদিত সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞদের ওপরই নির্ভর করতে হবে। তারা বলেন, তথ্যভিত্তিক প্রস্তুতি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা শক্তিশালী হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ আরও সক্ষম হবে।

















