ভয়েস ডিজিটাল ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা
প্রায় বছর ধরেই ভাষানচরে একলাখ রোহিঙ্গা বসবাস করার স্থাপনা তৈরি অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তরিত করা সম্ভব হচ্ছেনা। কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকার প্রায় ৩৪ শিবিরে ১১ রাখের বেশি মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের মানবদরদী তথা ‘মার অব হিউম্যানেটি’ খ্যাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রতিনিয়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। অলস জীবন কাঠানো এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একটা অংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক, চোরাচালান এমন কি অপরহণের অপরাধ করতেও তারা কসুর করছে না। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তথ্য মদে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একাধিক ডাকাত দল সংগঠিত হয়েছে। তারা স্থানীয় অধিবাসীদের অপহরন করে গভীর অরণ্যে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে। অনেককে হত্যা করেছে।
অম্পানের পর বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, আম্পানের মতো মারাত্মক দুর্যোগেও ভাষাণচরে জলোচ্ছ্বাস হয়নি। এমনকি কোন ক্ষতিও হয়নি। সেখানে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য পরিকল্পিত বাসস্থান তৈরি করা হয়েছে। ভাষাণচরে যেসব রোহিঙ্গা যাবেন, তাদের দিনবদলের কথা ওঠে এসেছিলো ড. মোমেনের ভাষায়। তিনি বলেছিলেন, সেখানে অচেল খোলা জায়গা রয়েছে। গোবাদি পশুর লালন-পালন এবং মৎস্য শিকার করেও এসব রোহিঙ্গারা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে। তাই শিগগিরই রোহিঙ্গাদের ভাষাণচরে স্থানান্তর করবে সরকার।
বিদেশমন্ত্রীর সেই বক্তব্যের রেশ টেনেই বিদেশ সচিব মাসুদ বিন মোমেন সোমবার ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, বর্ষা মৌসুমের পরই রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে ভাষাণচরে পাঠানো হবে। তাতে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় অনেকটা চাপ কমবে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মায়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সেনাবাহিনীসহ স্থানীয় জনতা অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে গ্রামের পর গ্রাম জ¦ালিয়ে দেওয়ার সচিত্র দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমে ওঠে এসেছে। মায়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বহাল থাকায় রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশ-মায়ানমারের মধ্যে সমঝোতা স্বারক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
২০১৭ সাল ধরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: পশ্চিমা, এশীয় ও দ্বিপক্ষীয় প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক অনলাইন ভিত্তিক সেমিনারের আয়োজন করে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিদেশ সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। ইতিমধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা ৩০৬ জন রোহিঙ্গা এখন ভাসানচরে ভালোই আছেন। শিগগিরই তাঁদের স্বজন এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের একটি দলকে ভাসানচরে পাঠানো হবে। তাঁরা যদি দেখেন যে কক্সবাজারে গাদাগাদি করে থাকার চেয়ে সেখানকার পরিস্থিতি ভালো। তবে আমরা প্রাথমিক দলটিকে বর্ষা মৌসুমের শেষে পাঠানোর আশা করছি। জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলেরও সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি দেখানোর জন্য আমরা মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও পাঠানোর আয়োজন করতে পারি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় মায়ানমারের ওপর দোষারোপ করে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে মায়ানমার ন্যূনতম রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বরং আমাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ব্যাপারে তাদের মধ্যে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরাতে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলোর পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। কারণ, এতে রোহিঙ্গারা দলে দলে আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উৎসাহিত হবে। তবে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গারা যেন জীবন-জীবিকা অর্জন করতে পারে, সে জন্য ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মায়ানমারের কারিকুলামে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়ার সাবেক বিদেশ মন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবার বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু মানবিক সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। রোহিঙ্গা সমস্যার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার ওপর পড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসিয়ানের কয়েকটি সদস্যদেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনলেও ওই সংস্থার এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। মায়ানমার আসিয়ানের সদস্য। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আসিয়ান চরম অনীহা দেখিয়েছে। আর আসিয়ান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে মায়ানমার যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে।
হামিদ আলবার বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে এই সংকটের সমাধানে ভারতও ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অচলাবস্থা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া রাখাইনে নিরাপত্তা অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পুনরায় জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে।