ক্ষমতার বলয়ে প্লট কেলেঙ্কারি: হাসিনা পরিবারের তিন সদস্যই দণ্ডিত
- আপডেট সময় : ০১:২৬:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫ ৩১ বার পড়া হয়েছে
রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক দণ্ডিত হয়েছেন। সোমবার ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
যার নামে প্লট বরাদ্দ ছিল, সেই শেখ রেহানাকে সাত বছরের কারাদণ্ড, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সহায়তার অভিযোগে শেখ হাসিনাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, আর খালাকে প্রভাবিত করার অভিযোগে টিউলিপকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুদকের করা মামলার বাকি ১৪ আসামিকেও আদালত পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছেন। অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড হবে। একই সঙ্গে রেহানার নামে বরাদ্দ ১০ কাঠার প্লটটি বাতিলের নির্দেশ দেয় আদালত।
মামলার অভিযোগ
অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও সেই তথ্য গোপন করে শেখ রেহানা পূর্বাচলের সেক্টর ২৭–এ কূটনৈতিক জোনে ১০ কাঠার প্লট নেন। শেখ হাসিনা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বোনকে প্লট বরাদ্দে সহায়তা করেন। আর টিউলিপ সিদ্দিক তার মা রেহানাকে প্লট পেতে খালা হাসিনার ওপর প্রভাব বিস্তার করেন।

আসামিদের মধ্যে রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম একমাত্র কারাগারে ছিলেন এবং তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আগের তিন মামলায় আত্মসমর্পণ করায় লঘু সাজা পেলেও এ মামলায় বিচারক ‘কৃপা’ দেখাননি। পাঁচ বছরের সাজা পেয়ে তিনি অসন্তোষ জানান এবং আপিলের ঘোষণা দেন। দুদকের আইনজীবীও রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশিত ছিল।
পটভূমি: কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
বিগত সরকারের সময়ে পূর্বাচলের সেক্টর ২৭–এর কূটনৈতিক জোনে শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার দুই সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও আজমিনা রূপন্তীর নামে মোট ছয়টি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ হয়। মামলা অনুসারে, এসব বরাদ্দ ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, নথি গায়েব করা, নিয়ম ভঙ্গ এবং যোগসাজশের মাধ্যমে’ দেওয়া হয়।
- শেখ রেহানা-ঢাকায় আবাসন সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তথ্য গোপন করে প্লট নেন।
- টিউলিপ সিদ্দিক-মাকে প্লট পাইয়ে দিতে বিধি ভঙ্গ করে প্রভাব বিস্তার।
- শেখ হাসিনা-ক্ষমতার অপব্যবহার ও নথি গায়েবের অভিযোগ।
- মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন (একান্ত সচিব)-বরাদ্দের চিঠি ইস্যু ও নথি গায়েবের অভিযোগ।
- গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-অবৈধভাবে নথি প্রক্রিয়ায় সই।
- রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান, সদস্য ও কর্মকর্তারা-যোগসাজশ করে প্লট বরাদ্দ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান, পরিবারও দেশের বাইরে। তাদের অনুপস্থিতিতে মামলার বিচার চলে এবং পলাতক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে লড়তে পারেননি।
অনুসন্ধান ও মামলার ধারা
প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উচ্চ আদালতে উত্থাপিত হলে তদন্ত কমিটি করা হয়। এরপর দুদক ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে অনুসন্ধান শুরু করে এবং ছয়টি প্লটের জন্য ছয়টি মামলা করে। শেখ রেহানার প্লটের মামলাটি ১৩ জানুয়ারি দুদকের উপপরিচালক সালাহ উদ্দিন দায়ের করেন। তদন্ত শেষে ১০ মার্চ অভিযোগপত্রে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ জনে। আদালত ১৩ এপ্রিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং পরে অভিযোগ গঠন করা হয়।
১৩ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য শেষে ২৫ নভেম্বর যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় এবং ২৭ নভেম্বর রায়ের দিন নির্ধারিত হয়।
রাজনীতির বাইরেও টিউলিপের বিতর্ক
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ডের এক ফ্ল্যাট ‘উপহার’ হিসেবে পাওয়ার খবর প্রকাশিত হলে জানুয়ারিতে টিউলিপ সিদ্দিক প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। রূপপুর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগেও তার নাম ওঠে। পরে দুদকের মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু হওয়ায় তিনি অভিযোগ করেন, দুদক কোনো প্রামাণিক নথি দেখায়নি এবং তার ‘ন্যায়বিচারের অধিকার’ ক্ষুণ্ন হয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান পাল্টা মন্তব্য করে বলেন, নির্দোষ হলে টিউলিপ পদত্যাগ করলেন কেন?”
আরও মামলার বিচার বাকি
পূর্বাচলের প্লট দুর্নীতির অন্য তিন মামলায় গত বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড পান। ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুলেরও পাঁচ বছর করে সাজা হয়। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় গত ১৭ নভেম্বর।
প্লট দুর্নীতির আরও দুটি মামলা এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে, যার আসামি শেখ হাসিনা, টিউলিপ, রাদওয়ান মুজিব ও রূপন্তী।

কার কী সাজা
| আসামি | পরিচয় | সাজা |
| শেখ রেহানা | সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন | ৭ বছরের কারাদণ্ড |
| শেখ হাসিনা | সাবেক প্রধানমন্ত্রী | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| টিউলিপ সিদ্দিক | শেখ রেহেনার মেয়ে ও ব্রিটিশ এমপি | ২ বছরের কারাদণ্ড |
| শরীফ আহমেদ | সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| কাজী ওয়াছি উদ্দিন | গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| পূরবী গোলদার | গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| অলিউল্লাহ | গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন | সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| মোহাম্মদ খুরশীদ আলম | রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| আনিছুর রহমান মিঞা | রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন | রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী | রাজউকের সাবেক সদস্য | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| তন্ময় দাস | রাজউকের সাবেক সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| নুরুল ইসলাম | রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| মাজহারুল ইসলাম | রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| নায়েব আলী শরীফ | রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| সাইফুল ইসলাম সরকার | গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা | ৫ বছরের কারাদণ্ড |
| ** আসামিদের সবাইকে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে | ||


















