কপ–৩০: বিশ্ব কি শুনবে বাংলাদেশের আহ্বান?
- আপডেট সময় : ০৮:৪০:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫ ১০৭ বার পড়া হয়েছে
পৃথিবী এখন এক ভয়াবহ জলবায়ু সংকটে নিপতিত। কোথাও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব, কোথাও খরা, আবার কোথাও পাহাড়ধস ও দাবানলে বিপর্যস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। গলছে হিমবাহ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন আর ভবিষ্যতের ভয় নয়—এটি আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা।
এই সংকটের মধ্যেই ব্রাজিলের বেলেমে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন-কপ–৩০ (COP–30)। সেখানে জলবায়ু ন্যায্যতা ও বৈশ্বিক সহযোগিতার দাবিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও অবস্থান এখন আন্তর্জাতিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
কপ কী, কেন হয়?
COP বা Conference of the Parties জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (UNFCCC) আওতায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক বৈশ্বিক সম্মেলন।
এ সম্মেলনে প্রায় ২০০টি দেশ একত্র হয়—গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো, অভিযোজন বাড়ানো এবং জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করার যৌথ অঙ্গীকার নিয়ে।
উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী হলেও এর ক্ষতি ভোগ করছে মূলত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থাকে—কে কত অর্থ দেবে, এবং সেই অর্থ কোথায় ব্যয় হবে।
বাংলাদেশের বার্তা স্পষ্ট—অর্থ সেখানে দিতে হবে, যেখানে মানুষ ঘরবাড়ি, ফসল, সংস্কৃতি এমনকি বেঁচে থাকার স্বপ্নও হারিয়ে ফেলেছে।
বাংলাদেশের অবস্থান ও দাবি
বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি ও ৩৬টি জাতীয়–আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথভাবে প্রস্তুত করা পজিশন পেপারে মূল দাবি হিসেবে উঠে এসেছে,
উন্নত দেশগুলোকে প্রতি বছর প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলার বাস্তবায়ন এবং আগের ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
নতুন লক্ষ্য স্থির করতে হবে—২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার, যা হবে ঋণ নয়, অনুদান ভিত্তিক।
মোট অর্থের ৫০ শতাংশ অভিযোজনের জন্য এবং ২০ শতাংশ UNFCCC তহবিলের (GCF, LDCF) মাধ্যমে দিতে হবে।
দ্রুত কার্যকর করতে হবে Loss and Damage Fund, যাতে অর্থ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাতে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি শুধু অর্থনৈতিক নয়—এটি মানুষের মানসিক যন্ত্রণা, সংস্কৃতির ক্ষয় ও হারিয়ে যাওয়া জীবনের স্মৃতির সমষ্টি।

ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর চাই
জীবাশ্ম জ্বালানির যুগ শেষ হবে—কিন্তু সেই রূপান্তর হতে হবে ন্যায়সঙ্গত।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো অনেকাংশে তেল, কয়লা ও এলএনজির ওপর নির্ভরশীল, তবে নবায়নযোগ্য শক্তির বিপুল সম্ভাবনাও রয়েছে।
বাংলাদেশ চায়—
- কেউ যেন রূপান্তরে পিছিয়ে না পড়ে,
- শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ হোক,
- নারীর অংশগ্রহণ বাড়ুক,
- তরুণদের জন্য সৃষ্টি হোক সবুজ চাকরি ।
নারী, তরুণ ও কৃষকের ভূমিকা
বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট, নারীরা ভুক্তভোগী নন, সমাধানের চালিকাশক্তি।
তরুণদের জন্য প্রয়োজন গ্রিন জবস্, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং নীতিনির্ধারণে সক্রিয় প্রতিনিধিত্ব।
একই সঙ্গে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তি স্থানান্তর বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ, যাতে জলবায়ু–সহনশীল কৃষি পদ্ধতি প্রসারিত হয়।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এশিয়া
এশিয়া এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় আঘাতের মুখে। চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোও এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
কিন্তু বাংলাদেশের পার্থক্য হলো—অর্থনৈতিক সামর্থ্য কম হলেও টিকে আছে সহনশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতার জোরে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বাড়ছে, ফসল নষ্ট হচ্ছে, আর প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত হচ্ছে লাখো মানুষ। এই দুর্দশা শুধু বাংলাদেশের নয়—সমগ্র বৈশ্বিক দক্ষিণের কণ্ঠস্বর।
নতুন তহবিল ও কাঠামোর প্রস্তাব
বাংলাদেশ চায়:
জলবায়ু তহবিলের অন্তত ৭০ শতাংশ অনুদান ভিত্তিক হোক,
উন্নত দেশগুলোকে বাধ্যতামূলক অবদান ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে,
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে হবে, যাতে দুর্বল দেশগুলো সহজে প্রবেশাধিকার পায়।
বাংলাদেশ প্রস্তাব করেছে নতুন একটি তহবিল—Solidarity Fund, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির অধিকার একসঙ্গে স্বীকৃতি পাবে।
আমাদের কথা শুনুন
বাংলাদেশজুড়ে আয়োজিত ২৬টি আঞ্চলিক সংলাপে সাধারণ মানুষ এক কণ্ঠে বলেছে,
আমাদের কথা শুনুন।
তাদের দাবি-লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড দ্রুত চালু হোক, অর্থ সরাসরি স্থানীয়দের হাতে পৌঁছাক, এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের অভিজ্ঞতা বৈশ্বিক আলোচনায় প্রতিফলিত হোক।
শেষ কথা
বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট
আমরা শুধু জলবায়ুর শিকার নই, আমরা সমাধানের অংশ।
আমরা এমন এক পৃথিবী চাই, যেখানে থাকবে ন্যায়, দায়িত্ব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই আশা।
কপ–৩০–এর এই বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের কণ্ঠ তাই এক আহ্বান-
বিশ্ব, আমাদের কথা এবার সত্যিই শুনুন।














