তামাক ব্যবহারে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের প্রাণহানি

- আপডেট সময় : ০৪:০৩:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫ ৮৪ বার পড়া হয়েছে

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সাধারণ সম্পাদক মইনুল হাসান সোহেল
প্রকাশ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, জনস্বাস্থ্যের জন্য বিশাল হুমকি
৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে থাকে
কর্মস্থলে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠির ৪২.৭শতাংশ (৮১ লক্ষ) ধূমপানের শিকার হন
তামাক শুধু একজন ব্যবহারকারীর সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সংকট
আমিনুল হক ভূইয়া
বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে প্রাণ হারান প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। গবেষণা অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সরাসরি তামাক সেবন করে, যা অসংক্রামক রোগের হার বাড়িয়ে তুলছে। ধূমপান ও চর্বিত তামাক, উভয়ই হৃদরোগ, ক্যান্সার ও শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার প্রধান কারণ। তামাকজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতিও কম নয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেই কেবল এই মারাত্মক অভ্যাস থেকে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব।
বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি (৩৫ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। আচ্ছাদিত কর্মস্থলে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠির ৪২.৭ শতাংশ (৮১ লক্ষ) পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। ঢাকার আশেপাশে প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯২ শতাংশ শিশুর মুখের লালায় উচ্চমাত্রায় নিকোটিন পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে করোনা মহামারীতে অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ী রোগীদের মৃত্যুর হার ৩গুণ বেশি ছিলো। তামাক ব্যবহারজনিত ক্ষতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, হৃদরোগ, ক্যানসার এবং শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন অসুখের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাকে রয়েছে ৭০০০ কেমিক্যাল। যার মধ্যে কমপক্ষে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী (সিডিসি, আমেরিকা ২০১৭)।
বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে তামাক ব্যবহারের হার এখনো উদ্বেগজনকভাবে বেশি। প্রকাশ্যে তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। গবেষণা বলছে, তামাকজাত পণ্যের বহুল ব্যবহার শুধুমাত্র ব্যবহারকারীর নয়, আশপাশের অধূমপায়ী মানুষদের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
প্রকাশ্য তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আজ এ ক্ষেত্রে নীরব থাকলে আগামী প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষকে শুধু রোগ ও অর্থনৈতিক সংকটে নয়, বেঁচে থাকার অধিকারকেও হুমকিতে ফেলব। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আইন প্রয়োগ, কর বৃদ্ধি, দ্রুত ও সমন্বিতভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে সার্বজনীন শত্রু আমাদের স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি উভয়েরই বড় শত্রু হয়ে উঠবে।

‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন:এফসিটিসি অনুচ্ছেদ ৫.৩ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সাধারণ সম্পাদক মইনুল হাসান সোহেল একথা বলেন।
সংগঠনের সভাপতি রাশেদ রাব্বি ও জান্নাতুল বাকেয়া কেকাপ্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এই আয়োজনের মূল বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রফেসর সোহেল রেজা চৌধুরী।
মইনুল হাসান সোহেল বলেন, প্যাসিভ স্মোকার তথা অধূমপায়ী ব্যক্তিরা কারো ধূমপানের ধোঁয়া থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া অনিচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করা এবং পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসার ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতার ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় প্রতি বছর সরকার ও জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়। কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, অকাল মৃত্যু ও দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার কারণে জাতীয় উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তামাক ব্যবহারের ফলে মানবদেহে যেসব প্রভাব পড়ে তারমধ্যে ক্যান্সার, হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। গর্ভবতী নারীর তামাক গ্রহণ বা ধূমপানের ধোঁয়ায় সংস্পর্শে আসা গর্ভস্থ শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে রাজস্ব ক্ষতির যে যুক্তি দেওয়া হয়, তা একপাক্ষিক, বিভ্রান্তিকর এবং জনস্বাস্থ্যবিরোধী। একটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য নাগরিকের স্বাস্থ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, অর্থ নয়। নিম্নমানের তামাকজাত পণ্যের বিস্তার যেমন-জর্দা, গুল, বিড়ি, খৈনি ও অন্যান্য ধোঁয়াহীন তামাকজাত পণ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিম্নমানের ও অস্বাস্থ্যকর উপাদানে তৈরি। এসব পণ্য সাধারণত নিম্নআয়ের মানুষ বেশি ব্যবহার করেন, ফলে তারা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎপাদিত এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই।

রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, হাটবাজার, এমনকি সরকারি অফিসেও প্রকাশ্যে ধূমপান অহরহ দেখা যায়। শিশুরা অনায়াসে এসব দৃশ্যের সম্মুখীন হচ্ছে, যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও তামাক গ্রহণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। প্রকাশ্যে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা ও আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ। ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। তামাক শুধু একজন ব্যবহারকারীর সমস্যা নয়, এটি জাতীয় স্বাস্থ্য সংকট। তামাক আগ্রাসন রুখতে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না হলে, আগামী দিনে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত আরও চাপের মুখে পড়বে। তামাকমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তামাক শুধু একটি ব্যক্তিগত অভ্যাস নয়, এটি জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়। দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামাক-জনিত কারণে প্রতিবছর প্রতিবছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন মানুষ প্যাসিভ স্মোকের কারণে অর্থাৎ যারা ধূমপান করেন না, তারা তামাকের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে। তামাক ব্যবহারের ফলে শুধু স্বাস্থ্যব্যয়ই নয়, উৎপাদন সক্ষমতা হারানো শ্রমশক্তি ও বিকল্প ব্যয় মিলিয়ে অর্থনীতিতে বিপুল ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, তামাক-সংক্রান্ত চিকিৎসা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস মিলিয়ে দেশগুলোর গড় অর্থনীতিতে প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার বা জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সীদের প্রায় ৩,৯৩ মিলিয়ন (৩৯.২৯ মিলিয়ন) মানুষ তামাক ব্যবহার করেন, যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০৯-২০২২ ১৩ বছরে তামাকব্যবহার কমেছে মাত্র ১৩ শতাংশ। বাংলাদেশে তামাক-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ক্ষতি বছরের প্রায় ৮৬৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার।