ঢাকা ০৪:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাইমন ড্রিংয়ের বর্ণনায় একাত্তরের গণহত্যা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:৩০:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২০ ৪৫৪ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

নাফিস আহমেদ

অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর সেনারা ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে খুন করেছে সাধারণ মানুষদের। ১৯৭১-এর মার্চে ঢাকায় নিজের অভিজ্ঞতা এভাবেই ব্যক্ত করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন জন ড্রিং। তিনি আজও ভুলতে পারেননি ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা। পাক-সাঁজোয়া বাহিনী কীভাবে ঢাকাসহ গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে ঠাণ্ডা মাথায় মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছিল সেটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। ড্রিং নিজেই এক রাতে ৭ হাজার মানুষ জবাইয়ের ঘটনার সাক্ষী। নৃশংসতার মাধ্যমে পাকিস্তান একটি দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পাক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীর কাছে গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন ঢাকার প্রকৃত ছবিটা। কিন্তু ড্রিং সাহসিকতার সঙ্গে সেদিন তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানি বর্বরতার ছবি। তার লেখায় উঠে আসে গণহত্যার বিবরণ।

বহু আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত ড্রিং তার ব্লগে লিখেছেন সেদিনের ভয়ংকর অত্যাচারের বিবরণ। গোটা শহরকে মৃত্যুনগরী বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় পাকসেনা। চলতে থাকে অবাধে লুটতরাজ। বিন্দুমাত্র আপত্তি জানালেই স্থানীয়দের জবাই করাই ছিল পাকসেনাদের একমাত্র কর্তব্য। তারা ইচ্ছামতো বাঙালিদের খুন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য নৃশংসতার চরম সীমায় পৌঁছে পাকিস্তানি বর্বরতা। এ প্রথিতযশা ব্রিটিশ সাংবাদিক মনে করেন, গণহত্যায় নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব।

কারণ ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর শহরেই ১৫ হাজারের বেশি মানুষ এক রাতে নিহত হয়েছেন। তার মতে, সেনা সন্ত্রাসের বহর দেখলেই কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে কত মানুষ প্রাণ দিয়েছেন একাত্তরে। তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা নিজের বিছানায় লাশ হয়ে পড়েছেন। দোকানদারদের জবাই করা হয়েছে বাজারের মধ্যেই। নারী ও শিশুদের তাদের ঘরেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। হিন্দুদের দলবেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে লাইন দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারপর পাকসেনারাই পুড়িয়ে দিয়েছে সব লাশ। ঢাকায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে পাক পতাকা ওড়াতে বাধ্য করেছে পাকসেনারা।

সমর বিশেষজ্ঞ এ সাংবাদিকের লেখায় উঠে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথাও। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি জেলে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাদেরও ভরা হয় জেলে। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণের মাঝেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অগণিত মানুষ মুক্তির সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকসেনা হতাহতের কোনো তথ্য অবশ্য তুলে ধরতে পারেননি ড্রিং। তবে পাকিস্তানি এক সেনাকর্তা ছাড়া দুই জওয়ানকে যে মুক্তিযোদ্ধারা ঘায়েল করতে পেরেছিলেন সেটিও তিনি উল্লেখ করেন। মূলত তার স্মৃতিচারণায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে পাক বর্বরতার ছবি। গণমাধ্যমও সেনা হামলার হাত থেকে বাঁচেনি। দুটি সংবাদপত্র অফিস গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে খুন করা হয়।
সাইমন ড্রিংয়ের বিবরণ অনুযায়ী, পাকসেনারা ঢাকায় সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ছাত্রদের ওপর। পদাতিক, সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ এ তিন পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ান রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা আক্রমণে। শুরু হয় গোলাবর্ষণ। নির্মম অত্যাচারে মেতে ওঠে পাকসেনারা। বঙ্গবন্ধুকে আগেই টেলিফোনে সতর্ক করা হয়েছিল। তাকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেয়া হলেও তিনি তা করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা শহরকে তছনছ করে ছাড়বে।’

আমেরিকা থেকে আনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম-২৪ ট্যাংক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকসেনাদের হামলার বিবরণও তুলে ধরেছেন ড্রিং। মাঝরাতে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয় শেলিং। ইকবাল হলেই দু’শরও বেশি শিক্ষার্থী মারা যান। ছাত্রদের ওপর মেশিনগান থেকে চলতে থাকে গুলি বৃষ্টি। দু’দিন পরও লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে সেখানে। গণকবর দিয়ে তার উপর চালিয়ে দেয়া হয় ট্যাংক। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই নয়, আশপাশের দু’শ গজ এলাকাজুড়ে চলে সেনা সন্ত্রাস। পাকিস্তানি সেনার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদও। ঢাকা মেডিকেল কলেজেও ব্যাপক গুলিবৃষ্টি হয়। পাক বর্বরতার প্রকৃত ছবি ঘটনার দু’দিন পর বাড়ির বাইরে বের হয়ে ঢাকার মানুষ দেখতে পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই পাকসেনাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ড্রিংয়ের বিবরণ অনুযায়ী, প্রথমে ট্যাংক থেকে শুরু হয় শেলিং। তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ কর্মীদের হত্যা করা হয়। ১ হাজার ১০০ পুলিশকর্মী ছিলেন সেখানে। খুব কমসংখ্যকই সেদিন প্রাণ হাতে পালাতে পেরেছিলেন।

