যেভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে পৌঁছে
- আপডেট সময় : ০৬:৩১:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ মার্চ ২০২১ ২০৩ বার পড়া হয়েছে
হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতাদের উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক বার্তা পাঠান তিনি। ওয়্যারলেসে পাঠানো সেই বার্তায় বলা হয়, ‘আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে, আর্মি, ই. পি. আর ও পুলিশদের অস্ত্র সমর্পণ না করতে, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে Liberate Chittagong and proceed to Comilla, take over the local administration।’ সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধু পরে কী বার্তা দেন তার অপেক্ষায় ছিলেন নেতা-কর্মীরা। এরমধ্যেই ওই রাতে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ঢাকা শহরে যে তাণ্ডব শুরু করে তার খবরও চট্টগ্রামে আসায় ভয়ের সঙ্গে প্রচণ্ড উত্তেজনা তৈরি হয় সেখানে। এ অবস্থাতেই এই চট্টগ্রামেই ২৬ মার্চ ভোরে আসে বঙ্গবন্ধুর সেই বার্তা যাতে উল্লেখ ছিল স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা। সেই বার্তাটি প্রথম গ্রহণ করেন ওই মুহূর্তে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট সলিমপুর ওয়ারলেস কর্মরত শিফট ইনচার্জ টেকনিশিয়ান মোহাম্মদ আব্দুল কাদের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আবারও সেই শিহরণ জাগানো স্মৃতি রোমন্থন করেছেন তিনি বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রামে কিভাবে আসে এটি নিয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় তৎকালীন ফৌজদারহাট সলিমপুর ওয়ারলেস কর্মরত শিফট ইনচার্জ টেকনিশিয়ান মোহাম্মদ আব্দুল কাদেরের সঙ্গে। মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোররাতে লোক-মারফত হাতে পান মগবাজার ওয়্যারলেসের প্রকৌশলী মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ। প্রকৌশলী মেজবাহ ভোরে সূর্য ওঠার সময় মগবাজার ওয়্যারলেসে গিয়ে কালবিলম্ব না করে বার্তাটি চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট সলিমপুর ওয়্যারলেসে আমার কাছে পাঠান। ওই সময় আমি সলিমপুর ওয়্যারলেসে শিফট ইনচার্জ টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতাম। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বার্তা পাঠানোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ১৯৭১ সালে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তাটি বাংলাদেশের সর্বত্র ও বহির্বিশ্বে প্রচারের উদ্দেশ্যে মগবাজার ওয়ারলেসে পাঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।’
চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট সলিমপুর ওয়ারলেস কর্মরত শিফট ইনচার্জ টেকনিশিয়ান আরও বলেন, ‘এই ভিএইচএফ ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস চ্যানেলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল ৫টা-৬টার মধ্যে মগবাজার ওয়্যারলেসের মেজবাহ্ উদ্দিন, ফৌজদারহাট সলিমপুর ওয়্যারলেসে আমার কাছে পাঠান। এরপর বাংলাদেশের ১৯টি জেলার ৫টি লিংকের সব ওয়্যারলেস কেন্দ্রে যার যার সুবিধানুযায়ী টেলিগ্রাফ অফিসসহ আমরা ভাগাভাগি করে পাঠাই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল: যেন দেশব্যাপী সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এটি পৌঁছানো হয়। বাংলাদেশের সব জেলার ভিএইচএফ ওয়্যারলেস কেন্দ্র থেকে বার্তাটি সেভাবে আমরা পৌঁছে দিয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গোলাগুলি ও সমুদ্র থেকে নেভির প্রচণ্ড সেলিং-বিস্ফোরণের আওয়াজে সলিমপুর ওয়্যারলেস কেন্দ্রের কর্মচারীরা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে আশেপাশের জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ঐ সময় আমি একা হয়ে পড়লে খবর শুনতে আসা স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি মফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম, সহ-সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর, সদস্য সিরাজ-উদ-দৌলা, সদস্য মোজাফ্ফর আহম্মদ, সারারাত আমার পাশে থেকে দারুণভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগান। আমি ওয়্যারলেসের নৈশপ্রহরী মো. আবু জাফর, হেদায়েতুল উল্লাহ্ পাঠান, আব্দুল হাই, ফজলুর রহমানের পরিবর্তে ছেলে বেলায়েত হোসেনদেরকে কুমিল্লা থেকে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির হানাদার বাহিনী এবং সমুদ্রের গোলাবর্ষণরত গানবোটকে অত্যন্ত কড়া নজর রাখার জন্য ডিউটি ভাগ করে দেই, যাতে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সরে যাওয়ার সুযোগ পাই।’
স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি গ্রহণ করার পর এটি হাতে লিখে, কার্বন কপি করে অসংখ্য কপি করা হয় এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে হাতে দেওয়া হয় জানিয়ে আব্দুল কাদের বলেন, ‘২৬ মার্চ সকালে বার্তা গ্রহণ করার পর, রাতভর আমার সাথে থাকা নেতাকর্মী ও সকালে যোগ দেওয়া সহকর্মী আব্দুর রব সিকদার, মাহফুল আলী, আব্দুল হাকিম, এন.দাশগুপ্ত, বেলায়েত হোসেন প্রমুখদের দিয়ে শত শত কপি করা হয়। এ চারজন নেতার নেতৃত্বে চারভাগ করে সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি এম.এ মামুন, সাধারণ সম্পাদক ডা. এখলাসুর রহমানসহ মিরসরাই পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গার জনগণ ও নেতাকর্মীদের হাতে-হাতে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়। চট্টগ্রাম শহরের এম.আর ছিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম.এ হান্নান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও সংগ্রাম পরিষদের হাতে-হাতে একইভাবে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য তারা সবাই সকাল ৭টার মধ্যেই বের হয়ে যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত থেকে দিদারুল আলম চৌধুরীর সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল। দিদারুল আলমের সাথে সাইকেল ছিল জানতাম। ওইদিন ২৬ মার্চ সকালে তাড়াতাড়ি আসার জন্য বললে স্থানীয় নেতাদের গ্রুপ প্রচারের জন্য বের হয়ে যাওয়ার কিছু সময় পর তিনি সাইকেল নিয়ে আমাদের ওয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বার্তার কপি করার জন্য বললে তা সম্পন্ন হলে আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে-হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বের করে দিই। স্থানীয়ভাবে নেতাকর্মীরা প্রচার শোনার পর বঙ্গবন্ধুর খবরের জন্য লোকজন ওয়্যারলেস স্টেশনে আসলে তারাও কিছু কিছু কপি নিয়ে যান প্রচার করার উদ্দেশ্যে।’
আব্দুল কাদের বলেন, ‘ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি’র হানাদার বাহিনী ও বাঙালিদের সাথে কুমিরা-ভাটিয়ারীতে সশস্ত্র যুদ্ধের গোলাগুলির আওয়াজ তীব্র হচ্ছিল। এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন গ্রুপে ‘বার্তার কনফারমেশন কপি’ পাঠানোর মূল কারণ ছিল, কেউ না কেউ নেতাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হবেন। বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যরা সঠিকভাবে স্বাধীনতা-ঘোষণা বার্তা সর্বত্র পৌঁছিয়ে দিতে সফল হন। অন্যদিকে ইপিআর, পুলিশ ও বাঙালি আর্মি যারা ঢাকার বাইরে ছিল, তারাও বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়্যারলেস বার্তাটি আমাদের ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে গ্রহণ করে নিজেরাও একে অপরকে তাঁদের ওয়্যালেস স্টেশনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।’
আব্দুল কাদের বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ হান্নান এই বার্তা পাওয়ার পর ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি পাঠ করেন। আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের জন্য এই ঘোষণা তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় ছিল। সলিমপুর ওয়্যারলেস থেকে ২৬ মার্চ সকাল ৭টার মধ্যেই চট্টগ্রামে বহির্নোঙরে অবস্থান করা বিদেশি জাহাজ এম.ভি-ভি.ভি. গিরি, জাতিসংঘের জাহাজ এম.ভি-মিনি-লা-ট্রিয়া, আমেরিকান জাহাজ এম.ভি-সালভিস্তাতে ভি.এইচ.এফ স্টেশনের মোবাইল রেডিও চ্যানেল ১৮,২২,২৪,২৫,২৬,২৭ ইন্টারন্যাশনাল ভয়েজ কোডে বার্তা পাঠানো হয়। বিদেশি জাহাজের রেডিওর হাই-ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ দেশের কোস্টাল রেডিও স্টেশনের সাথে সংযুক্ত টেলিগ্রাফ অফিসের টেলিপ্রিন্টার সার্ভিসের সহযোগিতায় সরাসরি প্রথমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ‘টপ আর্জেন্ট ম্যাসেজ’ শিরোনামে বিশ্ববাসী ও গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে সফল হন।’’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬টার দিকে পাহাড়তলী ট্রান্সমিটারে আমাদের ওয়্যারলেস টেকনেশিয়ান আবুল কাশেম খান, আবুল ফজল, ছাত্রনেতা ফজলুল হক ভূঁইয়াসহ কয়েকজন স্থানীয় যুবক দেশীয়-অস্ত্র, লাঠি-সোঁটা নিয়ে সীমানা বেড়া কেটে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। পরে পাহাড়তলী ট্রান্সমিটার চালু করে সলিমপুরে শিপিং কন্ট্রোল (কেভিন)-এ ট্রান্সমিটার প্রস্তুত করে সংযোগ দেয়। এসময় আমার দেওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-ঘোষণা বার্তাটি পুনরায় সমুদ্রের দূরবর্তী অঞ্চলে চলাচলকারী জাহাজে ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফী কোডে বহির্বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান ও গণমাধ্যমে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ ভয়েস অব আমেরিকাসহ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ২৭ মার্চ সারা বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানসহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’ মর্মে বিশাল ক্যানভাসে খবর প্রচারিত হয়। বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে