সবুজ দীপাবলি
- আপডেট সময় : ০৬:২৯:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২১ ৩৩২ বার পড়া হয়েছে
ড. বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ , কলকাতা
‘সামাজিক ও পরিবেশ গত দুষণকে দূরে ঠেলে খুশির আলোক মালায় সাজাই দীপাবলি’
পশ্চিমবঙ্গ আতশবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা পার্ক সার্কাসে যে আতশবাজি মেলা করছি, সেখানে শব্দবাজি বিক্রি হবে না। সরকারি নির্দেশ মতো পরিবেশবান্ধব বাজিই বিক্রি হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে নির্দেশিকা দিয়েছে তা আমরা মেনে চলব।’
বেশ ক’বছর ধরেই দীপাবলিতে বাজি পোড়ানো নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক ও নিষেধাজ্ঞা। সম্প্রতি কখন, কী কী বাজি পোড়ানো যাবে, তা নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। মঙ্গলবার জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে ২০১৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশনার উল্লেখ করা হয়েছে। তার প্রেক্ষিতেই দেওয়া হয়েছে মূলত চারটি নির্দেশ।
নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, কালীপুজোর দিন মাত্র ২ ঘণ্টা পোড়ানো যাবে আতশবাজি। তা-ও সেই বাজিকে হতে হবে পরিবেশবান্ধব। রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বাজি পোড়ানোর ছাড় রয়েছে। ছটপুজোতেও ঘণ্টা দু’য়েকের বেশি সময় মেলেনি। তবে ছটপুজোয় একটু লম্বা সময় অর্থাৎ সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত আতশবাজি পোড়ানো যাবে।

বড়দিনের উৎসব-সহ নতুন বছরের সূচনালগ্নে আতশবাজি পোড়ানোর ছাড় দেওয়া হলেও, তার সময় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৪ ও ৩১ ডিসেম্বর রাতে ৩৫ মিনিট আতশবাজি পোড়ানো যাবে। রাত ১১টা ৫৫ মিনিট থেকে সাড়ে ১২টা। সেই বাজিকেও হতে হবে পরিবেশবান্ধব।
বায়ু দূষণ রুখতেই এমন পদক্ষেপ বলে জানানো হয়েছে পর্ষদের তরফে। পাশাপাশি, সবরকম শব্দবাজি পোড়ানো বা বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পরিবেশ দফতর।
শব্দবাজিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকার কারণেই বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়তে পারে। ফলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়ারও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। তেমনই করোনা পজিটিভ রোগীদেরও সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা। কারণ, রোগীদের শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য তাজা বাতাস অত্যন্ত জরুরি।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার বায়ু পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, এখানকার বাতাস মাঝারি থেকে ভাল মানের রয়েছে। তাই পোড়া আতশবাজি বায়ু দুষণ হলে অসুস্থদের অসুবিধা হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গ আতশবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা পার্কসার্কাসে যে আতশবাজি মেলা করছি, সেখানে শব্দবাজি বিক্রি হবে না। সরকারি নির্দেশ মতো পরিবেশবান্ধব বাজিই বিক্রি হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে নির্দেশিকা দিয়েছে তা আমরা মেনে চলব।’
বাজি ফাটানোর এই নির্দেশিকার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন থানা এলাকায় জারি করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা। তারসঙ্গে তাঁরা গ্রীন দীপাবলির উপরেও গুরুত্ব দিচ্ছেন, যা পরিবেশ বান্ধব বাজির দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। কি এই বাজি ? আসুন দেখে নেই।

এবার টালার বাজি বাজারে ব্যাপক বিকিয়েছে ‘গ্রিন বাজি’। ক্রেতাদের আরও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতে আবেদন জানাচ্ছেন খোদ বাজি বিক্রেতারাও। যেমন ধরুন বিক্রেতা সন্দীপ বোস। নিজে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে তৈরি করেছেন গ্রিন বাজি। তবে তাঁর দোকানে বাজি কিনলেই হবে না, সঙ্গে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে টবে লাগানো জবা গাছ।
কলকাতার টালা পার্কে জমে উঠেছে বাজি বাজার। ২১ নম্বর স্টলে বিক্রি-বাটা ভালই হচ্ছে। ভিতরে ঢুকে খোঁজ নিতেই জানা গেল, গ্রিন বাজি কেনার ভিড়। এক ক্রেতার মতে প্রতিবছর এখান থেকে নানা ধরনের বাজি কিনে নিয়ে যান তাঁরা কিন্তু এবার এই গ্রিন বাজি কিনেছেন এই বাজি পরিবেশ দূষণ অনেকটাই রোধ করতে পারবে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতা।
সুপ্রিম কোর্ট সারা দেশে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বাজি পোড়ানোর সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু দিল্লিতে বেরিয়াম সল্ট দিয়ে নির্মিত বাজি পোড়ানো একেবারে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কারণ, দিল্লিতে দূষণের পরিমান দেশের অন্যান্য শহরের থেকে অনেকটা বেশি। সন্দীপবাবু চেষ্টা করেছেন যাতে পরিবেশ বান্ধব বাজি তৈরি করা যায়।

পরিবেশ বান্ধব বাজি তৈরি করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সন্দীপবাবুর বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, বেরিয়াম সল্ট ব্যবহার করা যাবে না। আগে বাজি তৈরিতে কাঠ কয়লা ব্যবহার করা হত। বর্ষা পড়লে যা বসে যায়। তাই তার বদলে ব্যবহার করা হচ্ছিল বেরিয়াম সল্ট। এটা পোড়ার পর বেরিয়াম পেরক্সাইড তৈরি হয়। আমি বেরিয়াম সল্ট পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করতে পারি নি। সাদা ভাব বা উজ্জ্বল ভাব আনে বেরিয়াম।
আদালত পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) নিষিদ্ধ করেনি, তাই বেরিয়াম কমিয়ে পিভিসি দেওয়া হচ্ছে। তাতে ধোঁয়া কম হবে, আলো খুব উজ্জ্বল হবে। কিন্তু বেরিয়াম ব্যবহার শূন্য শতাংশে আনতে পারিনি। আগে ৪৫-৬০ শতাংশ দেওয়া হত। এখন ২৫-৩০ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। এভাবেই চেষ্টা করা হয়েছে পরিবেশ বান্ধব বাজি তৈরি করার। তাঁর আক্ষেপ,তাঁদের কেউ প্রশিক্ষণ দেয় না। তবু তাঁরা চেষ্টা করছেন যাতে দূষণের মাত্রা কম হয়।
তিনি জানান, অ্যালুমিনিয়াম চুর বা লোহাচুর ব্যবহার করা হয় না। সাদা ভাব আনার জন্য অ্যালুমিনিয়াম চুর ব্যবহার করা হত। এখন তার বদলে কমসিয়াম ব্যবহার করা হচ্ছে। রংমশাল বেরিয়াম ও পিভিসি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আগে সবটাই বেরিয়াম দেওয়া হত। তারও আগে ড্রাই কপার সালফেট ব্যবহার করা হত। সেটা পুড়লে খুব ক্ষতিকর। কালো ধোঁয়া বের হত।

সবুজ রং আসতো। এখন তাও একেবারে ব্যবহার করা হয় না। হুগলির চন্ডীতলায় জঙ্গলপাড়া, বলরামবাটি, সিঙ্গুরে তাঁর নিজের বাজি কারখানায় এই ধরনের বাজি তৈরি করেছেন সন্দীপবাবু।
পরিবেশ বান্ধব বাজি তৈরি করে শুধু বাজার মাত করেছেন এমন নয়। সন্দীপবাবুর দোকানে বাজি কিনতে গেলে ক্রেতাকে একটি টবে লাগানো জবা গাছ নিতেই হবে। গাছ না নিলে বাজি দেওয়া হবে না, স্পষ্ট জানালেন তিনি। চার হাজার গাছ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। টবের ক্ষেত্রেও তিনি পরিবেশের কথা ভেবেছেন। প্লাস্টিক নয়, গাছ লাগিয়েছেন মাটির টবেই।
এভাবে মানুষ যদি সচেতন হন অচিরেই আমরা সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে পারবো। আসুন সবাই মিলে পরিবেশ বান্ধব দীপাবলি পালন করি। সামাজিক ও পরিবেশ গত দুষণকে দূরে ঠেলে খুশির আলোক মালায় সাজাই এই দীপাবলি।