রাজারবাগে পুলিশ লাইনে হামলার সময়ই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকসেনারা। ড্রিং লিখেছেন, রাত ১টা নাগাদ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তার বাড়িতেও হামলা হবে। তাই একজন সহকারী আর দেহরক্ষী বাদে সবাইকে তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে ড্রিং জানতে পারেন, রাত ১টা ১০ মিনিট নাগাদ একটি ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি এসে থামে শেখ সাহেবের বাড়ির সামনে। শুরু হয় গোলাগুলি। তারপর এক সেনাকর্তা বাইরে থেকেই বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে চিৎকার করে ইংরেজিতে বলেন, ‘শেখ তুমি নিচে নেমে আসো।’ বঙ্গবন্ধুও তার ব্যালকনি থেকে জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, আমি আসছি। তবে গোলাগুলির কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরা ফোন করলেই আমি চলে যেতাম।’ তারপর সেই অফিসার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বাগানে প্রবেশ করে বলেন, ‘ইউ আর অ্যারেস্টেড।’ বঙ্গবন্ধুকে তার তিন সহকারী, দেহরক্ষী ও সহযোগীর সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেহরক্ষীকে প্রচুর মারধরও করে জওয়ানরা। বঙ্গবন্ধুকে সেনা সদরে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর চলতে থাকে ব্যাপক লুটপাট। নথিপত্র থেকে শুরু করে বহু জিনিস তছনছ করে দেয় তারা। বাড়ির লাল-সবুজ পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়।

অপারেশন সার্চ লাইটের রাতে ২টার মধ্যেই গোটা শহর জ্বলতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের খুন করেও সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধারের পাশাপাশি লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের হত্যায় মেতে ওঠে সেনারা। এমনটাই উঠে এসেছে ড্রিংয়ের লেখায়। রাতভর নৃশংসতার পর ভোর হয়। কিন্তু ঢাকা থেকে মৃত্যু মিছিল থামার কোনো লক্ষণ ছিল না। দুপুরের দিকে আচমকাই সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা শুরু হয় পুরান ঢাকায়। ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নিয়ার বাজার, সিটি বাজার ইত্যাদি এলাকায় মানুষ পালানোর পথ পাননি। দু’ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৭০০ মানুষকে পাকসেনারা হত্যা করে বলে লিখেছেন ড্রিং। অনেককেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। পুরান ঢাকার থানাও রেহাই পায়নি। ড্রিং লিখেছেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর জানিয়েছেন, তার সঙ্গে ২৪০ জন স্টাফ ছিলেন; কিন্তু শুধু ৩০ জনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। সেনা জওয়ানরাই পেট্রলের ড্রাম নিয়ে ঘুরছিলেন। কোথাও কামান দিয়ে, কোথাওবা পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঘর। রাজাকার আর আল-বদররাই চিনিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি।

ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শিল্পাঞ্চল টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে সেনাদের লক্ষ্য। ২৬ মার্চ রাতের মধ্যে ঢাকা শহরে সেনা আক্রমণের ঝাঁজ কমতে থাকে। কিন্তু বামপন্থী শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেয়ায় শিল্পাঞ্চলে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে সেটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাকসেনারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাক নৃশংসতার বিবরণ উঠে এসেছে তার লেখায়। একইসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন সেদিন। অসহায় মানুষের কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। সাইমন ড্রিং নিজেই সেসময়ে সাহস করে বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ ঘুরে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। সেটাই তুলে ধরেছেন নিজের লেখায়। তিনি নিজের কানে শুনেছেন, পাকসেনারা আল্লাহর নামে বা অখণ্ড পাকিস্তানের নামে মানুষ খুন করছে। তাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বহু মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় পালাতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছেন; কেউ পারেননি। গণহত্যার শিকার হয়েছেন তারা।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ঠাণ্ডা মাথায় কামানের গোলা দিয়ে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান; পারেননি। সেনা দিয়ে নয়, মানুষের গণসমর্থনেই জন্ম নিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ভারত তাদের সেই সংগ্রামে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে। সঙ্গ দিয়েছেন ভারতীয় সেনা ও জনগণ। যুগান্তরের সৌজন্যে
নাফিস আহমেদ : সাংবাদিক ও লেখক

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

সাইমন ড্রিংয়ের বর্ণনায় একাত্তরের গণহত্যা

আপডেট সময় : ০২:৩০:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২০

নাফিস আহমেদ

অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর সেনারা ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে খুন করেছে সাধারণ মানুষদের। ১৯৭১-এর মার্চে ঢাকায় নিজের অভিজ্ঞতা এভাবেই ব্যক্ত করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন জন ড্রিং। তিনি আজও ভুলতে পারেননি ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা। পাক-সাঁজোয়া বাহিনী কীভাবে ঢাকাসহ গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে ঠাণ্ডা মাথায় মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছিল সেটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। ড্রিং নিজেই এক রাতে ৭ হাজার মানুষ জবাইয়ের ঘটনার সাক্ষী। নৃশংসতার মাধ্যমে পাকিস্তান একটি দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পাক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীর কাছে গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন ঢাকার প্রকৃত ছবিটা। কিন্তু ড্রিং সাহসিকতার সঙ্গে সেদিন তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানি বর্বরতার ছবি। তার লেখায় উঠে আসে গণহত্যার বিবরণ।

বহু আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত ড্রিং তার ব্লগে লিখেছেন সেদিনের ভয়ংকর অত্যাচারের বিবরণ। গোটা শহরকে মৃত্যুনগরী বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় পাকসেনা। চলতে থাকে অবাধে লুটতরাজ। বিন্দুমাত্র আপত্তি জানালেই স্থানীয়দের জবাই করাই ছিল পাকসেনাদের একমাত্র কর্তব্য। তারা ইচ্ছামতো বাঙালিদের খুন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য নৃশংসতার চরম সীমায় পৌঁছে পাকিস্তানি বর্বরতা। এ প্রথিতযশা ব্রিটিশ সাংবাদিক মনে করেন, গণহত্যায় নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব।

কারণ ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর শহরেই ১৫ হাজারের বেশি মানুষ এক রাতে নিহত হয়েছেন। তার মতে, সেনা সন্ত্রাসের বহর দেখলেই কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে কত মানুষ প্রাণ দিয়েছেন একাত্তরে। তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা নিজের বিছানায় লাশ হয়ে পড়েছেন। দোকানদারদের জবাই করা হয়েছে বাজারের মধ্যেই। নারী ও শিশুদের তাদের ঘরেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। হিন্দুদের দলবেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে লাইন দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারপর পাকসেনারাই পুড়িয়ে দিয়েছে সব লাশ। ঢাকায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে পাক পতাকা ওড়াতে বাধ্য করেছে পাকসেনারা।

সমর বিশেষজ্ঞ এ সাংবাদিকের লেখায় উঠে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথাও। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি জেলে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাদেরও ভরা হয় জেলে। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণের মাঝেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অগণিত মানুষ মুক্তির সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকসেনা হতাহতের কোনো তথ্য অবশ্য তুলে ধরতে পারেননি ড্রিং। তবে পাকিস্তানি এক সেনাকর্তা ছাড়া দুই জওয়ানকে যে মুক্তিযোদ্ধারা ঘায়েল করতে পেরেছিলেন সেটিও তিনি উল্লেখ করেন। মূলত তার স্মৃতিচারণায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে পাক বর্বরতার ছবি। গণমাধ্যমও সেনা হামলার হাত থেকে বাঁচেনি। দুটি সংবাদপত্র অফিস গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে খুন করা হয়।
সাইমন ড্রিংয়ের বিবরণ অনুযায়ী, পাকসেনারা ঢাকায় সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ছাত্রদের ওপর। পদাতিক, সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ এ তিন পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ান রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা আক্রমণে। শুরু হয় গোলাবর্ষণ। নির্মম অত্যাচারে মেতে ওঠে পাকসেনারা। বঙ্গবন্ধুকে আগেই টেলিফোনে সতর্ক করা হয়েছিল। তাকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেয়া হলেও তিনি তা করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা শহরকে তছনছ করে ছাড়বে।’

আমেরিকা থেকে আনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম-২৪ ট্যাংক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকসেনাদের হামলার বিবরণও তুলে ধরেছেন ড্রিং। মাঝরাতে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয় শেলিং। ইকবাল হলেই দু’শরও বেশি শিক্ষার্থী মারা যান। ছাত্রদের ওপর মেশিনগান থেকে চলতে থাকে গুলি বৃষ্টি। দু’দিন পরও লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে সেখানে। গণকবর দিয়ে তার উপর চালিয়ে দেয়া হয় ট্যাংক। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই নয়, আশপাশের দু’শ গজ এলাকাজুড়ে চলে সেনা সন্ত্রাস। পাকিস্তানি সেনার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদও। ঢাকা মেডিকেল কলেজেও ব্যাপক গুলিবৃষ্টি হয়। পাক বর্বরতার প্রকৃত ছবি ঘটনার দু’দিন পর বাড়ির বাইরে বের হয়ে ঢাকার মানুষ দেখতে পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই পাকসেনাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ড্রিংয়ের বিবরণ অনুযায়ী, প্রথমে ট্যাংক থেকে শুরু হয় শেলিং। তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ কর্মীদের হত্যা করা হয়। ১ হাজার ১০০ পুলিশকর্মী ছিলেন সেখানে। খুব কমসংখ্যকই সেদিন প্রাণ হাতে পালাতে পেরেছিলেন।

