প্রজননকালীন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পদ্মা পারে প্রকাশ্যে ইলিশ বিক্রির হাট!

- আপডেট সময় : ০৪:৫৪:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫ ৭১ বার পড়া হয়েছে
আমিনুল হক ভূইয়া
‘বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ’ একসময় নদীভরা সোনালি আশার প্রতীক ছিল। এখন সেই ইলিশের প্রাচুর্য যেন অতীত স্মৃতি। গত দুই বছর ধরে নদীতে ইলিশের দেখা মেলে না বললেই চলে। জেলেরা নদীতে জাল ফেলেও ফিরছেন খালি হাতে, বাজারে দাম ছুঁয়েছে আকাশ, আর ভোক্তাদের মনে জমেছে হতাশা। প্রশ্ন উঠেছে ইলিশের বাড়ি বাংলাদেশ অথচ কেন ইলিশই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই দেশ থেকে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশের প্রজনন ও চলাচলের স্বাভাবিক পথ আজ বিপর্যস্ত। পদ্মা, মেঘনা ও কলাবদরসহ বিভিন্ন নদীতে অসংখ্য চর ও ডুবোচরের কারণে ইলিশের উজানে ওঠা ব্যাহত হচ্ছে। নদীখনন ও নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতিতে ইলিশের প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংস হচ্ছে দ্রুত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের লোভ, অপরিণত জাটকা ও মা ইলিশ নির্বিচারে শিকার, যা ইলিশের জীবনচক্রকেই বিপন্ন করে তুলছে।
ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে প্রতি বছর অক্টোবরের শুরু থেকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই সময়ে নদীতে সব ধরনের মাছ ধরা, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ। তবুও রাজবাড়ীর পাংশা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত পদ্মার ৫৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে প্রকাশ্যে মা ইলিশ শিকার। নৌ-পুলিশ ও প্রভাবশালী মহলের ‘নীরব ভূমিকা’য় নদীতে চলছে মাছ ধরার উৎসব।

রাজবাড়ী মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, ৪ অক্টোবর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ১৮ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার মিটার জাল ও ৫২ কেজি ইলিশ। তবে এসব অভিযানও অবৈধ মাছ শিকার ঠেকাতে পারছে না। নদীর পাড়ে বসছে অস্থায়ী হাট, যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা ছুটে আসছেন সস্তায় ইলিশ কিনতে।
বাংলাদেশ কৃষি ঐক্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি সাহাবুদ্দিন ফরায়জি বলেন, নদীতে নৌ-পুলিশের পরিবর্তে কোস্ট গার্ডের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, নৌ-পুলিশের অনিয়ম ও দমনমূলক আচরণে সাধারণ জেলেরা ক্ষুব্ধ।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় নৌ-পুলিশই জাটকা ও মা ইলিশ ধ্বংসে নীরব ইন্ধন দেয়। তারা নদীতে অভিযান চালিয়ে মামলা ও হয়রানির মাধ্যমে সাধারণ জেলেদের নির্যাতন করে থাকে।
একই সুরে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির ভোলা জেলা সাধারণ সম্পাদক মামুন শেখ বলেন, নদীর আজরাইল নৌ-পুলিশ। তারা টাকার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞার সময় চোরা শিকার চালাতে দেয়। তিনি নৌ-পুলিশের অপকর্মের বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার জানিয়েছেন, “মা ইলিশ রক্ষায় প্রতিদিনই অভিযান চলছে। প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। তবে বাস্তবে এসব অভিযান প্রভাবশালীদের কবজে সীমিত। জেলেরা অভিযোগ করেছেন, প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়ে না, বরং ক্ষুদ্র জেলেদেরই হয়রানি করা হয়।
ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান মনে করেন, ইলিশের প্রজননকালে নদীতে ডুবোচর, দূষণ ও জালের অতিব্যবহার তাদের প্রাকৃতিক অভিবাসন রোধ করছে। সাগর থেকে প্রায় ১,২০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ইলিশ যখন পদ্মা-মেঘনায় ডিম ছাড়তে আসে, তখন তাদের নিশ্চিন্তে প্রজননের সুযোগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়—এটি বাংলাদেশের মানুষের জীবিকা, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির প্রতীক। একে রক্ষা করতে হবে সম্মিলিতভাবে। প্রশাসন, রাজনীতি ও জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সম্পদ টিকবে না।
প্রতি বছরই ইলিশ আহরণের পরিমাণ কমছে, অথচ নিষিদ্ধকালীন চোরা শিকার বেড়েই চলেছে। নদীতে প্রভাবশালীর দখল, দূষণ, নৌযান চলাচল এবং প্রশাসনিক শৈথিল্য সব মিলিয়ে ইলিশ এখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছের ভান্ডার রক্ষায় এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন এবং জেলে সম্প্রদায়ের আস্থার পরিবেশ। না হলে, অচিরেই ইলিশের ভরা মৌসুম কেবল স্মৃতিচারণের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।