শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হেলেনা: একাত্তরের আকাশে মুক্তির দীপ্ত তারকা
- আপডেট সময় : ১১:১৬:৩৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৫২ বার পড়া হয়েছে
১৯৬৮ সালে বিএ পাস করে মাগুরা সরকারি গার্লস হাইস্কুলে সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি মাগুরার বাম রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন
স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল অগণিত ত্যাগ, বেদনা ও রক্তের বিনিময়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বহু অজানা বীরের কাহিনি আজও ছড়িয়ে আছে দেশের মাটিতে। তেমনি একজন অমর নায়িকা শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনা—মাগুরার বীর কন্যা, যিনি দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। একাত্তরের আকাশে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তির দীপ্ত এক তারকা।
লুৎফুন নাহার হেলেনা ১৯৪৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মাগুরা শহরে এক শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মুহাম্মদ ফজলুল হক এবং মা মোসাম্মৎ ছফুরা খাতুন। পাঁচ ভাই ও নয় বোনের সংসারে হেলেনা ছিলেন ষষ্ঠ। শৈশবেই বাবার হাত ধরে বই পড়ার অভ্যেস গড়ে ওঠে তাঁর। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে নানা ধরনের বই পড়ে তিনি হয়ে ওঠেন জ্ঞান, চেতনা ও মানবিকতায় সমৃদ্ধ এক আলোকিত নারী।
মেধাবী এই তরুণী ১৯৬৮ সালে বিএ পাস করে মাগুরা সরকারি গার্লস হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি যুক্ত হন বাম রাজনীতিতে। তখনকার সময় নারী হয়েও রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল সাহসিকতার এক দৃষ্টান্ত। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মাগুরা আঞ্চলিক শাখার নেত্রী এবং মাগুরা কলেজ ছাত্র সংসদের মহিলা কমন রুম সম্পাদিকা ছিলেন হেলেনা।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কাজে সম্পৃক্ত হন। তিনি তখন মাগুরা শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের তৎপরতার খবর সংগ্রহ করে স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আলী কদরের কাছে পাঠাতেন। তাঁর সাহসিকতা ও সংগঠনী ভূমিকা মুক্তিকামী জনগণের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয়।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে হেলেনা চলে যান মহম্মদপুর এলাকায়, যেখানে তাঁর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি বিশেষভাবে নারীদের সংগঠিত করতে থাকেন। ভূমিহীন ও কৃষক পরিবারের নারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, আহতদের সেবা করা—এসব কাজেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
কিন্তু দেশপ্রেমিক এই নারীকে ঘাতক রাজাকারদের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়। ১৯৭১ সালের ৫ অক্টোবর, পবিত্র শবে বরাতের রাতে, রাজাকাররা গুপ্তচরের সহায়তায় হেলেনাকে তাঁর দুই বছর পাঁচ মাস বয়সী শিশুপুত্রসহ গ্রেফতার করে মহম্মদপুরের এক গ্রাম থেকে। পরদিন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মাগুরা শহরে, যেখানে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁকে।
তাঁর বৃদ্ধ বাবা ও আত্মীয়স্বজন দুধের শিশুসহ এক তরুণী মায়ের মুক্তির আবেদন জানালেও কোনো কর্ণপাত করা হয়নি। জামাতপন্থি রাজাকাররা তাঁর মুক্তির বিরোধিতা করে পাকিস্তানি সেনাদের জানায়, হেলেনা হচ্ছেন মাগুরার বামপন্থি নেতা মাহফুজুল হক নিরোর বোন এবং মুক্তিযোদ্ধা নেতা আলী কদরের স্ত্রী—তাই তাঁর মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না।
পরদিন পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করে। এরপর তাঁর দেহ জিপের পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নবগঙ্গা নদীর ডাইভারশন ক্যানেল পর্যন্ত। সেখানে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ ফেলে দেওয়া হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর স্বামী আলী কদরের লেখায়—“হেলেনার মৃত্যুঘটনা ছিল করুণ ও মর্মান্তিক।”
হেলেনার মৃত্যু শুধু এক নারীর নয়, এক আদর্শ, এক চেতনার মৃত্যুও বটে। কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগ আজও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিনাশী আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলছে। শিক্ষকতা থেকে শুরু করে রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সাহসী, সংগঠক ও নেতৃত্বগুণে অনন্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের মধ্যে শহীদ হেলেনা বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর অবদান শুধুমাত্র মাগুরার গর্ব নয়, গোটা জাতির প্রেরণা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও তাঁর নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
লুৎফুন নাহার হেলেনা আমাদের মনে করিয়ে দেন—স্বাধীনতা শুধু একটি দেশের মানচিত্র নয়, এটি হাজারো নারীর চোখের জল, হাজারো মায়ের নিঃশব্দ কান্না, এক সাহসী নারীর শেষ রক্তবিন্দুর আর্তনাদ। তিনি ছিলেন সেই রক্তিম ইতিহাসের এক অনলস প্রতীক—একাত্তরের আকাশে ঝলমলে এক তারা, যিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাঁচিয়ে গেছেন বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা।