রাজারবাগে পুলিশ লাইনে হামলার সময়ই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকসেনারা। ড্রিং লিখেছেন, রাত ১টা নাগাদ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তার বাড়িতেও হামলা হবে। তাই একজন সহকারী আর দেহরক্ষী বাদে সবাইকে তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে ড্রিং জানতে পারেন, রাত ১টা ১০ মিনিট নাগাদ একটি ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি এসে থামে শেখ সাহেবের বাড়ির সামনে। শুরু হয় গোলাগুলি। তারপর এক সেনাকর্তা বাইরে থেকেই বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে চিৎকার করে ইংরেজিতে বলেন, ‘শেখ তুমি নিচে নেমে আসো।’ বঙ্গবন্ধুও তার ব্যালকনি থেকে জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, আমি আসছি। তবে গোলাগুলির কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরা ফোন করলেই আমি চলে যেতাম।’ তারপর সেই অফিসার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বাগানে প্রবেশ করে বলেন, ‘ইউ আর অ্যারেস্টেড।’ বঙ্গবন্ধুকে তার তিন সহকারী, দেহরক্ষী ও সহযোগীর সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেহরক্ষীকে প্রচুর মারধরও করে জওয়ানরা। বঙ্গবন্ধুকে সেনা সদরে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর চলতে থাকে ব্যাপক লুটপাট। নথিপত্র থেকে শুরু করে বহু জিনিস তছনছ করে দেয় তারা। বাড়ির লাল-সবুজ পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়।

অপারেশন সার্চ লাইটের রাতে ২টার মধ্যেই গোটা শহর জ্বলতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের খুন করেও সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধারের পাশাপাশি লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের হত্যায় মেতে ওঠে সেনারা। এমনটাই উঠে এসেছে ড্রিংয়ের লেখায়। রাতভর নৃশংসতার পর ভোর হয়। কিন্তু ঢাকা থেকে মৃত্যু মিছিল থামার কোনো লক্ষণ ছিল না। দুপুরের দিকে আচমকাই সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা শুরু হয় পুরান ঢাকায়। ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নিয়ার বাজার, সিটি বাজার ইত্যাদি এলাকায় মানুষ পালানোর পথ পাননি। দু’ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৭০০ মানুষকে পাকসেনারা হত্যা করে বলে লিখেছেন ড্রিং। অনেককেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। পুরান ঢাকার থানাও রেহাই পায়নি। ড্রিং লিখেছেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর জানিয়েছেন, তার সঙ্গে ২৪০ জন স্টাফ ছিলেন; কিন্তু শুধু ৩০ জনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। সেনা জওয়ানরাই পেট্রলের ড্রাম নিয়ে ঘুরছিলেন। কোথাও কামান দিয়ে, কোথাওবা পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঘর। রাজাকার আর আল-বদররাই চিনিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি।

ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শিল্পাঞ্চল টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে সেনাদের লক্ষ্য। ২৬ মার্চ রাতের মধ্যে ঢাকা শহরে সেনা আক্রমণের ঝাঁজ কমতে থাকে। কিন্তু বামপন্থী শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেয়ায় শিল্পাঞ্চলে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে সেটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাকসেনারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাক নৃশংসতার বিবরণ উঠে এসেছে তার লেখায়। একইসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন সেদিন। অসহায় মানুষের কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। সাইমন ড্রিং নিজেই সেসময়ে সাহস করে বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ ঘুরে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। সেটাই তুলে ধরেছেন নিজের লেখায়। তিনি নিজের কানে শুনেছেন, পাকসেনারা আল্লাহর নামে বা অখণ্ড পাকিস্তানের নামে মানুষ খুন করছে। তাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বহু মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় পালাতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছেন; কেউ পারেননি। গণহত্যার শিকার হয়েছেন তারা।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ঠাণ্ডা মাথায় কামানের গোলা দিয়ে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান; পারেননি। সেনা দিয়ে নয়, মানুষের গণসমর্থনেই জন্ম নিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ভারত তাদের সেই সংগ্রামে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে। সঙ্গ দিয়েছেন ভারতীয় সেনা ও জনগণ। যুগান্তরের সৌজন্যে
নাফিস আহমেদ : সাংবাদিক ও লেখক