হাজার বছর ধরে পথ হাঁটে লীলাময়

- আপডেট সময় : ০৯:৪৮:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৪ ১৭৯০ বার পড়া হয়েছে
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, মালদা পশ্চিমবঙ্গ
মানুষ নাটক করে। আর সেই মানুষই নাটক চায়। শব্দ ব্রহ্ম। ব্রহ্ম শুন্য। শুন্যকে পূর্ণ করে ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেক কোনের অবস্থিতি, যেখানে নানা আবাদ হয় সমাজ জীবন বা সমাজব্যবস্থায় থাকা নানা ফসলের। সে ফসল সবসময় শস্য নয়,যা মানুষের গলদঘরণের নিয়ামক!
বরং বলা ভালো, সেসব ফলন বিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় স্বপ্ন দেখা উচ্চাকাঙ্খী কিছু মানুষকে বাঁধবার এক-একটি তার বা তন্ত্রকৌশল , যা রুল অফ ল! যা পুরোহিত থেকে জমিদার ও বণিক হয়ে গনতন্ত্রের কঠিন তার হয়ে অবশেষে সমাজবাদ বা সমাজতন্ত্র।
একটি নাটক সম্পূর্ণ বা অসম্পূর্ণ বিলাপ কি-না, সেকথা থাক। বরং একটি নাটকে প্রদর্শিত সমগ্রতা বলতে গিয়ে বিবর্তনের খোলা দরজা দিয়ে একের পর এক যখন আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তির কথা আসে, তখনই বিবর্তন সম্পূর্ণতা পায়। গত ১৪ই জানুয়ারির সন্ধ্যায় মালদার দুর্গাকিঙ্কর সদনে অনুষ্ঠিত অন্ততপক্ষে ফিনিক্স, দ্ িএক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার প্রযোজিত একটি শক্তিশালী ড্রোনের মতো পর্যবেক্ষণকারী দলের উপস্থাপনা “লীলাময়” দেখে তাই-ই মনে হোলো। আমি অন্ততপক্ষে বিশ্বাস করি যে, সেক্সপিয়রের কিং লিয়রের ছায়া অবলম্বনে লিখিত “লীলাময়” নাটকটিকে দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবার পরে অনেকের-ই সেকথা-ই মনে হবে ।
শেক্সপিয়রকে গুলে খেয়ে ফেলা একজন মানুষের সারাজীবনের কাজ না হলেও,তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ নিবেদিত লেখ্যরূপকে নতুনভাবে এবং সমাজের দাবিমতো উপস্থাপন করা নাটকের প্রথম শর্ত থাকবে,এবং এটাই সর্বশেষ এডিট হওয়া উচিৎ বলে মনে হয়। আর, সেদিক থেকে নাট্যকার /পরিচালক অনুরাধা কুন্ডার একটি অনবদ্য প্রয়াস “লীলাময়” নাটকটি নাটকের সমস্ত শর্তকে শর্তহীনতার বাইরে বয়ে নিয়ে গিয়ে সমাজকথনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে এক সুচারু শিল্পভাবনার জলমগ্ন দ্বীপ থেকে দীপ্ত এক আলোকিত পথের আনন্দের দিকে।
এবারে নামকরণ নিয়ে কথা বলা যাক। নাটকটির নাম “লীলাময়”। এই লীলাময়’রা হাজার হাজার বছর ধরে পথ হাঁটেন গঞ্জ থেকে মহকুমা হয়ে সদর রাজ্য হয়ে দেশদেশান্তরের পথে পথে। ‘লীলা’- আসলে ব্যক্তির মনের অভ্যন্তরে লীন হয়ে থাকা চেতনার নানা স্তর। সে স্তরের পরতে পরতে জমতে জমতে পুরনো দিনের কথা অভ্যন্তরে জমা থাকলেও শিল্পের জলাভূমির চারপাশে জেগে ওঠে নব্যরূপে নয়াচর। সে চরে লোভ লালসার হাত ধরে উড়ে আসে কামনাবাসনায় মাখামাখি নানা রংএর বসন্তবৌড়ি নামক কামনার পাখি।
আমাদের লীলাময় এক্কেবারে বিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার প্রথম ধাপ থেকে উঠে আসা একজন শিল্পকর্মী স্বরূপ তেমনই এক পাখি, যিনি তার ব্রহ্মাস্ত্র শব্দ দিয়ে একদিন একের পর এক গেঁথেছেন শব্দমালায় সুসজ্জিত নানা গল্প উপন্যাস, যা তাকে খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছে দিয়ে ” লীলাময়” করে তুলেছিল। তা, এ হেনো লীলাময় সেই চূড়ান্ততার আনন্দ একদিন মেনে নিয়েও,উপভোগ করেও এরপরের চূড়ান্তে আবারও পৌঁছাতে চেয়েছেন!
স্বভাবতই, তার এই জয়যাত্রাপথে স্ত্রী বিহীন সংসারের অন্দরে আপন দুই দুহিতার মধ্যে অনিবার্যক্রমে এসেছে দ্বন্দ্বের ক্লাইম্যাক্স। পুরুষানুক্রমিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া ভালো থাকার তকমা স্বরূপ এসেছে বড় কন্যা রাশি’র অভিনয় গুনে অস্বাভাবিক ঠান্ডা হিমশীতল শৈত্য আচরণ, যার আর এক নাম প্রেমহীন নির্লিপ্তির অন্তরালে জমে থাকা এক কঠিন বরফ। সে বরফ গলে না। বরং প্রকৃতির বিরূপতায় বরফের গলন ঘটে, যা প্লাবন ঘটায়। ( পাঠক, দর্শক শেষপর্যন্ত সেই প্লাবনে ভাসবেই ভাসবে,এ আশা রাখি।) ছোটো কন্যা খুশি একজন গানপাগল শিল্পী। মাএ-র মৃত্যুর সময়ের ছোট্ট খুশি একসময়ে বড় হয়। তার নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়। সে ভাষা স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে গড়া দেশের মান্যতা প্রাপ্ত সমকামি ও স্বেচ্ছাধীন থাকা, যা প্রকৃতিবিরুদ্ধ হলেও ভালোবাসা বিরুদ্ধ নয় মোটেই!

