ম্যানগ্রোভ
- আপডেট সময় : ১১:৪২:৩৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ অগাস্ট ২০২১ ২৬০ বার পড়া হয়েছে
ছবি সংগ্রহ
“বনাঞ্চলের ৬-১০মিটার উচ্চতার গাছগুলো সামুদ্রিক ঝড় ও সাইক্লোনের গতিবেগকে ৬০শতাংশ কমাতে সক্ষম সাম্প্রতিককালে মানুষের আগ্রাসী মনোভাব ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কবলে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দিনে দিনে তার ঔজ্বল্য হারাচ্ছে। এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন বেশ কিছু মানুষ। যারা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বাঁচানোর কাজে নেমেছেন”
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশ সুন্দরবন জুড়ে ভারত বর্ষের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিস্তার। সাধারণত কোনো নদীর বদ্বীপ অংশে অর্থাৎ মোহনার দিকে জোয়ার প্লাবিত লোনা আর মিষ্টি জলের মিলন ভূমিতে যে অরণ্য রাজি ও ইকোসিস্টেম সৃষ্টি হয় তাকেই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বলা হয়।
ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল গুলোতে যে সমস্ত বৃক্ষ থাকে তাদের শ্বাস মূল ও ঠেস মূল দেখা যায় বলেই গাছ গুলিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। সাধারণত জোয়ারের জলে প্লাবিত থাকায় এরা শ্বাস মূল দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করে। আর কাণ্ডকে শক্ত ভাবে ঠেস দিয়ে রাখার জন্য কাজ করে ঠেস মূল।
উষ্ণ মন্ডলীর ও উপ উষ্ণ মন্ডলীর মধ্যে ম্যানগ্রোভ অঞ্চল অবস্থিত। আন্ত প্লাবিত এলাকাতে অবস্থিত হওয়ায় এটি সামুদ্রিক, মিষ্টি জলের ও ভূমি জাত উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। ফলে এটি উপকূল অঞ্চল, সেখানকার জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি অর্থনীতি পরিবেশ সব কিছু কেই প্রভাবিত করে।
এই অঞ্চল জিব বৈচিত্র্য পরিপূর্ণ এবং বহু বৃহৎ উদ্ভিদ,অজানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ, প্রাণী, কীটপতঙ্গ, জলজ প্রাণী প্রকৃতির সমন্বয়ে এক অপূর্ব জগৎকে প্রাণ ধারণে সহায়তা করে। এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সঙ্গে সুন্দর বন ও তার পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক সামাজিক পরিবেশ যুক্ত।
এই অংশে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এক সহাবস্থান দেখা যায়। এই বনাঞ্চল গুলির নিজস্ব ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র আছে যা আবার একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
ম্যানগ্রোভ জন্মানোর জন্য উষ্ণ মণ্ডলের আদ্র উপকূলীয় আবহাওয়া প্রয়োজন যা দেখা যায় গঙ্গা, আমাজন ও মেকং এর অববাহিকায় বা উপকূলবর্তী ব দ্বীপ অঞ্চলে। ভারতের সুন্দরবনকে ইউনেস্কো World Heritage Site আখ্যা দিয়েছে।
সুন্দরবন এর নামকরণ হয়েছে সুন্দরী নামক গাছ থেকে। এখানে প্রায় একশত রকমের প্রজাতি দেখা যায়। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, ওরা, হিন্তাল, কেওড়া, পশুর, ধন্দুল, বাইন, গোলপাতা প্রভৃতি অন্যতম।
ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গাছগুলির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বর্তমান
১, এর মুলতন্ত্র নীচের দিকে নয় বরং পাশের দিকে বিস্তৃত, অর্থাৎ অনুভূমিক। এই মূলতন্ত্র থেকে ঊর্ধ্বমুখী শাখা দেখা যায়, যা জলের ওপর ভেসে থাকে এবং এগুলোর ঊর্ধ্ব প্রান্তে নিউ মাটাপোর নামে শ্বাস ছিদ্র থাকে। যা দিয়ে এরা প্রবল জোয়ারের সময় শ্বাস নিতে পারে।
২. এদের যে ফল তারমধ্যে বীজ অঙ্কুরিত অবস্থায় থাকে। যার ফলে মাটিতে পরলেই সরাসরি গেঁথে মূল বিস্তার করতে পারে।
৩. এই বনাঞ্চলের ৬-১০মিটার উচ্চতার গাছ গুলো সামুদ্রিক ঝড় ও সাইক্লোনের গতিবেগকে ৬০শতাংশ কমাতে সক্ষম।
৪. আড়া আড়ি ভাবে বিস্তৃত শেকড় এর দরুন ঝড় সহজে এদের উপড়ে ফেলতে পারেনা।
এই অংশের প্রাণী বৈচিত্রের মধ্যে অন্যতম হলো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এছাড়াও আছে নানা ধরনের প্রাণী হরিণ, বনবিড়াল, বন্য শুকর, বানর, সাপ, মৌমাছি ছাড়াও নানা রকমের মাছ , কাঁকড়া, কীট পতঙ্গ ও প্রায় ২৭০টি প্রজাতির পাখি।
ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গুরুত্ব প্রাকৃতিক ও সামাজিক জনজীবনে অপরিসীম। যে কোন অরণ্যে বিশেষ পরিবেশগত ভূমিকা বর্তমান। ম্যানগ্রোভ তাদের মধ্যে অন্যতম।
১.এই অরণ্য ভূমিভাগের আদ্রতা বজায় রাখে, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ায় ফলে তা বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে।
২.গাছপালা মাটিতে জৈব উপাদান গুলি সংযোজিত করে ফলে মাটির উর্বরতা বাড়ে।
৩. এই বৃক্ষ গুলির শেকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে থাকে ফলে ভূমিক্ষয় রোধ হয়।
৪. বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণি ঝড়, সিডরের মারাত্মক আঘাত থেকে প্রাথমিক ভাবে জানজীবনকে রক্ষা করে।
৫. মাটির উপর বায়ু প্রবাহকে হ্রাস করে ফসলের ক্ষতিরোধ করে।
৬. নানা ধরেনের জীব বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে তা সামগ্রিক বাস্তু রীতিকে প্রভাবিত করে।
৭. জিবন শৈলী ও সংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে সহায়তা করে।
৮. বনজ সম্পদ থেকে গড়ে ওঠে নানা ধরনের শিল্প যা আবার অর্থনৈতিক উন্নতির সহায়ক।
৯. ভেষজ চিকিৎসার বিভিন্ন উপাদান গুলি সহজেই বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষ থেকে সংগ্রহ করা যায়।
১০.এই বনাঞ্চল গুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা পর্যটন শিল্প। যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে।
সাম্প্রতিককালে মানুষের আগ্রাসী মনোভাব ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কবলে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দিনে দিনে তার ঔজ্বল্য হারাচ্ছে। এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন বেশ কিছু মানুষ। যারা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বাঁচানোর কাজে নেমেছেন।
এদের মধ্যে অন্যতম হল রথীন্দ্রনাথ দাস। যিনি তাঁর Team We Wild এর মাধ্যমে নেমেছেন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিস্তারে। স্থানীয় মহিলাদের নিয়ে গড়ে তোলা টীম ও গ্রামীণ নার্সারীর সহায়তায় তিনি নদীতে ভেসে আসা ম্যানগ্রোভ বীজ সংগ্রহ ও তার রোপণের ব্যবসা শুরু করেন।
১৯০৩ সালে জীববিজ্ঞানী ডেভিড প্রেইন সুন্দরবন ও তার আশপাশের এলাকার ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালার তালিকা তৈরি করেন।