ঘোষণা দিয়েও সরকার আলু কেনেনি, লাখো টন মজুত, স্বপ্ন ভঙ্গ কৃষকের
- আপডেট সময় : ০৮:২৭:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫ ১১১ বার পড়া হয়েছে
দুই মাস কেটে গেলেও বাণিজ্য উপদেষ্টার সেই ঘোষণা বাস্তবে রূপ নেয়নি
“ঘোষণা দিয়েও সরকার আলু না কেনায় ভরাডুবিতে পড়েছে কৃষকের স্বপ্ন, হিমাগারে পড়ে আছে লাখো টন আলু-দরপতনে হারিয়ে যাচ্ছেতাদের ঘাম ঝরানো ফসলের মূল্য”
আলু পরিণত হয়েছে বিপদের ফলনে
হাতে গোনা আর কয়েকদিন পরই মাঠে উঠতে শুরু করবে নতুন আলু। কিন্তু পুরোনো আলুর বাজারে এখন হাহাকার। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৮ থেকে ২০ টাকায়। যেখানে প্রতি বছর এই সময়ে দাম থাকত ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। দরপতনের এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
আলু আমদানির সংকট কাটাতে সরকার উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহ দিয়েছিল। ফলাফল মেলে-এ বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ ১ কোটি ২৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশের বার্ষিক চাহিদা ৯০ লাখ টনের তুলনায় প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি। আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালে আলু উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৬ লাখ টন। উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৩ লাখ টন। কিন্তু এই অতিরিক্ত উৎপাদনই এখন কৃষকের জন্য পরিণত হয়েছে বিপদের ফলনে।

সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, আলুর বাজার স্থিতিশীল রাখতে টিসিবির মাধ্যমে ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনা হবে এবং রপ্তানিতেও প্রণোদনা দেওয়া হবে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন গত ৫ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাটের আক্কেলপুর সফরে এসে সাংবাদিকদের বলেন, সরকার কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় হিমাগার গেটে আলুর সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু দুই মাস কেটে গেলেও বাণিজ্য উপদেষ্টার সেই ঘোষণা বাস্তবে রূপ নেয়নি।
এরই মধ্যে আক্কেলপুর উপজেলার দুই হিমাগার গোপীনাথপুর কোল্ড স্টোরেজ ও দীনা কোল্ড স্টোরেজে পড়ে আছে প্রায় ৯২ হাজার বস্তা আলু, প্রতি বস্তায় ৬০ কেজি ধরে মোট পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মণ। প্রতি মণে ৬০০ টাকা লোকসান ধরলে স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
আক্কেলপুর কলেজ বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও আলু ব্যবসায়ী কাজী শফিউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও প্রায় ৯ হাজার ৭০০ বস্তা আলু হিমাগারে রেখেছিলাম। কিন্তু বাজারে দাম পড়ে যাওয়ায় এখন সেই আলু বিক্রিই করতে পারছি না। উৎপাদন খরচের নিচে আলু বিক্রি করে এখন বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছি।

অপর মৌসুমী ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ আলু কেনা থেকে হিমাগারে সংরক্ষণ পর্যন্ত প্রতি কেজিতে তার খরচ হয়েছে ২৩ টাকা বলে জানান। বর্তমানে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকায়। ফলে প্রতি কেজিতে তার লোকসান ১৫ টাকা করে, মোট ক্ষতি প্রায় ৯ লাখ টাকা।
কৃষকের অবস্থাও আরও শোচনীয়। আক্কেলপুরের চাষি আবু বক্কর সিদ্দিক ১০ বিঘা জমিতে ডায়মন্ড ও স্টিক জাতের আলু চাষ করে প্রায় ১ হাজার মণ ফলন পান। মৌসুমের শুরুতে ৭৫০ মণ আলু বিক্রি করেই ৯০ হাজার টাকা লোকসান হয়। বাকি ২৫০ মণ আলু হিমাগারে রাখলেও দাম না বাড়ায় আরও প্রায় ২ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান।
উপজেলা কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আক্কেলপুরে ৫ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছিল। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬শ হেক্টরে-অর্থাৎ ৬৮০ হেক্টর বেশি জমিতে আলু উৎপাদিত হয়েছে। অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমেছে।

উপজেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ মেহেদী হাসান বলেন, সরকারিভাবে ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার সিদ্ধান্ত হলেও এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। ফলে কেনার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। রপ্তানি ও বিকল্প বাজার তৈরিতে কাজ চলছে।
কৃষকরা বলছেন, হিমাগারে সংরক্ষণের পাঁচ মাস পর এখন আলুর দাম এতটাই কম যে, আলু তুললে পরিবহন খরচও উঠবে না। সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হলে আগামী মৌসুমে অনেকেই আলু চাষ থেকে সরে যাবেন।
এই অবস্থায় দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্য আলু নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে সরকার ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। কারণ, “ঘোষণা দিয়েও সরকার আলু না কেনায় ভরাডুবিতে পড়েছে কৃষকের স্বপ্ন, হিমাগারে পড়ে আছে লাখো টন আলু-দরপতনে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ঘাম ঝরানো ফসলের মূল্য।”