আমাদের লীলাময়ের হাজার হাজার বছরের হেঁটে চলা পথে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে লোভকে আঁকড়ে ধরে থাকা সমাজজীবনের ভোটের লড়াই এ-র ডাক। সে ডাক লীলাময়কে পাশবিকতার নাগ পাশে জড়িয়ে ধরে। যার থেকে ছিটকে ভেঙে পরে শীতার্ত সন্ধ্যার পথে রক্তে আঁকা গরম কফির কাপ। এক সময়ে অহঙ্কারি এক বাবার(লীলাময়)দ্বারা বড় কন্যা রাশিকে সর্বস্ব লিখে দেওয়া ও ছোটো কন্যা খুশিকে ( যে নাম আনন্দের পরিচায়ক) বঞ্চিত করার পরের পর্বে সর্বহারার এক অন্য উন্মাদ এ-র সাথে স্থান হয় রাস্তায়। আসলে উন্মাদ বা পাগল এক প্রান্তজন। সেও এই সমাজেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও অবশেষে পরিত্যক্ত কালের বাঁধা নিয়মে এমন এক অদ্ভুত আঁধারগামী,যে আঁধার আরও এক লীলার জন্ম দেয়।
সেদিক থেকে একই পথগামী দুই লীলাময় এক্কেবারে বৃহত্তর লীলাভূমিতে একীভূত হয়ে মিশে যায়। (অদ্ভুত সেই পাগলের ভাবের আধারে থাকা কলালক্ষ্মীর অভিশাপদুষ্ট লীলাময়ের অবশেষটা অবশ্যই অবশেষ, যা অকৃত্রিম, অনিবার্য এবং পৃথিবীর দেশে দেশে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সব উত্তর!) অর্থাৎ সর্বনাম, সর্বকামনা, সর্বধর্মসাধনার ধারণা সমাজবাদই টিকবে এবং টিকে থাকবে “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয়না ” – নামক পল রবশনএ-রা। আর, এরই সাথে মিশে থাকা জন হেনরির সেই হাতুড়ির ঘা, যা দিয়ে ভাঙা যায় প্রাসাদপম আবাসস্থল সহ পূর্বপুরুষদের আত্মার স্মৃতির সারণীতে জমে থাকা নথিপত্র। সেও এক নয়া কলাকৌশলের জয়যাত্রার ধ্বনি ।
শুরুতে আলোকোজ্জ্বল দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত বাঙালির লোকসংস্কৃতিস্বরূপ লক্ষীপূজা (আসলে ধর্মব্যবসার আড়ালে থাকা মোহময় রাষ্ট্রব্যাবস্থার হাতছানি) ভীষণভাবে নজরে পড়ে। কিং লিয়রের ছত্রছায়ার মায়ায় জড়িয়ে লীলামত্তা দেখাতেই পুরোহিত তন্ত্র থেকে একে একে ধর্মের হাত ধরে একটা অবশেষে পৌঁছাতে সক্ষম হন পরিচালক/নির্দেশক অনুরাধা কুন্ডা, যখন লীলাময়ের একে একে হারিয়ে যাওয়া সবকিছুই (তার পুরনো ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনার রূপকেরা) নেমে আসে সেই রাস্তায়, যে রাস্তা সর্বহারা নামক সর্বজনের।
আলোক সম্পাত থেকে শব্দ প্রেক্ষণ হয়ে অনুষঙ্গের সংগীত সহ নাটকের যাবতীয় যা বলার, তা হোলো লীলাময়ের হাজার হাজার বছরের হেঁটে চলা পথের চারপাশের আঁকা দৃশ্যপট, যা আসলে দৃশ্য দিয়ে অঙ্কিত সমাজ জীবনের মৌলিক বাস্তবতায় জমে ওঠা একটি নাটকের মতো নাটক!
এরপরেও ‘এরপর ‘থেকে বেরোতে হবে। আর সেটা হোলো পরিসমাপ্তি দেখবার আশায় যখন দর্শক শুনতে পায় দর্শকাসনে আসীন কিছু সামাজিক মানুষের মন্তব্য। সে মন্তব্য যেমন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের।আবার সে মন্তব্যে উঠে আসে রাজনীতিবিদের কন্ঠে – ‘আমাদেরও পরিবার হারানো জীবনের প্রান্তদেশে এসে এ দশা( লীলাময় হয়ে ওঠা) হয়তো হবে!’
লীলাময় এ-র চরিত্রে অর্ক, রাশির চরিত্রে মৌমিতা ও খুশির চরিত্রে অনুরাধা কুন্ডার এবং পাগলের ভূমিকায় আগ্নিকের অভিনয় মনে দাগ কেটে যায়। আর সর্বপরি একজন লিখিয়ে হিসেবে যা বলার তা হোলো এমন নাটক কেবল একটি ছোটো শহরেই সীমাবদ্ধ না থেকে বিরামহীনভাবে ছড়িয়ে পড়া দরকার আর-ও বৃহত্তরভাবে উপমহাদেশ থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে।