স্মরণ : প্রবাল চৌধুরী সুরের ধ্রুবতারা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা

- আপডেট সময় : ১১:২৯:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ৩৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলা গানের উজ্জ্বল নক্ষত্র, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবাল চৌধুরী— সুর ও দেশপ্রেমে যিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য নাম
দেশপ্রেম, আবেগ আর সুরের মিশেলে বাংলা আধুনিক গানে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী
আমিনুল হক ভূইয়া, ঢাকা
বাংলা গানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবাল চৌধুরী ২০০৯ সালের ১৬ অক্টোবর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। মাত্র দুই দিন আগে, ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্রে গান পরিবেশনের সময় তিনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। সেই ক্ষণেই যেন নিভে গিয়েছিল এক সুরের প্রদীপ, যে আলোয় উজ্জ্বল ছিল বাংলা সঙ্গীতের আকাশ।
তাকে বাংলাদেশের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলা হতো— গভীর, সুরভিত কণ্ঠে তিনি মুগ্ধ করতেন শ্রোতাকে।
১৯৪৭ সালের ২৫ আগস্ট চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ দেওয়ানজী পুকুর লেনে জন্মগ্রহণ করেন প্রবাল চৌধুরী। পিতা প্রকৌশলী মনমোহন চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক, মাতা লীলাবতী চৌধুরী ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগীতজ্ঞ। তাদের পৈতৃক নিবাস রাউজানের বিনাজুরি গ্রামে।
বড় বোন কল্যাণী ঘোষ ও ছোট বোন উমা খানসহ তিন ভাইবোনই ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী। পরিবারের প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এমন এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠায় প্রবাল শৈশব থেকেই গান, নাচ ও অভিনয়ের অনুশীলনে বড় হয়েছেন।

শৈশবে তিনি পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের সেন্ট মেরী’স স্কুল, সেন্ট প্লাডিস হাইস্কুল ও মিউনিসিপাল হাইস্কুলে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রায়ই ডাবল প্রমোশন পেতেন। পরে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে।
শৈশবে নৃত্যে দক্ষ হলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মনোনিবেশ করেন সঙ্গীতে। প্রথমে সঙ্গীতের পাঠ নেন কলিম শরাফীর কাছে, পরে বোন কল্যাণী ঘোষ, মিহির নন্দী ও নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চৌধুরীর কাছ থেকেও তালিম নেন।
১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ বেতারে তাঁর গান প্রচারিত হয় প্রথমবার। সুর দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ। পরবর্তীতে তিনি মোহনলাল দাস, সুজেয় শ্যাম ও শেখ সাদী খানের সুরেও গান করেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম শ্রুতিমধুর কণ্ঠের শিল্পী।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রবাল চৌধুরী যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। দুই বোনের সঙ্গে তিনি পঞ্চাশটিরও বেশি দেশাত্মবোধক গানে কণ্ঠ দেন, যেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। তিনি শুধু কণ্ঠের মানুষ ছিলেন না, ছিলেন এক শব্দসৈনিক, এক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা।
ভারতে থাকাকালে তিনি অংশ নেন বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা ও বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠীর কার্যক্রমে। রুমা গুহ ঠাকুরতার পরিচালনায় ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের সদস্য হিসেবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

স্বাধীনতার পরও তাঁর সুরের যাত্রা থেমে থাকেনি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের বিশেষ গ্রেডের শিল্পী। ১৯৮৪ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর আমন্ত্রণে তিনি ও তাঁর বোন কল্যাণী ঘোষ আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে সাংস্কৃতিক সফরে যান, যেখানে তাঁরা ব্যাপক সম্মান ও ভালোবাসা লাভ করেন।
তিনি গান গেয়েছেন বিবিসি রেডিও, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী কলকাতা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে-আমি মানুষের মত বাঁচতে চেয়েছি, লোকে যদি মন্দ কয়, চিরদিন সাথী তোমাকেই চাই, এই জীবন তো একদিন চলতে চলতে থেমে যাবে আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে বেঁচে আছে।
প্রবাল চৌধুরী দুই পুত্রের জনক। বড় ছেলে তাপস চৌধুরী সুজন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের সুরকার ও শিল্পী। ছোট ছেলে ডা. রঞ্জন চৌধুরীও সুরকার ও জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন। তাঁর নাতি-নাতনিরাও সঙ্গীত ও তবলার চর্চায় যুক্ত।
চট্টগ্রামের ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন, সাংস্কৃতিক স্বাধীকার আন্দোলন কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র— সব জায়গায় তাঁর পদচিহ্ন রয়েছে। তিনি ছিলেন সেই শিল্পী, যিনি আধুনিক বাংলা গানে হৃদয়ের গভীরতা ও দেশপ্রেমের স্পর্শ এনেছিলেন। তাঁর গলায় ছিল মানবিকতার সুর, মাটির ঘ্রাণ ও ভালোবাসার উষ্ণতা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, শব্দ সৈনিক ও কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী প্রবাল চৌধুরী তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে অর্জন করেছেন অসংখ্য সম্মাননা ও অগণিত মানুষের ভালোবাসা। বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে তিনি চিরকাল থেকে যাবেন, ‘সুরের ধ্রুবতারা’ হয়ে।